হলদে পরির দেশ-২
আমাদের এবারের গন্তব্য একসময়ের সোনার খনিসমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদ জিউফেন। তাইওয়ানের উত্তর-পূর্ব কোণের ছোট্ট পার্বত্য এ শহরের এক পাশে পূর্ব চীন সাগর। বাকি তিন দিক পর্বত দিয়ে ঘেরা। জিউফেনের আসল সৌন্দর্য হলো পাহাড়ের ঢালে সাজানো ছোট-বড় বাড়িঘর, হোটেল আর পুরোনো সরু গলিপথ ধরে গড়ে ওঠা দোকানপাট। ঘুরতে যাওয়ার আগে ওখানকার প্রাথমিক কিছু তথ্য ইন্টারনেট থেকে জেনে নিলাম। খনি আবিষ্কারের প্রথম দিকে জিউফেনে প্রায় চার হাজার মানুষের বসতি ছিল। তারপর স্বর্ণখনির শ্রমিকদের আগমনে বসতিগুলোর কলরব আরও বাড়ে। আবার সোনার খনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শহরটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিরিবিলি যায়। অনেকটা হারিয়ে বসে নিত্যতার পাতা থেকে।
বর্তমানে জিউফেন পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। বিশেষ করে জাপানিজ ও কোরিয়ানদের কাছে। মজার ব্যাপার হলো, মাত্র কয়েক দশক আগেও পরিস্থিতি ছিল একদম ভিন্ন। তেমন কোনো নামগন্ধ খুঁজে পাওয়া যেত না। হারিয়ে যাওয়া জিউফেন আবার মানুষের কাছে ফিরে আসে এক চলচ্চিত্র পরিচালকের হাত ধরে। ১৯৮০ সালের কথা। একজন সিনেমা পরিচালক এ শহরে আসেন। এক পাশের নীল সমুদ্রের সৌন্দর্য, অন্য পাশের ঢালু পাহাড়ের স্তরে স্তরে গড়ে ওঠা ছোট্ট শহরটি তাঁর ভালো লেগে যায়। অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য আর একই সঙ্গে জনপদটির অতীত ইতিহাস তাঁর ভাবনায় ঘুরপাক খায়। কল্পনার চোখে দেখতে পান সোনার খনি খননের দিনগুলোর কথা। তাঁর মনের ভাবনা ধরা দেয় সেলুলয়েডের পর্দায় ‘আ সিটি অব স্যাডনেস’ নামে। বিখ্যাত সিনেমাটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দেয়। এর পর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ঢল নামে শহরটিতে।
আমরা কিন্তু অতীতের স্মৃতির খোঁজে জিউফেন যাচ্ছি না। আমি, স্ত্রী তৃষা—দুজনেই পিএচডি করছি তাইওয়ানে। গত কয়েক মাস ল্যাবে টানা ব্যস্ততা গিয়েছে। এখন আমরা যাচ্ছি একটু নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটানোর জন্য। আমাদের পরিকল্পনা ছিল প্রথমে যাব রুইফেং। সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে বাংলাদেশি ছাত্র রিয়াদ। সে তাইপেই টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছে। আমরা রুইফেং থেকে ট্রেনে যাব শিফেন জলপ্রপাত দেখতে। তারপর শিফেন থেকে আবার রুইফেং ফিরব। রিয়াদ তাইপেই ফিরে যাবে। আমি, তৃষা আর আয়ান বাস অথবা ট্যাক্সিতে করে চলে যাব জিউফেন। সেখানে আমাদের থাকার জন্য আগে থেকেই হোটেল বুক করে রেখেছি।
আমরা ভোরবেলায় জুনান স্টেশন থেকে রওনা হয়ে গেলাম। ট্রেনে রুইফেং যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। চাচ্ছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছানোর। আমরা রুইফেং স্টেশনে এসে পৌঁছালাম সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। তাইপেই থেকে রিয়াদও ততক্ষণে চলে এসেছে। পরিকল্পনা ছিল, রুইফেং স্টেশনের লকারে লাগেজ জমা রাখব। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পর একটা ধাক্কা খেলাম। এখানে প্রচণ্ড ভিড়। ঠিকমতো হাঁটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
