রেলযাত্রা

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সপরিবারে লেখকছবি: লেখকের পাঠানো

বাংলাদেশে আমার শৈশবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি ট্রেনযাত্রার স্মৃতি।

সিলেট–চট্টগ্রামের রুট ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে মনোরম রেলরুট এবং আমার প্রতিবছরই সেই রুটেই যাত্রা হতো। ‘পাহাড়িকা এক্সপ্রেস’ ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ট্রেন।

চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী এলাকা, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির পাহাড়ের চূড়ায় লেখা উন্নত মম শির! সেই স্মৃতি স্মরণ করে লিখতে গিয়েও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। শুধু ওই বাক্য দেখেই সেই বয়সে ইচ্ছা হতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে। ওই জলপাইরঙা ইউনিফর্ম, ভারী বুট, ছোট করে ছাঁটা চুল আর ডিসিপ্লিনড জীবন—কে না আর্মি অফিসার হতে চাইত?

ট্রেনে বসেই গাছের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বঙ্গোপসাগর, সাগরে ভাসমান বিশাল জাহাজ দেখতে পাওয়া, শ্রীমঙ্গলের ঘন জঙ্গল ও সুসজ্জিত চা–বাগানের ভেতর দিয়ে ট্রেনের ছন্দময় তালে ছুটে চলা; মাঝেমধ্যে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাহুতসহ হাতির দেখা মিলত। তখন মনে হতো বাংলাদেশের চেয়ে সবুজ দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

কিছুক্ষণ পরপর ট্রেন যেত একের পর এক নদীর ওপর দিয়ে। নদীর ওপর ভাসমান নৌকা। স্টিমার। লঞ্চ। নদীতে গোসল করতে আসা গ্রামীণ শিশুদের আনন্দময় উচ্ছ্বাস। নদীর জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব।

আমাদের দেশের মানুষেরা কি জানে এত বিশাল বিশাল নদী পৃথিবীর মোটামুটি কোনো দেশেই নেই? আমেরিকার নদীগুলোকে দেখলে আমার খুব বেশি হলে খাল বলে ভ্রম হয়। অথচ এই খালসদৃশ নদীগুলোর পাশেই উন্নত শহর সভ্যতা গড়ে উঠেছে! আমাদের দেশের মতো এমন বড় বড় নদী ইউরোপ আমেরিকায় পেলে তাদের ইকোনোমি আরও বহুগুণ বেড়ে যেত। বিদেশে এসে উপলব্ধি করেছি, প্রকৃতি দুই হাত ভরে আমাদের শুধু দিয়েছেই। আমরাই সেই সম্পদ ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারি না।

যেখানে বন–জঙ্গল বা নদী নেই, সেখানে থাকত সবুজ ধানের খেত। কৃষক মহিষ ও গরু নিয়ে লাঙল বাইত। কাউকে কাউকে দেখতাম ঘোড়া দিয়ে সেই কাজ করতে। পুকুর বা ডোবা জলে বিশাল বিশাল কালো মহিষ শরীর ডুবিয়ে মাথা ভাসিয়ে ঝিমাত। কিছু সাহসী পাখি সেই বিশাল প্রাণীর শিংয়ে বা পিঠে বসে খুঁটে খুঁটে হয়তো পোকামাকড় খেত। আমরা শহুরে ছেলেপিলে এসব দৃশ্য দেখেই মুগ্ধ হতাম। যেন কোনো চলমান সিনেমা। ট্রেনের জানালা ছিল পর্দা।

এই পর্যন্ত ট্রেনযাত্রার বর্ণনা আমাদের স্কুলের বই–খাতায় পড়া বর্ণনার সঙ্গে মেলে। কিন্তু বাস্তবে আরও কিছু অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়।

ট্রেনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ভিক্ষুক। বিচিত্র ধরনের ভিক্ষুক। সাধারণ পঙ্গু, অন্ধ ভিক্ষুক তো ছিলই, কিছু প্রতিভাবান ভিক্ষুকও পাওয়া যেত। যেমন একজন ছিল ‘রেডিও বাংলাদেশ’ ভিক্ষুক। সে রেডিওতে পড়া সংবাদ হুবহু পাঠকদের মতো পাঠ করে, সঙ্গে গান শুনিয়ে ভিক্ষা করত। তার কণ্ঠস্বরে সুরও ছিল। সে খালি গলায় গাইত, ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি—খোদা তোমার মেহেরবানী!’

