রাজহাঁসের মতো ডানা ঝাপটে সব অপ্রিয়তা ঝেড়ে ফেলা

ছবি: লেখকের পাঠানো

ভালো লাগত বৃষ্টি দেখতে।
সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। সূর্যের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে বর্ষার ঘোরকৃষ্ণ মেঘ আকাশ অন্ধকার করে টানা কয়েক দিন বর্ষণ চালিয়ে যেত। পাহাড়ি এলাকা হওয়ার পরেও শহরের কিছু নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেত। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল, আমাদের বাড়িতে বা সামনের রাস্তায় কখনো পানি উঠত না। পাশেই একটা ছড়া (ছোট খালকে আমরা সিলেটিরা ছড়া বলি) থাকায় সেটাই সব পানি বয়ে নিয়ে যেত। বর্ষাকালে ওই ছোট্ট ছড়া যে পরিমাণ পানি নিয়ে যেত, আমেরিকার বহু নদীতেও সেটা দেখিনি।

ছড়ার পাশে মাঠ ছিল। শীতে ক্রিকেট, বর্ষায় ফুটবল। ফুটবল খেলার প্রথম শর্তই ছিল কাদায় মাখামাখি হতে হবে। তারপরে দলবেঁধে ছড়ার পানিতে গোসল। এদিকে আমি স্পষ্টই দেখছি, পুরো পাড়ার ড্রেনের পানি ছড়ায় এসে পড়ছে। তা ছাড়া এই ছড়ার ধারেই লোকজন নিয়মিত টয়লেট করে। ওই পানিতে আমি গোসল করব?  শুধু এ কারণেই আমি পাড়ার মাঠে অন্য ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে যেতাম না। বাড়ির সামনের মাঠে নিজেরা নিজেরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে খেলতাম।

তা ছাড়া একবার আমাদের ভাড়াটে সেই মাঠে খেলে ছড়ায় গোসলের সময় একটা মরা নবজাতককে ভাসতে দেখেছিল। রটনা ছিল হয়তো জিন সেই বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। এখন মনে হয় ঢাকা শহরের ডাস্টবিনে যে কারণে মাঝেমধ্যে কিছু নবজাতক পাওয়া যায়, সেই একই দুর্ভাগা পরিণতি ওরও হয়েছিল। আহারে! ছোট্ট, অবুঝ নিরপরাধ শিশু। কেয়ামতের দিন ওকে আল্লাহ প্রশ্ন করবেন, ‘কোন অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ শিশুটি কিছুই বলতে পারবে না। ফ্যালফ্যাল করে নিজের খুনির দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজবে।

আমাদের বাড়ির সামনের মাঠটা ডোবায় পরিণত হতো। গোটা বর্ষায় সেখানে পানি জমে থাকত, আর সেই পানিতে অসংখ্য সাপ খেলা করত। নানান জাতের সাপ। তার মধ্যে কয়টা বিষধর ছিল জানি না, তবে সন্ধ্যায় বিনে পয়সায় সাপের খেলা দেখা হতো। শত শত সাপ, ডোবার পানিতে কিলবিল করত। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। সেগুলো ডোবা থেকে উঠে আসত না। ওসব সাপ নিয়ে নানান কুসংস্কার কানে আসত। পাড়ার হিন্দুরা বলত, ওই ডোবার নিচে গুপ্তধন আছে। বহুকাল আগে আমাদের বাড়ি ও সামনের মাঠসহ বিস্তীর্ণ এলাকা বিরাট পুকুর বা দিঘি ছিল। সেখানেই কেউ গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিল। ভরাট হয়ে যাওয়ার পর আজও সাপের দল সেই গুপ্তধনের পাহারায় আছে।মুসলমানেরা বলত ওইসব সাপ হচ্ছে জিন। তাইতো সন্ধ্যার আগে ওদের দেখা পাওয়া যায় না। সন্ধ্যার দিকে ওরা পানিতে কিলবিল করে।

ভালো লাগত বৃষ্টিতে ভিজতে
ছবি: লেখকের পাঠানো
বৃষ্টিতে রিকশায় ভিজতে ভিজতে যাচ্ছি। আমার বউ, তখনকার সহপাঠী, রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয় একেই বিয়ে করবে। কে জানে!
আরও পড়ুন