সারা স্টেশন দেশি-বিদেশি পর্যটকে গিজগিজ করছে। বেশির ভাগ জাপানিজ আর কোরিয়ান। অন্য দেশের সংখ্যাও কম নয়। যা-ই হোক, প্ল্যাটফর্ম বদল করতে করতেই সময় শেষ। রিয়াদ আমাদের জন্য আগেই টিকিট কেটে রেখেছিল। তাই আর কিছু না ভেবে লাগেজসমেত ট্রেনে উঠে পড়লাম। পুরোনো দিনের ডিজেল ইঞ্জিনচালিত ট্রেন। সম্ভবত পাহাড়ি রাস্তার জন্য এটাই মানানসই। এখান থেকে শিফেন জলপ্রপাত আধা ঘণ্টার পথ। সরু পাহাড়ি পথ আর টানেল ধরে ট্রেন চলছে। দুই পাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলে এলাম শিফেন স্টেশনে। স্টেশন থেকে বের হয়ে চললাম শিফেন জলপ্রপাত দেখতে। এখান থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে জলপ্রপাতটি। এটি তাইওয়ানের সবচেয়ে বিস্তৃত জলপ্রপাত। কেউ কেউ অবশ্য একে তাইওয়ানের ছোট নায়াগ্রা বলেও ডাকেন। উচ্চতা প্রায় ৬৬ ফুট আর প্রস্থে ১৪০ ফুট। আশপাশের বিভিন্ন পর্বতের ঝরনার পানি একত্র হয়ে অনবরত ঝরে পড়ছে কিলাং নদীর উৎসমুখে। এককথায়, মনোমুগ্ধকর। শিফেন জলপ্রপাত আর ঝুলন্ত সেতু দেখার পর দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেল। এবার রুইফেংয়ে ফেরার পালা।
রুইফেং আসতে আসতে প্রায় চারটা বেজে গেল। রিয়াদকে বিদায় জানিয়ে চললাম বাসস্টপে। ট্রেনের মতো বাসস্টপেও খুব ভিড়। সবাই ছুটছেন জিউফেনের দিকে। রাতের জিউফেন যেন এক ম্যাজিক্যাল নগরী। সবাইকে ডাকছে। আমরাও বাসে চেপে বসলাম। এখান থেকে আরও ২০-২৫ মিনিটের পথ। যখন জিউফেন পৌঁছালাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা। ততক্ষণে শহরের বিখ্যাত লাল রঙের লণ্ঠনগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। আমরা নামলাম পুলিশ স্টেশনে। তারপর পাহাড়ি রাস্তায় শ খানেক সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর হোটেলটি খুঁজে পেলাম। হোটেলের রুমে প্রবেশ করে সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। চমৎকার উত্তরমুখী বেলকনি। সেখান থেকে যত দূর চোখ যায়, শুধু সাগরের জলরাশি, দূরের ছোট দ্বীপ আর চারপাশে পাহাড়ের ঢালে বানানো হোটেলের রংবেরঙের আলো। এ এক অন্য রকম সুন্দর দৃশ্য।
জিউফেনে সময় কাটানোর মূলত দুটি উপায় রয়েছে। হইহুল্লোড় প্রিয় হলে ওল্ড স্ট্রিট আদর্শ জায়গা। আবার কেউ যদি ভিড় থেকে দূরে থাকতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে হোটেলগুলো। সেখানে খোলা বেলকনিতে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক। সামনে শান্ত নীল সমুদ্র। খোলা নীল ঝকঝকে আকাশ। যেখানে হেলান দিয়ে রয়েছে পাহাড়ের সারি। আমরা হোটেলেই রাতের খাবার সেরে নিলাম। তারপর ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে চললাম বিখ্যাত জিউফেন ওল্ড স্ট্রিট দেখতে। পাহাড়ের ঢালে হওয়ার কারণে চলাচল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন উচ্চতায় মোচড়ানো সরু গলিপথ। এক গলি থেকে অন্য গলিতে যাওয়ার একমাত্র উপায় সিঁড়ি বেয়ে চলা। আমরা যখন গেলাম, ততক্ষণে সব ধরনের দোকান জমে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী খাবারের সুঘ্রাণ সর্বত্র। জিউফেনের ক্ল্যাসিক স্ন্যাকস, তারো বল, মিটবল, রাইস কেকসহ নাম না জানা আরও অনেক কিছুই আছে, যা একবার হলেও স্বাদ নেওয়ার মতো। আমরা অবশ্য খুব বেশি চেষ্টা করলাম না। খাবার ছাড়াও এখানে পর্যটকদের জন্য আছে অ্যানটিক খেলনা, বিশেষ করে তাইওয়ানিজ স্যুভেনির।
শত শত পর্যটক জিউফেনের অলিগলিতে ঘুরছে। আমরাও ঘণ্টা দুয়েক সময় এক গলি থেকে অন্য গলিতে ঘুরলাম। সব শেষে গেলাম বিখ্যাত আইমেই টি হাউসে। এখানে মানুষ গিজগিজ করছে। ভেতরে ঢোকার চিন্তা করাও উপায় নেই। শুনেছিলাম, এই টি হাউসের ওপর ভিত্তি করে একটি বিখ্যাত জাপানিজ ভৌতিক টিভি সিরিজ তৈরি হয়েছিল। তার পর থেকে জাপানিজ পর্যটকদের কাছে এটি প্রিয় একটি গন্তব্য। আসলেই তা-ই। রাতের বেলা টি হাউসটিকে মনে হচ্ছিল ভৌতিক গল্পের কোনো কিছু।
চারপাশ ঘিরে আছে অসংখ্য মানুষ। সবাই ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমরাও ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। তারপর ঘণ্টাখানেক সময় ঘোরাঘুরি করে ফিরে চললাম হোটেলের দিকে।
