হলদে পরির দেশ-৩
ছোট দ্বীপদেশ তাইওয়ান। আয়তনের হিসাবে বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ। দেশটির বেশির ভাগ অংশ মূলত পাহাড় আর পর্বত। সমতল ভূমি প্রায় নেই বললেই চলে। মজার ব্যাপার হলো এ দ্বীপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৮০০ ফিটের বেশি (৩০০০ মিটার) উচ্চতার ২৬৮টি পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে! যার মধ্যে ইউশান (জেড মাউন্টেন–চীনা ভাষায়) তাইওয়ান এমনকি পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। পার্বত্য এ দ্বীপের পূর্ব উপকূলে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর আর পশ্চিমে চীন সাগর। এবারের চায়নিজ নিউ ইয়ারের ছুটিতে আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম নানতু কাউন্টিতে। নানতু তাইওয়ানের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। রয়েছে গভীর পার্বত্য এলাকা। ঠিক করলাম প্রথমে যাব প্রথমে রেন আই টাউনশিপের চিংজিং ফার্মে। এ এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ৫৭৬৭ ফিট (১৭৫৮ মিটার) উচ্চতায় অবস্থিত। একদিন থাকার পর চলে যাব সান মুন লেকে। এ হ্রদটিও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪৫৪ ফিট (৭৪৮ মিটার) উচ্চতায়। দুটি জায়গাতেই রয়েছে গাঢ় মেঘ আর পাহাড়ের ভয়ংকর সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ।
ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ সকাল বেলা। আকাশ বেশ থমথমে। আবহাওয়া অফিসের খবর অনুযায়ী শৈত্যপ্রবাহ আসছে। বেশ কিছু পর্বতের চূড়ায় তুষারপাত হবে। হোটেল বুকিং করেছি প্রায় দুই মাস আগে। এখন বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করেই রওনা হয়ে গেলাম। প্রথমে মিয়াওলি কাউন্টিতে। সেখান থেকে হাইস্পিড ট্রেনে যাব তাইচুং সিটিতে। দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। আমরা যাত্রা শুরু করেছি অফিশিয়াল ছুটির একদিন আগে। ফলে স্টেশনে তেমন ভিড় নেই। চমৎকার আধুনিক ট্রেন। চলার মুহূর্তের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ করে। গতি ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেল। মাত্র ১৭ মিনিটে দুই পাশের পাহাড়-সমুদ্র দেখতে দেখতে চলে এলাম পশ্চিম উপকূলের শহর তাইচুং। স্টেশন থেকে রেন আই কাউন্টিতে ট্যুরিস্ট বাস চলাচল করে। আমরা একটিতে চড়ে বসলাম। কিছুক্ষণের ভেতর বাস চলা শুরু করল সোজা পূর্ব দিক বরাবর। এখান থেকে প্রথমে যাব পুলি সিটিতে।
পুলি শহরটি ছোট। পাহাড় আর পর্বতে ঘেরা। আধা ঘণ্টায় ভেতর চলে আসলাম। পুলি থেকে এবার বাস যাত্রা শুরু করল চিংজিং ফার্মে। এটি পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্যের একটি। পর্বতের চূড়ায় বিশাল এলাকাজোড়া এক সবুজ উদ্যান। প্রতিবছরের এ সময়টায় চেরি ফুল ফোটে। বাঁধানো আঁকাবাঁকা হেঁটে যাওয়ার পথের দুই পাশে চেরি ফুল। কিছু দূরেই পর্বতের চূড়ার সারি। এ এক অন্য রকম সৌন্দর্য। এ ফার্মটি মূলত ছিল ভেড়ার খামার। এখনো তা আছে। বাড়তি হিসেবে যোগ হয়েছে দর্শকদের জন্য বিভিন্ন রকমের মজাদার খেলা।
পুলি সিটি থেকে চিংজিং ফার্মের দূরত্ব খুব বেশি না। তবু পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে আসতে প্রায় দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেল। আমরা প্রথমে চলে গেলাম হোটেলে। পরিকল্পনা ছিল খানিক সময় রেস্ট নিয়ে বেড়িয়ে পড়ব চিংজিং ফার্ম দেখতে। হোটেলে পৌঁছার কিছুক্ষণের ভেতর সবকিছু গাঢ় মেঘে ঢেকে গেল। মধুর সমস্যা। বলতে গেলে হোটেলে পুরো বন্দী হয়ে গেলাম। দেখছি মেঘ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। অনলাইনে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে হোটেলটি পছন্দ করেছিলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০০ ফিট উচ্চতায়। আমরা পৌঁছেছি দুপুর দুইটায়। তখন দেখেছিলাম দূরের আকাশ কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন। ঝটপট নামাজ আর দুপুরের খাবার শেষে বাইরে বের হলাম। চক্ষু চড়কগাছ! আমাদের শরীর ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘ। কিছুক্ষণের মধ্যে কালো মেঘে সবকিছু ঢেকে গেল! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমার মাথায় হাত! কত কিছু দেখার ছিল। পুরো পরিকল্পনা পণ্ড। তৃশা আর আয়ানের অবশ্য সমস্যা নেই। ওরা উপভোগ করছে। জীবনে প্রথমবারের মতো মেঘে ছুঁয়ে দেখা!
