অকৃতজ্ঞ

খড়ের পালাছবি: লেখক

চল যাব তোকে নিয়ে এই নরকের অনেক দূরে
এই মিথ্যে কথার মেকি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে...
নরম মনের মানুষদের মন খারাপ হতে বা মন ভালো হতে তেমন যুক্তিসংগত কারণ লাগে না। পৃথিবীর সবকিছুই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তাদের মনকে ছুঁয়ে যায়। তারা যেমন খুবই সুখি, আবার চাঁদের অপর পিঠের অন্ধকারের মতো তারা খুবই দুখী। পৃথিবীর সব মানুষের দুঃখকে তারা মনে করে নিজের দুঃখ এবং তারা দুঃখিত হয় হয়তো প্রকৃত দুখী মানুষটার থেকেও বেশি। পৃথিবীর সব মানুষের সুখ তাকে সুখী করে এবং তখন নিজেকে তারা মনে করে সবচেয়ে সুখী মানুষ। সুখের কারণগুলো মাঝেমধ্যে এত ঠুনকো হয় যে সেটা অন্যান্য মানুষের হাস্যরসের খোরাকে পরিণত হয়। তাই সুখের কারণের অন্ত নেই। কিন্তু দুঃখের কারণগুলোই বেশি ভোগায়, ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয়, তুমি একজন পলাতক। তুমি এ দেশটার মাটির মানুষগুলোর জন্য কিছুই করোনি।

বছর বছর ধরে চলে আসা গরুর দুগ্ধ সংগ্রহ চলে এভাবে
ছবি: লেখক

শৈশবের যে ছেলেটার সঙ্গে পুকুরে একসঙ্গে লাফালাফি, মার্বেল খেলা, জাম্বুরা চুরি করতাম, সেই ছেলেটা ভাগ্যের ফেরে আজ সামান্য মুদিরদোকানদার। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিয়ে করতে পারছে না। কারণ, বিয়ে করতে গেলে যে বিরাট খরচা। তারপরও সে বেশ সুখেই আছে। একেবারেই ছোট একটা দোকান। সেটাতে ভর করে তাঁর ভালোই চলে যায়। এখানে ভালো চলে যায় বলতে ভালো থাকাকে বোঝানো হয়েছে, সুখে থাকাকে নয়। মুখ ফুটে কখনো বলবে না যে ওর কিছু টাকা লাগবে, কিন্তু আমি জানি, সমস্যাটা কোথায়? টাকার জোগাড় নেই বলেই সে বিয়েটা করছে না। সামান্য কিছু টাকা হলে দোকানে আরও কিছু মাল তুলতে পারবে, সেই সঙ্গে বিয়েটাও করতে পারবে।

বছরের পর বছর ধরে চলে আসা পুকুর সেচে চলছে মাছ শিকার
ছবি: লেখক

কত মানুষ কত ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত। কেউ বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে, কেউ অর্থ সংগ্রহ করে গ্রামবাসীর জীবনমানের উন্নয়ন করছে, কেউ গরিব-মেধাবী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এসব কাজগুলো দেখলে কি যে ভালো লাগে। কিন্তু দুঃখ হয় তাদের সঙ্গে অংশ নিতে না পেরে। খুব ইচ্ছা করে, আমিও তাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মানুষের জন্য কিছু করি। অন্তত একজন মানুষের জীবনের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে কিছুটা অন্তত অবদান রাখি। কিন্তু বাস্তবতা খুবই কঠিন। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় খবর আসে, কত শত গরিব মানুষের ছেলেমেয়ে অনেক ভালো করছে বিভিন্ন বিষয়ে, কিন্তু সামান্য অর্থের অভাবে আর সামনে এগোতে পারছে না। তখন খুবই অসহায় লাগে নিজেকেই নিজের কাছে।

গ্রামীণ চাষাবাদ
ছবি: লেখক

যে গ্রামে জন্ম নিলাম, সেই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। পরবর্তী এক শ বছরে আসবে, এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, সেটা চর এলাকা। নদী তার আপন খেয়ালে গড়ছে, আবার কোনো এক দিন সেটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে গ্রাস করে নেবে। আলো না থাকলে মানুষ যেমন অন্ধকারে থাকে, ঠিক তেমনি গ্রামের মানুষগুলোকে দেখেছি কত অন্ধ-কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। তিনবেলা পেটের খাবার জোগাতেই অভিভাবকদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবার মতো দিনমজুর বা জোগালির কাজ শুরু করে। মেয়েদের একটু বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টা নদী গ্রাস করে নেওয়ার পর আবারও সেটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানেই চলে গ্রামের ছেলেমেয়দের নিবু নিবু শিক্ষা কার্যক্রম। ভালো শিক্ষকের অভাবে পড়াশোনাটা হয় একেবারেই দায়সারাভাবে।

চাতাল থেকে ধানের চারা তোলা
ছবি: লেখক

যাহোক, খুব ইচ্ছা করে ওর দুঃখগুলো দূর করে দিই। কিন্তু সেটা করতে গেলে তো অর্থের দরকার। আমি যা সামান্য আয় করি, তা দিয়ে আমার ছোট সংসারটা চলে যায়। কিন্তু যেহেতু বাড়তি বা উপরি আয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই সাহায্য করারও মুরোদ নেই। শুধুই মনে মনে ভাবা আর দুঃখবিলাসী জীবনযাপন। সরকারি চাকরি করে আমি ভালোমতোই সাহায্য করতে পারতাম, যদি চলার পথে সামান্য একটু ইনক্লাইন্ড হতাম। অথবা আমি যদি মেধাসম্পন্ন কোনো কেউকেটা হতাম, তাহলে একটু বাড়তি উপার্জন করে সেখান থেকে সাহায্য করতে পারতাম। অথবা একটা দানবাক্স খুলে বসতে পারতাম তারপর সবার কাছে সাহায্য চাইতাম, তারপর সেখান থেকে জনে জনে বিলাতাম। কিন্তু আত্মসম্মানের ভয়ে সেটাও পারি না। তখন ইচ্ছা করে পালিয়ে যাই কাচের দেয়ালের এই শহর ছেড়ে। কোনো গ্রামে গিয়ে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। আর পাশাপাশি করব কৃষিকাজ, যেখানে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় থাকবে না। আর অবসরে পড়াব গ্রামের গরিব-মেধাবী ছেলেমেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে। কিন্তু করা হয় না কিছুই। আবার শুরু হয় আক্ষেপের আরও একটা নতুন দিন:
রোজ ঘুম থেকে ওঠা আর দাঁত মাজা,
খবর কাগজে দুঃসংবাদ খোঁজা।
দারুণ ব্যস্ততায় স্নান-খাওয়া সারা হয়,
জীবনে আরেক দিন আবার বাড়তি হয়।

শীতকালের সাঁজাল তাপানো
ছবি: লেখক