হোটেলে এসে আয়ান খুব উত্তেজিত। এই প্রথম রাতে বাইরে থাকা হচ্ছে। সে একটু পরপর বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচ্ছে। সাগর কী? এত পানি কোথা থেকে এসেছে? পানি কি খাওয়া যায়? কেন যায় না ইত্যাদি। তিশা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে সব উত্তর দিচ্ছে। সারা দিনের ধকলে তৃষা আর আয়ান দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ল। আমি একা চুপচাপ বেলকনিতে বসে আছি। সামনে সাগরের জাহাজগুলো থেকে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। পাশের পাহাড়গুলো থেকেও আসছে মিটিমিটি আলো। হোটেলের সামনের খোলা জায়গা এক কাপলকে দেখলাম। তাঁরা সাগরমুখী হয়ে বসে আছেন। মাঝরাতে আর কাউকে দেখতে পেলাম না। ওপরে মেঘবিহীন পরিষ্কার আকাশে গুটিকয় তারা জ্বলজ্বল করছিল। সব নিশ্চুপ। তবে মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছিল নিশাচর পাখির ডাক। কী পাখি, জানি না। একটা মৃদুমন্দ বাতাস আসছিল। পাহাড় আর সাগরছোঁয়া উত্তরের হিমশীতল বাতাস। বসে থাকতে থাকতে মাথায় একটা গল্পের প্লট ঢুকল। কবে লিখব জানি না। তবে লিখব কোনো একদিন।
বেশ রাত করে বিছানায় গেলাম। তারপরও ভালো ঘুম হলো না। ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভাঙল। ফজরের নামাজ শেষ করে বেলিকনিতে কফি নিয়ে বসলাম। দিগন্তরেখা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। পাশের কিলাং পর্বতের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন অপার্থিব এক মায়া নিয়ে ডাকছে। সকাল সাতটার দিকে একা একাই বের হয়ে গেলাম। চললাম কিলাং মাউন্টেনের দিকে। ২ হাজার ৯৭০ ফুট উচ্চতার এ পর্বতে ওঠার জন্য পাথর বসিয়ে রাস্তা করা আছে। গুগলে নেভিগেশন অন করে প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটার পর হাইকিং ট্রেইলটা খুঁজে পেলাম। দেখলাম, বিভিন্ন বয়সের মানুষ হাইকিং করতে যাচ্ছেন। দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। আমিও চললাম চূড়ার দিকে। ট্রেইলটি কখনো হালকা খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠেছে। আবার কখনো ঠিক ৪৫ ডিগ্রি কোণ বরাবর। সহযাত্রী হিসেবে পেলাম একজন বয়স্ক মানুষকে। কোথা থেকে এসেছি, জিজ্ঞাসা করলে জানালাম, মংজালা (বাংলাদেশ)। তিনি উত্তরে বললেন, ওহ ঢাকা, ঢাকা! ঢাকা শব্দটি দুবার বললেন। উনার সঙ্গে কথাবার্তা বেশিক্ষণ এগোনো গেল না। আমার চায়নিজ আর উনার ইংরেজি ভাষাজ্ঞান একই লেভেলের।
যাহোক, ঘণ্টাখানেক সময় হাইকিং করে চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। ততক্ষণে শরীর ঘেমে একাকার। তবে সব কষ্ট মুহূর্তেই উবে গেল। ওপরের দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। পর্বতটির অবস্থান সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হওয়ায় সৌন্দর্যের তীব্রতা যেন আরও প্রকট হয়েছে। একদিকে দিগন্তছোঁয়া সাগরের নীল জল। দূরের ছোট দ্বীপ। চারপাশ কুয়াশার মতো ঘিরে ধরা মেঘ। অপর দিকে পাশের ঢালে পুরো জিউফেন শহরের দৃশ্য। সবকিছু মিলিয়ে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর দৃশ্য।
দেখলাম, মেঘ ধীরে ধীরে আরও ঘন হয়ে যাচ্ছে। তাই বেশিক্ষণ অবস্থান না করে নিচে নামা শুরু দিলাম। নামতে আধা ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগল। তারপর সোজা হোটেলে ফিরে এলাম। ঘড়ির কাঁটায় ততক্ষণে প্রায় ১০টা। নাশতা সেরে কফির মগ হাতে নিয়ে আরেক দফা বেলকনিতে বসলাম। ততক্ষণে পায়ের অবস্থা বেশ কাহিল।
দাঁড়িয়ে থাকাও যেন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শরীর চাঙা করে নিলাম। এবার বিদায়ের পালা। হোটেল ম্যানেজার ট্যাক্সি ডেকে দিলেন। প্রথমে রুইফেং রেলস্টেশনে যাব। সেখান থেকে তাইপেই হয়ে জুনান সিটিতে। ফেরার সময় ট্রেনে বসে ভাবছিলাম পরবর্তী গন্তব্যর কথা। কয়েক মাস পর আবার লম্বা ছুটি আসছে। হয়তো ঘুরতে যাব নতুন এক গন্তব্য। তবে শিফেন জলপ্রপাত, জিউফেন শহরের প্রাণবন্ত লণ্ঠন আলোকিত গলিপথ আর কিলাংয়ের চূড়ায় বসে দেখা নীল সমুদ্রের কথা মনের ভেতর লুকিয়ে থাকবে বহুদিন।
লেখক: বদরুজ্জামান খোকন; পিএচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান