চোরের গলা কেন বড় হয়?
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমরা একটা কাল্পনিক গল্প ফাঁদব। মানে আমি আর গল্পের চরিত্র হাসান মিলে। তবে কাকতালীয়ভাবে বাস্তবের সঙ্গে কোনো চরিত্র মিলে গেলে তার দায় আমাদের কারোরই নয়।
শুরুতেই গল্পের প্রধান চরিত্র হাসানের বিষয়ে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। গ্রামের স্নিগ্ধ প্রকৃতির গভীর মমতায় বেড়ে ওঠা হাসানের মধ্যে একটা সেকেলে ভাব বিদ্যমান। জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করে এসেও তার স্বভাবে ভদ্রলোকদের ভন্ডামিটা জায়গা করে নিতে পারেনি। সামনা–সামনি সাধুকে সাধু এবং চোরকে চোর বলার সৎসাহস তার আছে। তার জন্য যে তাকে বিপদে পড়তে হয়নি ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু এতেও তার স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই স্বভাবের সঙ্গে আপস করতে না পারার কারণেই হয়তোবা তাকে প্রবাসে থিতু হতে হয়েছে। কথায় আছে ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না’। তাই প্রবাসেও দেশের সাধু মানুষের পাশাপাশি ধানের চিটার মতো চোর এসে হাজির হয়েছে। হাসানের সঙ্গে সেসব সাধু এবং চোরেদের সম্পর্ক এবং সংঘাতই এই গল্পের বিষয়বস্তু। অনেকেই হয়তোবা এই গল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থার তুলনা খুঁজে পেতে পারেন। তার দায়ও আমরা নিচ্ছি না। আমরা শুধু গল্পটা বলতে চাই।
হাসানের যেহেতু ঠোঁটকাটা স্বভাব, তাই প্রবাসের হাজারো দল লক্ষাধিক উপদলের কোনোটাতেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সে প্রবাসে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই শুধু যুক্ত। মূল কারণ হলো প্রবাসের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে দেশের সংস্কৃতির চর্চাটা ধরে রাখার চেষ্টা। আর এর সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর মানসিকতার সঙ্গে নিজের মানসিকতার কিঞ্চিৎ মিল খুঁজে পাওয়া। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু একদিন দেশ থেকে ব্যবসায়িক ভিসা নিয়ে আসা একজন যখন সেখানে যুক্ত হলো, তখন হাসানের নিজের সঙ্গে একটা যুদ্ধ শুরু হলো। ভদ্রতার মুখোশ পরে সেই লোককে কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু সে যেহেতু সারা জীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তাই কণ্ঠরোধ করে রাখাও সম্ভব হলো না।
ব্যবসায়িক ভিসার জন্য অস্ট্রেলিয়ান ডলারে পাঁচ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশি টাকায় মূল্যমান প্রায় ৫০ কোটি। তার মানে হিসাব করলে দাঁড়ায় এই লোক তার ভিসার জন্য দেশ থেকে ন্যূনতম ৫০ কোটি টাকা পাচার করেছে। হাসান মনের প্রশ্ন তখন আর লুকিয়ে রাখতে পারল না।
একদিন আলোচনাবশত সেই লোককে সরাসরি চোর বলেই বসল। তখন সেই লোকের আসল চেহারা বেরিয়ে এল। বলল, আপনি আমাকে চেনেন, জানেন আমি কী করতে পারি? বাংলাদেশে এই ধরনের কথা শোনা যায় রাজনীতিকদের কাছ থেকে। এখানে আমরা একটু দেশের থেকে ঘুরে আসি। দেশের আড্ডার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হচ্ছে দেশের আকণ্ঠ নিমজ্জিত দুর্নীতি। হাসান তার অভিজ্ঞতায় দেখেছে দেশকে যদি একটি শরীরের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে দুর্নীতিটা সেই শরীরে ক্যানসারের মতো বাসা বেঁধেছে। আর যেটা হয় ক্যানসারের কোষ যেমন দিনে দিনে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, ঠিক তেমনি দুর্নীতিও ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে এখন পুরো সমাজব্যবস্থাকেই গ্রাস করে নিয়েছে। দেশ ছাড়ার আগে তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে লিখেছিল, একটা শরীরের সব দূষিত রক্ত বের করে দিয়ে যদি নতুন করে বিশুদ্ধ রক্ত প্রবেশ করানো যেত তাহলে হয়তোবা এই অসুখটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত, কিন্তু সেটা করতে গেলে শরীরটা আর জীবিত থাকবে না।
যা–ই হোক, আমরা গল্পে ফিরে আসি। সেই লোক বলল, জানেন আমি কি ভিসায় এ দেশে এসেছি। এই ভিসা আপনার বাপও কোনো দিন পাবে না। হাসান তার সহজ বুদ্ধিতে একটা হিসাব কষল। ব্যবসায়িক ভিসার জন্য অস্ট্রেলিয়ান ডলারে পাঁচ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশি টাকায় মূল্যমান প্রায় ৫০ কোটি। তার মানে হিসাব করলে দাঁড়ায় এই লোক তার ভিসার জন্য দেশ থেকে ন্যূনতম ৫০ কোটি টাকা পাচার করেছে। হাসান মনের প্রশ্ন তখন আর লুকিয়ে রাখতে পারল না। জিজ্ঞাসা করল, ভাই আপনার এই এত টাকার উৎস কী? উত্তরে বলল, আমার বাপ–দাদারা জমিদার ছিলেন? তখন সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোন জমিদারের বংশধর যদি একটু বলতেন। তখন আর সেই লোক কোন সুদুত্তর দিতে পারেনি।
এরপর সেই লোক বলল, আসলে আমি বেতন জমিয়ে সেই টাকা দিয়ে ভিসা করিয়েছি। তখন হাসান বলল, বাংলাদেশে এমন কোনো চাকরির খবর তো আমার জানা নেই ভাই, যেখানে বছর বিশ ত্রিশেক চাকরি করলে এত টাকা জমানো যায়। এরপর সেই লোক বলল, না মানে আমাদের পারিবারিক ব্যবসা আছে, সেখান থেকে টাকা জমিয়ে। টাকার উৎস যা–ই হোক টাকাটা তো বাংলাদেশের। হাসান সহজভাবে সেটাই হিসাব করল আর মনেকরার চেষ্টা করল নিজের ভিসাতে কত টাকা লেগেছিল। তার যত দূর মনেপড়ে পুরো পরিবারের ভিসা করাতে তার সর্বসাকুল্যে তিন হাজার ২০ ডলার লেগেছিল। এর পর থেকে হাসান সেই লোককে মোটামুটি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করল। কিন্তু যেটা হয় একই প্রতিষ্ঠানে আনাগোনার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। কখনো দেখা হলে হাসান সামান্য কুশল বিনিময়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছিল।
কিন্তু হাসান অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, যাদের সঙ্গে সে এত দিন ওঠাবসা করে এসেছে, যাদের সে মোটামুটি সৎ মানুষ হিসেবেই জেনে এসেছে সেই মানুষগুলো তাকে তোষণ করতেছে রীতিমতো। এটা হাসানকে খুবই অবাক এবং আহত করল। তখন হাসান বুঝতে পারল, আসলে সবাই দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেও কেউই দুর্নীতিবাজকে সামাজিকভাবে বয়কট করার পক্ষে না। বরং তার কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের পক্ষে। কিন্তু হাসান বুঝে উঠতে পারছিল না প্রবাসে তো সবাই স্বনির্ভর। তাহলে সেখানেও কেন এই দ্বিচারিতা। তখন একজন বলল, আসলে আমরা সহাবস্থানের পক্ষে। কোন ভেদাভেদ করার পক্ষে নই। এটা শুনে হাসান খুবই অবাক হলো।
আরেকজনকে দেখা গেল দুনিয়ার সব অন্যায়–অনাচার নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে। ট্রাম্প একজন চরম উন্মাদ। মোদি একজন ঘোর কট্টরপন্থি। কিন্তু বাংলদেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া অনির্বাচিতভাবে টানা শাসন চালিয়ে যাওয়া সরকার উদারপন্থী। আবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খিল্লি করতে ওস্তাদ আরেকজনকে দেখা গেল সেই দুর্নিবাজের সঙ্গে দুর্নিবার আড্ডায়। এগুলো হাসানের চোখে পুরোপুরি ভণ্ডামি বলে ধরা দিল। এরপর হাসান সিদ্ধান্ত নিল যে তাকে বাকি জীবন আসলে একঘরে হয়েই থাকতে হবে। কারণ, সত্যি কথা বলার বিপদ অনেক।
সেই দুর্নীতিবাজ দিনে দিনে তার ডালপালা ছড়িয়ে অতিকায় বটবৃক্ষের রূপ নিচ্ছে। সে অস্ট্রেলিয়া এসেই প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার সব বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছে, হয়তোবা আগে থেকেই ছিল। এখানে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের কিছু বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু বাস্তবতা একটু ভিন্ন। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় বাংলাদেশি কমিনিটিতে যে মানুষটার অবস্থান সবচেয়ে নড়বড়ে, যার কোনো আর্থিক এবং সামাজিক ভিত্তি নেই, নির্দিষ্ট কোনো কাজও সে করে না তারাই রাজনীতিতে যোগ দেয়। আর যেহেতু দিনে দিনে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাই তারা দল থেকে মনোনয়ন পায় এবং নির্বাচিতও হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজন বিভিন্ন অন্যায্য আবদার নিয়ে এদের কাছে হাজির হয়। আর এমন ভাব করে যেন তাদের এসব সমাধান করে দেয়ার ক্ষমতা আছে। এটা ঠিক যেন বাংলাদেশের একটা খণ্ড প্রতিচ্ছবি।
যা–ই হোক কানাডার বেগমপাড়া নিজ গুণেই বিখ্যাৎ। সেটা নিয়ে বহু গালগল্প প্রচলিত আছে। এমনকি তার ওপর ভিত্তি করে নাটক নির্মাণ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতেও এমন বহু মানুষ ব্যবসায়িক ভিসায় এসেছে। পল্লী বিদ্যুতের কোটিপতি মিটার রিডার না কি সিডনির কোনো শহরেই থাকে। হাসানের সাবেক অফিস স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মেলবোর্নের কোথাও থাকে। হাসানের ক্যাম্পাস জীবনের পরিচিত একজন সন্ত্রাসীও থাকে অস্ট্রেলিয়াতেই যার হাত ধরে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস একটা অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এরা সবাই প্রবাসে এসে বহাল তবিয়তেই আছে।
হাসানকে যে বিষয়টা সবচেয়ে অবাক করে সেটা হলো এই সব মানুষের পরিচয় জানার পরও কেন প্রবাসীরা তাদের তোষণ করে। সামাজিকভাবে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের কেন পুনর্বাসন করে। প্রবাসে সবাই মোটামুটি একটা শিক্ষা অর্জন করেই নিজ পায়ে দাঁড়ায়, তাহলে কেন এসব দুর্নীতিবাজ মানুষদের তোষণ করা। এটা কি শুধু সহাবস্থানের দোহায় না কি এর বীজ আমাদের মনের আরও অনেক গভীরে সুপ্ত অবস্থায় আছে। হাসানভাবে সমস্যাটা আসলেই তারই। তাকে তো আর দুনিয়ার সব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়নি। আবার ভাবে আমি কেন আমার অবস্থান থেকে এগুলোকে প্রতিরোধ এবং বর্জন করব না। তার সবচেয়ে খারাপ লাগে নিজেদের উদারমনা, সংস্কৃতিমনা, আধুনিক বলে পরিচয় দেয়া মধ্যবিত্তরাও যখন এসব স্বপ্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের তোষণ করে।
হাসান তার ছোটবেলায় দেখেছে গ্রামে কোনো চোর ধরা পড়লে সে সারাক্ষণই মাথা নিচু করে রাখে। শত আঘাতেও আহা উহু করে না। চুরিটা কিন্তু খুবই সামান্য ছিল। হয়তোবা কারও ঘরে পরিশ্রম করে সিঁধ কেটে সামান্য হাড়িপাতিল চুরির মতলব ছিল। চুরিটা হয়তোবা সে পেটের দায়েই করতে গিয়েছিল, তবু তার চোখেমুখে সে কি ভীষণ লজ্জা। ছোটবেলায় হাসান এসব চোরদের প্রতি এক ধরনের মমতা বোধ করত। এ ছাড়া তাদের পাড়ায় একজন সরকারি অফিসের কেরানি ছিল যিনি অনেক টাকার মালিক হয়েছিলেন। তার সঙ্গে একই মসজিদে নামাজ পোড়া হতো। সে দেখতো গ্রামের মানুষ সেই কেরানিকে ঠিক কীভাবে এড়িয়ে চলতো এবং সুযোগ পেলেই তাকে চোর আখ্যা দিতে ভুল করত না। এটা সেই ব্যক্তিও জানতো এবং সব সময় একটু জড়োসড়ো হয়েই থাকত।
সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে চোরদের সামাজিক অবস্থানও পরিবর্তিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দুর্নীতিবাজদের অনেক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তাদের দুর্নীতি হাজার, লক্ষ, কোটি ছাড়িয়ে হাজার হাজার কোটিতে রূপ নিয়েছে। এবং তারা সেই টাকা দেশে না রেখে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। ইতোমধ্যেই কানাডার বেগমপাড়ার কথা খুবই প্রচলিত। ইংল্যান্ডেও নিশ্চই এমন অনেক বেগমপাড়া তৈরি হয়েছে। আর এখন হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াতে। এসব মানুষেরা জানে টাকাই তাদের শক্তির উৎস হোক, সেটা অন্যের হক মেরে দুর্নীতি করে আয় করা। আর এই টাকার কারণেই সমাজের সবার মুখও বন্ধ হয়ে আছে। তাই এসব চোরেদের গলার স্বর এখন দেশ ছাড়িয়ে প্রবাসেও উচ্চকিত। হাসান জানে না এর থেকে আসলে কীভাবে মুক্তি মিলবে।