জিন বা গুপ্তধনের পাহারাদারদের অস্তিত্ব অবশ্য এখন আর নেই। সেই জলাভূমি এক ‘লন্ডনি’ কিনে ফেলার পর সেটা ভরাট করা হয়। আমাদের চোখের সামনেই আমাদের খেলার মাঠ সবজিখেতে পাল্টে যায়। আমরাও অবশ্য ততদিনে বড় হয়ে গেছি। কলেজে পড়তে শুরু করেছি। খেলার সময় তখন অনেক কমে এসেছে। এখন হয়তো সেই মাঠেই বহুতল বাড়ি উঠে গেছে।

আমার বাবার ছিল ভীষণ ঠান্ডার বাতিক। এতটুকু ভিজলেই আব্বুর ঠান্ডা লেগে যেত। শীতে গরম পানি ছাড়া গোসল তো বহুদূর, হাতমুখও ধুতে পারতেন না। আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নিই এমন হওয়া যাবে না।

ছবি: লেখকের পাঠানো

আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম ‘ওয়াটারপ্রুফ।’ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাহাড়ি বৃষ্টিতে ভিজেও কোনোদিন এতটুকু সর্দি হয়নি। বৃষ্টিতে সাইকেল চালাতে মজা লাগত। মজা লাগত রিকশায় বসে হুড নামিয়ে দিতে। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যেত জামাকাপড় আর মন। মাঝেমধ্যে কিছু রিকশাওয়ালা অফেন্ডেড হতো। ওর কাস্টমার ভিজে ভিজে যাচ্ছে, এটা ওর বিজনেসের জন্য ভালো রেপুটেশন নয়। লোকে ভাবতে পারে ওর বুঝি ‘পানি-কাপড়’ নেই। জোর করত ‘পানি–কাপড়’ জড়াতে। ওকে আশ্বস্ত করতে হতো যে লাগবে না, আমি ঠিক আছি এবং আমার ভালো লাগছে।

এমনই এক বৃষ্টির দিনে রিকশায় ভিজতে ভিজতে যাচ্ছি। আমার বউ, তখনকার সহপাঠী, রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে আমাকে ওই অবস্থায় দেখে। হয়তো সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নেয় এই ছেলেকেই সে একদিন বিয়ে করবে। কে জানে!
ভালো লাগত বৃষ্টিতে হাঁটতে। রাস্তায় পানি জমছে কিন্তু ফুটপাথে উঠে আসছে না, এমন রাস্তায় ঝুম বৃষ্টির দিনে হাঁটার মজাই আলাদা। বেঁচে থাকার আনন্দ টের পাওয়া যায়।
কিংবা ছাদে। ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছে, ছাদে পানি জমে গেছে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। এই অবস্থায় ভেজার মজাই আলাদা।
কিংবা মাঠে, কাদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল খেলতে। ছড়ায় ময়লা পানিতে গোসল না করলেই হলো।

আরও পড়ুন
ব্লার্ব: ‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

হাঁসের দল নেমে আসত আমাদের সঙ্গে। বৃষ্টির দিনে ওদেরও আনন্দ। মনের আনন্দে ঝিনুক, শামুক খেয়ে বেড়াত। আর রাজহাঁসগুলোর তো চালচলনই ছিল রাজকীয়। এককালে কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসাতাম। বৃষ্টির ফোঁটায় বা পানিতে কাগজ ভিজে নেতিয়ে যেত। টিনের স্পিডবোট পাওয়া যেত। যার সেটা ছিল, সেই বন্ধু মহলের সবচেয়ে ধনী। বাকিরা সবাই ওকে ঈর্ষা করতাম। আমি কাগজের স্পিডবোট বানাতে পারতাম। আমার আরেক বন্ধু কাগজের পালতোলা নৌকা। শৈশবের ক্রিয়েটিভিটি ছিল ভিন্ন মাত্রার।

পাড়ার বহু ছেলেকে দেখতাম গামছা বা শাড়ি দিয়ে টিলা থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল থেকে মাছ ধরছে। সারা বছর সেসব ড্রেন শুষ্ক থাকে। বর্ষার টিলার ওপরের পানি নিচের দিকে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই পানিতে মাছ কোত্থেকে আসত, আজও মাথায় ঢোকে না। কিন্তু নিজের চোখেই দেখেছি ওদের মাছ ধরতে। ছোট ছোট পুঁটি মাছের মতো মাছ।

বৃষ্টি আসা মানে অবধারিতভাবেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়া। চার্জ লাইটের আলোয় পড়তে বসা। দেয়ালে আলো–ছায়ার রহস্যময় খেলা আর বাইরে বৃষ্টির কনসার্ট। বর্ষায় বাংলাদেশ কী অপার্থিব সুন্দর!

