হলদে পরির দেশ-১
অনেকটা হুট করেই বেরিয়ে পড়লাম তাইপের মাওকং গন্ডোলার উদ্দেশে। মাওকং গন্ডোলা তাইওয়ানের প্রথম কেব্ল কার সিস্টেম। যাওয়া-আসা মিলিয়ে দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটারেও বেশি। এবারের যাত্রাসঙ্গী আমার স্ত্রী তৃষা আর সাড়ে তিন বছর বয়সি ছেলে আয়ান। গত কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছিল তাইওয়ানজুড়ে। যাত্রার দিনটিতে আকাশ বেশ ঝকমকে-পরিষ্কার। ছুটির দিনের আবহাওয়া হিসাবে পারফেক্ট। ট্যাক্সি কল করেছিলাম সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। বেশিক্ষণ সময় অপেক্ষা করতে হলো না।
চলে এল ১০টার আগেই। তারপর ছুটলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য জুনান ট্রেন স্টেশনে। শনিবার সকাল। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে মাত্র ১০ মিনিটে ট্রেন স্টেশনে চলে এলাম। তারপর টিকিট কেটে, চেপে বসলাম জি-চিয়াং এক্সপ্রেস ট্রেনে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় ট্রেনে বেশ ভিড়।
ট্রেনের এ যাত্রাপথটি আমার বরাবরই ভালো লাগে। হাতের বাঁ পাশে ফারমোজা প্রণালি অন্য পাশে পর্বতমালার সারি। ১৮০ কিলোমিটার প্রশস্তের এই ফারমোজা প্রণালি তাইওয়ানকে চীন থেকে পৃথক করেছে। সৈকতের পাশ ধরে বসানো হয়েছে অসংখ্য বায়ুকল।
দূরের সমুদ্রের পানি আর অলস ঘূর্ণমান বায়ুকলের পাখা। চোখ জুড়িয়ে দেয়। জানালা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে ইচ্ছে হয় না। জুনান সিটি থেকে তাইপেই সিটির দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটারের। এক্সপ্রেস ট্রেনে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। দেখতে দেখতেই সময় পার হয়ে গেল। তাইপে চলে এসেছি। আমরা নামলাম তাইপে মেইন স্টেশনের আগে বানচিয়াও স্টেশনে। বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড রেল জংশন। না দেখলে এর বিশালতা বিশ্বাস করা যেত না।
স্টেশনের দুই পাশে সাজানো–গোছানো প্রচুর খাবারের দোকান। ফুড ফেস্টিভ্যালের মতো। হঠাৎ কেউ এলে নির্ঘাত মেলা ভেবে ভুল করবেন। এখান থেকে দুপুরের খাবার কিনে নিলাম। তারপর মেট্রোতে বসে তাইপে শহরের ল্যান্ডস্কেপ আর স্কাইস্ক্যাপার দেখতে দেখতে চললাম শহরের পূর্ব প্রান্তের মাওকং গন্ডুলার দিকে। বেলা দেড়টার ভেতরেই চলে এলাম গন্তব্যে। কেব্ল কারে চড়ার উদ্দেশ্যে টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
এখানেও দেশি-বিদেশি পর্যটকের বেশ ভিড়। তবে কোনো হইচই নেই। ছোট–বড় সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ-পঁচিশ মিনিটের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আমরা তিনজন চেপে বসলাম ক্রিস্টাল ফ্লোরের কারে। ওপর থেকে নিচের দৃশ্য দেখার রোমাঞ্চটা মিস করতে চাইনি।
গন্ডোলায় ঘোরার একটি সুন্দর সময় হলো বৃষ্টির পর। অপরটি হলো যখন সূর্য অস্ত যায় আর ধীরে ধীরে তাইপে শহরের আলোগুলো জ্বলে ওঠে। আমাদের এ দুটোর কোনটিরই সৌভাগ্যই হয়নি। আমরা রওনা হয়েছি ভরদুপুরে। এছাড়া কেব্ল কার দিয়ে যখন এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ছুটে চলছি, তখনো আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সেই সঙ্গে ভ্যাপসা গরম। গন্ডোলার যাত্রাপথে মোট চারটি স্টপেজ।
সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত স্টেশনের নাম মাওকং। আমরা ঠিক করলাম মাওকং পর্যন্ত যাব। কেব্ল কারের এ দীর্ঘ যাত্রায় বেশকিছু চমৎকার দৃশ্য দেখতে পেলাম। যখন পাহাড়ের ওপর দিকে যাচ্ছিলাম, তখন নিচের চলন্ত মেট্রো ট্রেন, জিংমেই নদীর ধারের পার্ক, তাইপে শহরের প্যানোরামিক ভিউ, এসব দেখতে অসাধারণ লাগছিল। তবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর লাগে কেবল কার যখন দুই পাহাড়ের চূড়ার মধ্যবর্তী স্থানে এসে ইংরেজি ‘V’ অক্ষরের ঝুলে পড়ল। এটিই সম্ভবত মাওকং গন্ডোলা ভ্রমণের আসল ক্লাইম্যাক্স।
এ পয়েন্টে এসে অন্য সবার মতো আমার শরীরও একটু শিরশির করে উঠল। প্রায় ২৫ মিনিট সময় লাগল সর্বশেষ স্টেশন মাওকংয়ে পৌঁছাতে। এখান থেকে কয়েকটি হাইকিং ট্রেইল আছে। ঘণ্টাখানেক সময় ব্যয় করলে আরও কয়েকটি পর্যটন স্পট ঘোরা যেত। কিন্তু ভ্যাপসা গরমে ইচ্ছে হলো না।
মাউনটেন স্টেশনে দেখা হলো কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ। এখানে পরিবারসহ ঘুরতে এসেছেন। দেখেই বোঝা গেল গরমে শরীরের অবস্থা বেশ কাহিল। কথা বলে জানলাম, ঘণ্টাখানেক পাহাড় বেয়ে করে তারা গিয়েছিল কাছের একটি জলপ্রপাত দেখতে।
স্থানীয় কিছু মানুষকে দেখলাম। বেশ বয়স্ক। তাঁরাও পাহাড় বেয়ে এসেছেন। কিন্তু শরীরে ক্লান্তির বিন্দু ছাপমাত্র নেই। মনে মনে হাসলাম। আমাদের বাঙালি শরীর আসলেই পাহাড়-পর্বত বেয়ে চলার উপযুক্ত নয়। মাওকংয়ে পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে অনেক চা–বাগান। এমনকি তাইওয়ানের চা প্রোমোশন সেন্টারটিও এখানে। অবধারিতভাবেই চারপাশে অনেকগুলো নান্দনিক ডেকোরেশনের চায়ের দোকান চোখে পড়ল। এখানে পাওয়া যায় তাইওয়ানের বিখ্যাত ‘ওজেশান পাউচং চা’।
খেতে বেশ সুস্বাদু। শুনেছি অনেকে বিকেল বেলা চা পান করার জন্যই এখানে আসেন। আমরা অবশ্য বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি। ঘণ্টাখানেক সময় ঘুরেফিরে আবার নিচে নেমে এলাম। পরের গন্তব্য তাইপেই ১০১। ২০১১ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন। ড্রাগনের মত তাইপে শহরের বুকে দাঁড়িয়ে! সেখানে সন্ধ্যার পরিবেশটা অন্যরকম আবহ তৈরি করে।
মাওকং থেকে নিচে নামার সময় আনমনেই মনে পড়ে গেল সিলেটের কথা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনেই ছিল লাক্কাতুরা চা–বাগান। সময় সুযোগ হলেই চলে যেতাম সেখানে। তারপর চাকরির সুবাদে সিলেট-মৌলভীবাজারের চা–বাগানগুলোর অলি-গলির রাস্তায় কত ঘুরেছি। মনের ভাবনাগুলো ঠিক যেন সুকান্তের কবিতার মতোই ঘুরপাক খাচ্ছিল—
‘তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে’...
মনের ভাবনাগুলো সরিয়ে আবার মেট্রোতে চেপে বসলাম। আকাশ ততক্ষণে আরও কালো হতে শুরু করেছে। তাইপেই ১০১ আসতে না আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমরাও বাহিরে অপেক্ষা না করে চলে গেলাম ফুড কোর্টে। গ্রাউন্ড ফ্লোরজুড়ে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশের খাবারের বাহারি সমাবেশ। খুঁজে নিলাম একটি ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান।
তাইপে শহরের প্রধান অভিজাত এলাকা হলেও খাবারের দাম বেশ কম। এমনকি আমাদের দেশের রেস্তোরাঁর সমান দামেরই মনে হল। খাওয়া-দাওয়া শেষে এবার চললাম ভেতরে ঘুরে দেখার জন্য। জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল শপিংমল। বিশ্বের সব নামকরা ব্রান্ডের সমাহার। ঘড়িতে সময় দেখে নিলাম। রাত সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। ইচ্ছে না হলেও আমাদের বেরুতে হবে। রাতের শেষ ট্রেনে ধরে ঘরে ফেরার সময় হয়েছে এবার।
লেখক: বদরুজ্জামান খোকন, পিএচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশন্যাল হেলথ রিসার্চ ইন্সটিটিউট, তাইওয়ান।
[email protected]দূর পরবাসে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারবেন [email protected] এ।