উপায় না দেখে হোটেল রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-মেঘের কারণে তো কিছুই দেখতে পারলাম না। বলো তো কী করা যায়?
একটু সময় চুপ থেকে বলল,
-এই ওয়েদারে বেস্ট অপশন হলো বেলকনিতে বসে কফি খাওয়া!
হোটেলের পক্ষ থেকে সব অতিথির জন্য চা–কফির আয়োজন করা হয়েছে। আমি বেলকনিতে কফি নিয়ে বসেছি। সামনে যত দূর চোখ যায়, সব সাদার আবরণে ঢাকা। আবহাওয়াটা মন্দ লাগছে না। মনে হচ্ছে এক অপার্থিব জগতে চলে এসেছি। রাতে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব ভালো ঘুম হলো না। রাতে কিছুটা বৃষ্টিও হয়েছে। ভেবেছিলাম সকালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তা হলো না। সকাল বেলা নাস্তা সেরে হোটেল ম্যানেজারকে বললাম, চেক আউট করে ফেলব। সে একটু সময় চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করল,
-তোমরা আর কোথাও যাচ্ছ?
উত্তরে জানালাম,
-হ্যাঁ, সানমুন লেকে যাব।
আমার কথা শোনে বলল,
তাহলে চিংজিং ফার্মে ঘুরে যেতে পারো। ওয়েদার যদিও ভালো না। ভিজিবিলিটি খুব কম।
রাজি হলাম। বললাম একটা ট্যাক্সি ডেকে দেওয়ার জন্য।
সে রিসিপশনিস্ট মেয়েটির সঙ্গে কথা বলল। একটু পর রিসেপশনিস্ট মেয়েটি আমাকে জানাল, আমাদের বস নিজেই তোমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে।
আমরা দ্রুত লাগেজ নিয়ে তৈরি হয়ে গেলাম। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি ধীরে ধীরে চলছে। তবু গাঢ় মেঘে রাস্তায় তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমরা প্রথম গেলাম ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারে। লাগেজ লকারে রেখে চললাম চিজিং ফার্ম। প্রবেশপথে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের রেইন কোর্ট কিনে নিলাম। আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।দেখলাম, রাস্তার দুই ধারে চেরি ফুটেছে। কিছু ভেড়ার দেখা পেলাম। অলস ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ মেঘে ঢাকা থাকায় পুরো সৌন্দর্য বোঝা যাচ্ছে না। আমরা যাত্রা শুরু করলাম উত্তর প্রান্ত থেকে। যাবো দক্ষিণে। আধা ঘণ্টা হাঁটার পথ পার হয়ে ফার্মের দক্ষিণ প্রান্তে চলে এলাম। এখানে চিংজিং স্কাই ওয়াকের প্রবেশমুখ। পাহাড়ের চূড়ার এক প্রান্ত ধরে চলে গিয়েছে ১২০০ মিটারের হেঁটে চলার রাস্তা। সমস্যা হলো পুরো রাস্তাটি মেঘে ঢাকা। তৃশা, আমি আর আয়ান, তিনজন মিলে মেঘের ভিতর হাঁটছি। মেঘ আসা যাওয়ার ভেতর মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছিল পাশের পর্বতের চূড়াগুলো। আবার ক্ষণিকের ভিতর কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলাম পাহাড়ের ভয়ংকর সুন্দর এক রুপ। অবশেষে বিদায় নেবার পালা। ক্লান্ত শরীরে ফিরতি বাসে চড়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য তাইওয়ানের বৃহত্তম হ্রদ, সানমুন!
আমরা প্রথমে যাচ্ছি পুলি সিটিতে। সেখান থেকে সানমুন লেকের বাস ধরব। এরই ভিতর পুলির চিনান ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া একমাত্র বাংলাদেশি ছাত্রী মৃদার ফোন। জানাল, আমাদের জন্য চিকেন বিরিয়ানি রান্না করেছে। অপেক্ষা করবে পুলি বাসস্টপে। চিকেন বিরিয়ানির কথা শুনে মনে হলো পেটের ক্ষুধা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। মৃদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সানমুল লেকের বাস ধরলাম। বেশিক্ষণ সময় লাগল না। একবারে লেক ঘেঁষা হোটেল। পাশেই নৌকার জেটি। হোটেলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বের হলাম। চোখের সামনে শান্ত-স্নিগ্ধ হ্রদের পানি। তাইওয়ানের বৃহত্তম এই হ্রদটি দেশটির ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। ইউচি টাউনশিপে প্রায় ৭.৯৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এর অবস্থান। মজার ব্যাপার হলো এই বিশাল হ্রদটি সমুদ্রপৃষ্ট হতে প্রায় আড়াই হাজার ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। এত উচ্চতায় কীভাবে হ্রদের উৎপত্তি হলো তা নিয়ে কৌতূহল জাগল। গুগলে বেশ সময় নিয়ে কিছুক্ষণ ঘাঁটলাম। জানলাম, কোনো এক ভূমিকম্পের ফলে দুই পাহাড়ের মাঝের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে আরো পানি আটকে ফেলা হয়েছে। এভাবেই প্রাকৃতিক আর কৃত্তিম দুই শক্তির মিলনে এই বিশাল হ্রদ। বর্তমানে, এটি তাইওয়ানের মিঠা পানির সবচেয়ে বড় উৎস। হ্রদের চারপাশে মনোরম সাইকেল চালানোর পথ রয়েছে। আরও আছে সুন্দর হাইকিং ট্রেইল, সমৃদ্ধ আদিবাসী সংস্কৃতিসহ আরও অনেক কিছু। হ্রদের অন্য পাশে আদিবাসী সংস্কৃতিক কেন্দ্রটি চেরি ফুলের জন্য জায়গাটি বিখ্যাত। ক্যাবল কারে চেপে যেতে হয়। অনলাইনের তথ্যমতে পাঁচ হাজারের বেশি চেরি গাছ রয়েছে সেখানে।
হোটেলের বাইরে বেশিক্ষণ থাকা গেল না। মনে হল চারপাশের পাহাড় থেকে ঠান্ডা ধেয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফেরাই আপাতত বুদ্ধিমানের কাজ। তাই করলাম। রাতে ভালো ঘুম হল। সকালবেলায় বেলকনিতে দাঁড়ালাম। সূর্য উঠেছে। হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে রোদের ঝিকিমিকি। হোটেলের পাশের জেটিতে সারি সারি নৌকা দাঁড়িয়ে। আয়ান অস্থির হয়ে যাচ্ছে। সে নৌকায় উঠতে চায়। এত দিন টিভিতে দেখেছে। এখন চোখের সামনে। জলজ্যান্ত নৌকা। সত্যি সত্যি পানিতে দুলছে। তাইচুং শহরে কয়েকজন বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। তারাও আজ আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। নাশতা সেরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবাই একসঙ্গে জড়ো হতে হতে দুপুর হয়ে গেল। ততক্ষণে চারপাশ মেঘে ঢেকে গিয়েছে। চোখের সামনে দেখলাম মেঘ, পাহাড় আর হ্রদের পানি সব মিলেমিশে একাকার। রাস্তা ঘাটেও তেমন মানুষজন নেই। হ্রদে নৌকা চলাচলও বন্ধ। হ্রদকে বৃত্তাকারভাবে ঘিরে সাইকেল চালানোর রাস্তা আছে। আমরা ইলেকট্রিক বাইক ভাড়া করে সেই পথ ধরে ছুটলাম। আমার সাইকেলের সামনে আয়ান বসা। সে খুব উত্তেজিত।
আয়ান একটু পর পর বলছে,
-পাপ্পা, লুক-ওয়াটার বোটস।
ছেলের কথায় আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সাড়া দিই।
আয়ান আবার আমাকে বলে, পাপ্পা মোর স্পিড, মোর স্পিড।
আমি জিজ্ঞাসা করি,
-কী ভালো লাগছে?
-হুম, আমার অনেক ভালো লাগছে।
আমি সাইকেলের স্পিড কিছুটা বাড়িয়ে দেই। কনকনে ঠান্ডায় আমার হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। আয়ানকে জিজ্ঞেস করি,
-কি ঠান্ডা লাগছে।
-নাহ। আমার হট লাগছে!
বললাম, আউউউ বলে চিৎকার করো। আরও ভালো লাগবে। আয়ান তাই করছে। আমিও ওর সাথে যোগ দিচ্ছি। মনে হল ছেলের উত্তেজনা এবার পুরোটা নিজের ভেতর ফিল করতে পারছি।
সন্ধ্যাবেলায় একে একে সবাই বিদায় নিল। আমরাও হোটেলে চলে এলাম। শরীর বেশ ক্লান্ত। ঠিক করলাম, পরদিন সকাল সকাল নৌকা আর কেব্ল কারে চড়ব। তারপর বিকেলের ট্রেন ধরে বাসায় রওনা দেব। এবার ঘুরতে যাওয়ার আগে আবহাওয়া পূর্বাভাস আমাদের পক্ষে ছিল না। বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। সে হিসেবে আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন ছিল না বটে, তবে মেঘ আর পাহাড় মিলেমিশে যে অন্য রকম সৌন্দর্য দেখেছি, তা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এখনো চোখ বন্ধ করে কল্পনার চোখে দেখি পাহাড়ের গা ছুঁয়ে ভেসে বেড়ানো কিংবা হ্রদের পানি ছুঁয়ে ছুটে আসা মেঘগুলো।
লেখক: বদরুজ্জামান খোকন; পিএইচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]