নমি তোমায়, হে তারুণ্য
‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।’
সেই কবে কবিগুরু লিখে গিয়েছিলেন ওপরের চরণগুলো। বাংলাদেশের গত তিন সপ্তাহের কর্মযজ্ঞের পর বারবার এ চরণগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। একটা আধমরা, জংধরা সমাজকে আমাদের তরুণেরা যেন সত্যিকার অর্থেই ঘা মেরে বাঁচিয়ে তুলল। ঘুণে ধরা দেশের সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করে দিল। এই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল অত্যন্ত সংগঠিতভাবে। এরপর দিনে দিনে সেটা আরও তীব্র হলো। এরপর সেটা এক দফা এক দাবিতে রূপ নিল। তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এরপরও তরুণেরা বিজয়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে অত্যন্ত দায়িত্বশীলভাবে দেশ পুনর্গঠনের কাজ করে যাচ্ছে। এ তরুণদের সশ্রদ্ধ সালাম জানাতেই আজকের লেখা। পাশাপাশি তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার একটা সুযোগ তৈরি করা।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ তিন বছর এবং ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যাদের জন্ম, তাদের বলা হচ্ছে ‘জেনারেশন জেড’ বা সংক্ষেপে ‘জেন-জি’। একই সঙ্গে তাদের আই-জেনারেশন, জেন টেক, নেট জেন, জুমার্সসহ আরও নানা নামে ডাকা হয়, কারণ তারা বড় হয়েছে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সম্পৃক্ততায়। সেই সময়কালে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকের বয়স এখন ১২ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। এর আগের প্রজন্ম হলো মিলেনিয়াল জেনারেশন। তাদের সংক্ষিপ্ত নাম ‘জেন-ওয়াই।’ আর তারও আগের প্রজন্মের নাম জেনারেশন এক্স। এই তালিকারই ক্রম অনুযায়ী ‘জেড’ বা ‘জি’ এসেছে, যে নামটি এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিভিন্ন দেশেই এখন তরুণদের বয়সভিত্তিক পরিচয় বোঝাতে ‘জেন-জি’ ঘরানার শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ প্রজন্ম হলো প্রকৃত ডিজিটাল প্রজন্ম। এর আগের প্রজন্ম ইন্টারনেটের উত্থান দেখলেও তারা ডিশ কেব্ল সংযুক্ত টেলিভিশন দেখেছে, ল্যান্ডফোনও ব্যবহার করেছে। কিন্তু জেন-জি গোত্রের অধিকাংশই বড় হয়েছে একধরনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সময়ের মধ্য দিয়ে। জেনারেশন জেডের সদস্যরা আগের প্রজন্মের চেয়ে বেশি বাস্তববাদী এবং অল্প বয়সে দ্রুত পরিপক্ব। এ প্রজন্মের মধ্যে ক্যারিয়ার নির্ধারণে সতর্কতা, শিক্ষা বা ডিগ্রি অর্জনের হারও বেড়েছে, যেটি তাদের মধ্যে এখন অনেক বেশি সচেতনতা তৈরি হওয়ার কারণ। তবে জেন-জির সদস্যরা ক্যারিয়ার–সচেতন হওয়ার আরও একটি কারণ হতে পারে, আগের প্রজন্মের মধ্যে আর্থিক সমস্যা ও কর্মসংস্থানে অস্থিরতাসহ নানা সমস্যা দেখে বড় হওয়া। সবশেষে কোভিড মহামারিও এই প্রজন্মকে নতুন করে প্রভাবিত করেছে।
এ তো গেল জেন-জির মনস্তাত্ত্বিক গঠনের তত্ত্ব। এবার গত তিন সপ্তাহের ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। একটি দেশের সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর বিপরীতে গিয়ে সুসংগঠিত একটি আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সেটাকে পরিণতি দেওয়া চাট্টিখানি কথা না। যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের ভাবনাতেও ছিল না বয়সে তরুণ এসব ছাত্রছাত্রী তাদের পতন ঘটাতে পারবে। তাই তারা এ আন্দোলনকে শুরু থেকেই কটু বাক্যবাণে জর্জরিত করেছে। সোজা কথায় বললে, সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করে এসেছে। ব্যাপারটা এমন, কত আন্দোলন এল–গেল, আর তোমরা আমাদের টিকিটিটাও বাঁকা করতে পারবে না। তোমরা সারা দিন কম্পিউটার আর মোবাইলে ডুবে থাকো। তোমরা রাজপথের আন্দোলনের কী বুঝবে।