এই গানটা আমি সেই ভিক্ষুকের কণ্ঠে ছাড়া অন্য কোথাও শুনিনি। এবং এতদিন পরেও গানের কথা ঠিকই মনে আছে।

সে আরেকটা গান গাইত, ওটা অবশ্য খুবই কমন গান। ‘আমারও দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন। শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে...নেই কিছু প্রয়োজন।’

সঙ্গে সেই দিনের সংবাদ। মাথায় ঢোকে না, কীভাবে একবার শুনেই পুরো সংবাদ দাঁড়ি–কমাসহ কেউ মুখস্থ করে ফেলে!

প্রতিবার পাহাড়িকা এক্সপ্রেসে ওকে পেতাম।

লোকটা এখনো বেঁচে আছে কি না, কে জানে! থাকার কথা নয়। হয়তো অনেক প্রতিভা ছিল। হয়তো অনেক কিছুই করতে পারত। ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষা করেই অমূল্য এই মানব জীবন ব্যয় করে গেল।

ছিল ফেরিওয়ালাদের মেলা। ডাব, সেদ্ধ ডিম, কলা, বাদাম, ফল ইত্যাদি থেকে কলসিতে ভরা পানি পর্যন্ত—সবই ফেরিওয়ালারা বিক্রি করত। ফেরি করে বিক্রি করা কেকের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। আম্মু–আব্বু বলতেন, ওটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বানানো হয়। সেই সঙ্গে সেসবের ওপর জমা হচ্ছে ট্রেনের ধুলাবালু, ময়লা, জীবাণু ইত্যাদি। ওটা এক পিস খেলেই পেট এমন খারাপ করবে যে বাথরুমে বসে বসেই যৌবনের কিছু সোনালি অধ্যায় কেটে যাবে!

বুকে পাথর চেপে নিজের জিবকে সামলাতে হতো। মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করতে হতো, বড় হয়ে যখন টাকাপয়সা কামাব, তখন অবশ্যই ওই কেক খাব।

কিছু যাত্রীকে দেখতাম সুযোগ খুঁজত অন্যের সিটে কোনোরকমে বসে পড়ার। এরা ছিল বিনা টিকেটের সওয়ারি। ওপরওয়ালা কেন মানুষের পেছন দিকটা সমান দুই ভাগে ভাগ করেছেন, সেটা উদাহরণসহ ওরাই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারত।

প্রথমে ওরা এসে মোটামুটি খালি কোনো সিটের পাশে এসে দাঁড়াত। পুরো সিট কখনোই খালি পাওয়া যেত না। ওরা সেটা আশাও করত না। ওরা খুঁজত কোনো চিকন–চাকন যাত্রী, অথবা বাচ্চা কাউকে, যে পুরোটা সিটের অর্ধেকের বেশি দখল করতে পারেনি। তারপর সুযোগ বুঝে পশ্চাৎদেশের অর্ধেকটা সেই খালি অংশে বসিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করত। যাত্রী ধমক দিলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য কোনো সিট খুঁজতে বেরিয়ে যেত।

আরও পড়ুন

আর যদি যাত্রী ভদ্রতা বা মানবতার খাতিরে চুপ থাকত, তাহলে ট্রেনের ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজের সম্পত্তির বাকি অর্ধেকটা ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে এনে সিট দখলে নিয়ে নিত। আর নাহলে ট্রেনের নামাজ পড়ার কামরা তো ছিলই। সেখানে গিয়েই তারা ‘ইবাদত বন্দেগি’ করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছে যেত।

আরেক ধরনের যাত্রী পাওয়া যেত যারা জীবনে কখনো ফুল টিকিট কিনত না। তর্ক করত হয় ছাত্র, অথবা অন্য কিছু। টিকিট চেকারও তর্কে জড়াতেন না। জানেন কোনো লাভ নেই।

ট্রেন লেট হওয়াটাই ছিল নিয়মিত ঘটনা। সাতটার ট্রেন কখনোই সাতটায় ছাড়ত না। দশ–পনেরো মিনিট দেরি না করলে কেমন অস্বস্তিবোধ হতো। ‘আজকে ট্রেন সময়মতো ছেড়েছে! সমস্যাটা কী? সব ঠিক আছে তো?’