টেক্সাস খরার জন্য কুখ্যাত। টেক্সাসের অবশ্য সবকিছুই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে থাকে। যখন গরম পড়বে, তখন অনেক গরম। ঘাস পুড়িয়ে দেবে, মাটি ফাটিয়ে দেবে। যখন শীত পড়বে, বরফ না পড়লেও একদম হাড্ডিতে গিয়ে খামচে ধরবে এমন কনকনে ঠান্ডা শীত।

আর যখন বৃষ্টি নামবে, অতি অল্প সময়েই এত বড় ফোঁটায় এত ঘন হয়ে নামবে যে যদি আমাদের ঢাকা শহরে এমন বৃষ্টি নামত, তাহলে রাজধানী তিন হাত পানির নিচে তলিয়ে যেত।

বৃষ্টি যত ঘন হয় তত মজা। তবে এখানকার বৃষ্টির সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকায়। ভয়টা সেখানেই। যদিও বাজ পড়ার জন্য ফ্লোরিডা কুখ্যাত।

আমার বাচ্চাদের বৃষ্টিতে ভেজার কথা যখন বলি, দুজনই তখন এমনভাবে না করল যেন কোনো তিতা ওষুধ খেতে বলছি। বড়টা বলল বৃষ্টির দিনে বাইরে বেরোতে নেই, আর ছোটজন বলল বৃষ্টির পানি অনেক ঠান্ডা হয়ে থাকে। ভিজলে অসুখ করবে, ওকে হসপিটাল যেতে হবে।

দোষটা ওদের নয়। ওরাই স্কুলে এসব আজেবাজে জিনিস শিখেছে। ওদের আনন্দ হচ্ছে সুইমিংপুলে সুইম করা, বা স্প্ল্যাশ পার্টি। সেখানে পানি একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় থাকে। ঠান্ডা লাগে না।
আমি বললাম আমিও ভিজব ওদের সঙ্গে।
তারপরও রাজি হচ্ছিল না।
কিন্তু যেই মুহূর্তে বৃষ্টি তার প্রথম ফোঁটা দিয়ে ওদের স্পর্শ করল, আমার ছোট ছেলে বলল, ‘বাবা, এ তো খুবই মজার!’

বড়জন কিছু বলাবলিতে নেই। সে ততক্ষণে রাস্তায় নেমে পড়েছে। খালি পায়ে ছুটছে জমে থাকা পানির দিকে। লাফালাফি করছে। ভেজা কাদা গায়ে মাখছে। প্রকৃতির সঙ্গে মেশায় এত আনন্দ!

আহা, আমি যদি ওদেরকে বাংলাদেশের বর্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি! আমাদের সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। দিনের পর দিন চলা অবিরাম, অবিশ্রান্ত বারিধারা। ব্যাঙের ডাক, ডোবায় সাপের খেলা, পাড়ার ছেলেদের ছোট ছোট মাছ ধরা। কাদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল খেলা, কেউ রোনালদো, কেউ মেসি-ম্যারাডোনা! রাজহাঁসের মতো ডানা ঝাপে সব অপ্রিয়তা ঝেড়ে ফেলা।

রিকশায় হুড নামিয়ে ভিজতে ভিজতে শহর দেখা। রাস্তায় পানি জমে থাকবে, সেই পানি কেটে এগিয়ে যাবে গাড়ি, বাস, সাইকেল-রিকশা। ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে বাউন্ডারি দেয়ালে।

কিংবা ঝুম বৃষ্টিতে কেবলই হাঁটা। প্রিয় কারোর হাত ধরে ভিজতে ভিজতে বহুদূর হেঁটে যাওয়া।