সত্যি কথা বলতে আজ আর দ্বিধা করছি না। এমন একটা ধারণা আমার নিজেরও ছিল। এ প্রজন্মের তরুণদের দেখতাম আর মনে মনে বলতাম, আমাদের প্রজন্মই ভালো ছিল। কারণ, আমরা বেড়ে উঠেছিলাম প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন সবে মোবাইল ফোন এল। এরপর একে একে এল ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আমরা তাই বলতাম, আমরা অ্যানালগ যুগের মানবিকতা আর ডিজিটাল যুগের আধুনিকতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক চৌকস প্রজন্ম। আমার ভাগনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই হিসেবে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ছেলেমেয়ের বয়সী। আমরা সব সময় ওদের মূল্যবোধ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতাম। কিন্তু আমি যে কতখানি ভুল ছিলাম, সেটা গত কয়েক দিনে প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রথম নিজে ভুল প্রমাণিত হয়েও জেন-জির জন্য গর্বে বুকটা ভরে উঠেছে।
কোটাব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন থেকে এক দফার আন্দলোন এবং অবশেষে সরকারের পতন। কী সূচারুভাবেই না সম্পন্ন হলো। তাদের রুখতে সরকার সেই বহু পুরোনো জং ধরা অস্ত্র আবার ব্যবহার করল। শুরুতে সরকারের পদলেহী ছাত্রসংগঠনকে লেলিয়ে দেওয়া হলো। যখন ছাত্ররা তাদের প্রতিহত করল, তখন নামানো হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী। এরপর যখন জেন-জি’কে থামানো গেল না, তখন নামিয়ে দেওয়া হলো বিজিবি ও সামরিক বাহিনী। এরপরও যখন তাদের থামানো গেল না, তখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেশকে পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত যে কেউ নিতে পারে, এটা কারো কল্পনাতেও ছিল না। ছাত্ররা ইন্টারনেট বন্ধ থাকা অবস্থায় তাদের প্রযুক্তি বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বিকল্প পথে যোগাযোগ করে চলল। কারণ তাদের চেয়ে প্রযুক্তি আর কে ভালো বোঝে।
তবুও তাদের থামানো যায়নি। তাদের প্রতিবাদের মাত্রাগুলো অনুকরণীয়। রাজপথে শুধু নেমেই এল না, সরকারকে জানিয়ে দিল দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না। তারা নতুন নতুন গান বাঁধল।
পাশাপাশি চলল পুরোনো দেশপ্রেমের গানের চর্চা। একদিকে তারা গেয়ে চলেছে—ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি। পাশাপাশি র্যাপ গানের সুরে তারা গান বাঁধল— ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ। রাস্তায় গুল্লি করলো কেডা? আওয়াজ উডা।’
এ তো গেল প্রযুক্তিগত দিক। আমরা এত দিন ভাবতাম, এ প্রজন্মের মধ্যে ভদ্রতা, সভ্যতার অভাব আছে।
কারণ, তারা সারা দিন ল্যাপটপ আর মোবাইল টেপে। আহারে! আমরা কী ভুলেই না ছিলাম। গত কয়েক দিনের আন্দোলনে তাদের বক্তব্য যতই শুনেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি। কী সুন্দর তাদের শব্দচয়ন। কী চমৎকার তাদের বাক্যগঠন। যেখানে যতটুকু বলা দরকার, সেখানে ঠিক ততটুকুই বলছে। আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের মতো মাইক পেয়ে সেটাকে আর ছাড়ছে না, এমনটা হয়নি কখনোই।
তাদের কথাগুলো বারবার শুনেছি। কারণ ছোট ছোট ভাষণগুলো শোনার পর মনে হয়েছে, এটা আরো একটু বড় হলে ভালো হতো। একই মঞ্চে তারা কী চমৎকারভাবেই না সহাবস্থান করছে। একজন কথা বলছে আর অন্যরা মনোযোগী শ্রোতা।
এই প্রজন্মের যে বিষয়টা নিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি উষ্মা প্রকাশ করতাম, সেটা হলো তাদের দেশপ্রেম।
আমরা বলতাম এদের মধ্যে দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও নেই। এরা প্রযুক্তির উৎকর্ষে শুধু নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত। এদের মধ্যে তাই মানবীয় গুণাবলির প্রকৃত বিকাশ ঘটেনি। আহারে! আমরা আসলেই অনেক ভুল ছিলাম। তারাই প্রথম সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চলমান ঠান্ডা যুদ্ধের দেয়াল ভেঙে দিল। আমাদের সময়ে আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ফার্মের মুরগি বলে ঠাট্টা করতাম। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যখন সরকারের পেটোয়া বাহিনী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অত্যাচারে কোণঠাসা, ঠিক তখনই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে এসে একাত্মতা প্রকাশ করল। তাদের যুক্ত হবার পর আন্দোলন যেন নতুন গতি পেল। রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। পাশাপাশি তারা প্রবাসীদেরকেও শামিল করেছে আন্দোলনে।