ট্রেনের বাথরুম ছিল এক চলমান আতঙ্কের নাম। দুলুনিতে মনে হতো যেন ওই ফুটো দিয়ে আমিই ট্রেনের চাকায় পড়ে যাব। আর সেখানে যে খুশবু পাওয়া যেত, আহা! মনেই হওয়ার উপায় নেই জন্মের পর থেকে ওই ট্রেনের টয়লেট কখনো পরিষ্কার করা হয়েছে। আমার ধারণা ছিল ট্রেনের পাবলিক টয়লেটের চেয়ে বাজে কিছু জীবনে দেখার নসিব হবে না। অতঃপর আমি শ্রীদেবীর ছোট কন্যা খুশি কাপুর এবং শাহরুখের একমাত্র কন্যা সোহানা খানদের অভিনয় দেখলাম।

যাক সে কথা। ট্রেনযাত্রার সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল এই যে গ্রামের ছেলেদের একটি খেলা ছিল কে ঢিল ছুড়ে সেটা চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকাতে পারে। তাদের তো ঢিল ছুড়েই মজা শেষ, সেই ছোট্ট পাথরের টুকরা ভেতরে ঢুকে কী ভয়াবহ দুর্ঘটনা যে ঘটাত, সে সম্পর্কে তাদের ধারণাই নেই। একবার মনে আছে এক লোকের নাক ফেটে গিয়েছিল। গলগল করে রক্ত ঝরছিল। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক হয়তো মারাই যাবেন।

নানা বেঁচে থাকতে আমরা যখন নানুর বাসায় যেতাম, তখন নানা পারলে ভোর হতেই আমার দুই মামাকে স্টেশনে পাঠিয়ে দিতেন। অথচ ট্রেন আসত বিকেলে বা সন্ধ্যায়। এবং কখনোই সময়মতো আসত না, দুই–চার ঘণ্টা দেরি হওয়াটা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা স্টেশনে এসে দেখতাম আমার মেজো ও সেজো মামা আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়ানো।

মা তাঁর ভাইদের বলতেন, ‘কখন এসেছিস?’

‘দুই ঘণ্টা আগে।’

‘এত আগে কেন?’

‘আব্বা ঘরে টিকতে দিচ্ছিল না।’

নানার বড় মেয়ে নাতি–নাতনি নিয়ে আসছেন, এই আনন্দ তিনি ধরে রাখতে পারতেন না। রিকশা বা বেবি ট্যাক্সি করে নানুর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতাম নানা হয় গেটে অথবা একদম রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়ে আমাদের অপেক্ষায় অস্থির পায়চারি করছেন।

এই যে দৃশ্য ও চরিত্রগুলো, এগুলো আমাদের জীবন–চলচ্চিত্রে আর কখনো দৃশ্যায়িত হবে না। সেইসব চরিত্রের বিদায়ের মাধ্যমেই সেসব দৃশ্যের সমাপ্তি হয়ে গেছে।

আমার ছেলেদের ট্রেনযাত্রার কোনো স্মৃতি নেই। ওরা ট্রেন চাপতে চাইলে আমরা মেট্রোতে চাপাই। কিন্তু বিদেশি মেট্রো রেলে দেশি ট্রেনের মজা কোথায়?

আমেরিকার রেলব্যবস্থাও এমন যে ট্রেনে চেপে অন্য স্টেটে যাওয়ার চেয়ে প্লেনে গেলে খরচ এবং সময় দুই–ই বহু কম লাগে।

তবু আমাদেরই শহরের (ডালাসের) পাশের শহর ফোর্ট ওয়ার্থে একটি ট্যুরিস্ট এলাকায় (স্টকইয়ার্ড) প্রায় এক শ বছর পুরোনো ট্রেন ওরা রেখে দিয়েছে যাতে ট্যুরিস্টরা ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতা পেতে পারেন। শতবর্ষী ট্রেন হলেও ঝাঁকুনি নেই। তার চেয়ে বড় কথা কোনো ফেরিওয়ালা নেই, বিনা টিকিটের যাত্রী নেই। গান গাইতে থাকা ভিক্ষুক নেই। ধুলাবালু নেই। কোনো বাচ্চা অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে ঢাকা কলসি কোলে নিয়ে হাঁক দেয় না, ‘হানি, এই হানি...ঠান্ডা হানি!’ বা জীবাণুতে ঠাসা কেক নিয়ে কোনো ফেরিওয়ালাও দেখা যায় না।

এসবের অনুপস্থিতিতে বেচারারা ‘জীবনকে’ ঠিকঠাক দেখবে কীভাবে?

দুধের স্বাদ কি ঘোলে কখনো মেটে?