সশস্ত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপরীতে তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, কিন্তু বুকে ছিল অদম্য সাহস। তারা প্রত্যেকেই যেন ছিল এক একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। পারিপার্শ্বিকতার চাপে জেগে উঠল। আমি এখনো চোখ বন্ধ করলে আবু সাঈদের মুখটা দেখতে পাই। আবু সাঈদের ছবিটার সঙ্গে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ ছবির কত মিল। আবু সাঈদকে দেখে আমার বারবার ভগৎ সিংয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ভগৎ সিংকে বলা হয়েছিল ক্ষমা চাইতে। উত্তরে সে বলেছিল, আমি তো মরতেই চাই, কারণ একজন মরলে লক্ষজন জেগে উঠবে। ভগৎ সিং শহীদ হয়েছিলেন তেইশ বছর বয়সে। আর আবু সাঈদ পঁচিশ বছর বয়সে।
ভগৎ সিংয়ের মতো আবু সাঈদও জন্ম দিয়ে গেল হাজারো আবু সাঈদের। যারা ৫ আগস্ট ঢাকার রাস্তায় নেমে এল। অহংকারী সরকারের পতন হলো। আমি ভেবেছিলাম এরপর ছাত্ররা হয়তোবা থিতিয়ে যাবে। অথবা তাদের আন্দোলন পথ হারাবে। কিন্তু না, তারা এরপর নিজ দায়িত্বে দেশ গড়ার কাজ হাতে নিয়ে নিল। তারা বারবার হুঁশিয়ার করে দিল হানাহানি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। আর কোথাও হানাহানি হলে দলবেঁধে সেটার প্রতিরোধ করতে হবে। সরকার পতনের পর দেশে এখন আইনের শাসন নেই। রাস্তাঘাট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীশূন্য। তাই তারা নিজেরাই নেমে পড়ল রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে। জরুরি সেবার বাহনের জন্য রাখা হলো আলাদা লেন। বাংলাদেশে এটা কেউ কখনো ভেবেছিল।
তারা সরকার গঠনের রূপরেখাও বাতলে দিল। এখন পর্যন্ত তারা সরকার গঠনের যে রূপরেখা দিয়েছে, সেটা গত পঞ্চাশ বছরে কোনো ঝানু রাজনীতিবিদের মাথায় একবারের জন্যও আসেনি। আমরা এখন আশায় বুক বেঁধে ক্ষণ গুনছি। দেশের বিভিন্ন শাখার জ্ঞানী–গুণীজনের সমন্বয়ে একটা জনগণবান্ধব সরকার গঠন করা হবে। এই সরকারের ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।
ছাত্রছাত্রীরা বলেছে, যেটি আমাদের সবারই স্বপ্ন—‘২০২৪ সালে এসে আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যে বাংলাদেশে মিডিয়ার যে ভাইবোনেরা রয়েছেন, তারা সত্যি তথ্যটা সবার সামনে তুলে ধরতে পারবেন; এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যেটি দিয়ে আমরা পুরো বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারব; এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা চাই, যেটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নিশ্চিন্তে নিতে পারবে; এমন একটি বিচারব্যবস্থা চাই, যেখানে যে ধর্মের যে বর্ণের যে রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষ হোক না কেন, নিশ্চিন্তে সত্য একটি বিচার পাবে; এমন একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাই, যেটি আমার আস্থার জায়গা হবে।
আমি অবনত চিত্তে ক্ষমা চাইছি তোমাদের নিয়ে মনে মনে ভুল ধারণা পোষণ করার জন্য। তোমরা আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও নমস্কার গ্রহণ করো। তোমরা নতুন যুগের কান্ডারি। তোমাদের দেখানো আলোর পথে দেশ একদিন সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যাবে বলেই বিশ্বাস। আবারও কবিগুরুর কাছে ফিরে আসি—
‘চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।
সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা,
ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা,
বসন্তেরে পরাস আকুল-করা
আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা,
আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা।’
*মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।