বিশ্বজনতার নজর যুক্তরাষ্ট্রে, কিন্তু কেন
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুগের পর যুগ ধরে এক অতুলনীয় শক্তির প্রতীক হিসেবে বিরাজ করছে। এ প্রভাবের পেছনে রয়েছে নানা কারণ, যা যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু একটি দেশ হিসেবে নয়, বরং বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপটের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেন পৃথিবীর এত দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত এ দেশটির দিকে? এ প্রতিবেদনে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করব।
১. রাজনৈতিক প্রভাব ও নেতৃত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব বহুদিন ধরে বিশ্বব্যাপী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তার নীতিগুলোকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষমতা দ্বারা বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করে। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিষয়টি তাদের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও সুসংহত করেছে।
২. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নেতৃত্ব
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা তাকে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় শিল্প খাত, যেমন প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও ভোগ্যপণ্য বাজারে প্রাধান্য, তার বিশ্বব্যাপী আর্থিক নেতৃত্বকে আরও দৃঢ় করেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেমন অ্যাপল, গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানের আবাসস্থল যুক্তরাষ্ট্র হওয়ায় এর প্রযুক্তিগত আধিপত্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. সংস্কৃতি ও মিডিয়া শক্তি
একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের প্রভাব। হলিউড, টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। তাদের চলচ্চিত্র ও সংগীতশিল্প শুধু বিনোদন নয়, বরং একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মাধ্যম যা বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধ, ফ্যাশন ও জীবনধারায় প্রভাব ফেলছে। এই গণমাধ্যমের প্রচারণা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক উপস্থিতিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
৪. শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু
যুক্তরাষ্ট্র উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও শীর্ষস্থানীয়। হার্ভার্ড, এমআইটি ও স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অগ্রগণ্য। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞান উদ্ভাবন হচ্ছে, যা তাদের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীরা এই দেশটিতে পড়াশোনার জন্য আকৃষ্ট হন, যা তাঁদের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত বৈচিত্র্য দেয়।
৫. গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতা
এটা সত্য যে যুক্তরাষ্ট্রের বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। যদিও চীন বা রাশিয়া শক্তিশালী অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষমতা রাখে, তাদের গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবে তারা বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো আকর্ষণীয় হতে পারেনি। মানুষ জাতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে নতুন কিছু দেখার ও উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার উদাহরণ দিয়ে অন্য দেশের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ
গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে একটি দেশের দিকে। মনে হচ্ছে পৃথিবী মানেই যুক্তরাষ্ট্র। আসলেই কি তাই? অরাজকতা, অন্যায়, অত্যাচার থেকে শুরু করে ভালো–মন্দ, সবকিছুরই প্রভাব রয়েছে সেখানে। সেখানেও মানুষ রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করে। এমনকি প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসের চারপাশে অনেকের রাত কাটে। আবার অনেকে ঠিক সেই দেশ থেকেই মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে, চমৎকার। প্রশ্ন হচ্ছে—কী এমন জাদু রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে? চীনও কিন্তু একটি জনবহুল দেশ। তা ছাড়া উন্নত দেশের সারিতে তাদের বর্তমানে ভালো দাপটও রয়েছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো না গর্জে বা না বর্ষে! কারণ কী? ভেবেছেন কি কখনো?
বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিস নেই সেখানে। চীন ও রাশিয়া যত ধনী বা শক্তিশালীই হোক না কেন, গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিসের অভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বে প্রভাব ফেলতে পারছে না। মানুষ জাতির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সত্যি প্রশংসনীয়। যেমন আমরা নিজেরা ভালো কিছু না করতে পারলেও যখন অন্যরা করে, সেটা কিন্তু খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। যেমন বাংলাদেশের কথাই বলি, সবাই যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তা নয়; তবুও সে দেশ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক।
বাংলাদেশে রাজনীতি মানেই অর্থনীতিতে সাফল্য, জনগণের জন্য কিছু করুক বা নাই করুক, চৌদ্দ গোষ্ঠীর জন্য যা করার, তা–ই করে। এখন জনগণ যেমন আস্থা হারিয়েছেন রাজনৈতিকদের ওপর, রাজনীতিবিদেরাও জনগণের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন। যার ফলে দেশের ভোটের সিস্টেম বিলীন হতে চলেছে। দেখা যাচ্ছে টাকা নিয়েও ভোট দেয়নি, আবার ভোট দিয়েছে অথচ টাকা পায়নি। কয়েকবার এমনটি ঘটেছে, শেষে বিনা ভোটে ব্যালট বাক্স ভরা হয়েছে। এটাই জয়ী হওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। অনেক তথ্য জেনেছি। ভাবনা, কী হবে আমাদের অভাগা বাংলাদেশের? কবে আমরা আমাদের গণতন্ত্র ফিরে পাব, নাকি সঠিক সময় এখনো হয়নি? দেশ অতীতের তুলনায় ভালোই তো আছে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, বেকারত্বের সংখ্যা কমেছে। সবাই বেশ ভালোই তো আছে। কী দরকার গণতন্ত্রের, যেভাবে চলছে তাতে সমস্যা কোথায়? তারপর টাকার বিনিময়ে ভোট দিয়ে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে তো সঠিক গণতন্ত্র কখনো হবে না। সেক্ষেত্রে যেমন আছি, তেমন থাকায় সমস্যা কোথায়? অথবা যদি সত্যিকারভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তবে আমাদের চিন্তাচেতনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। সে পরিবর্তন সমষ্টিগতভাবে হতে হবে নিজ নিজ জায়গা থেকে। এটা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ সবার জন্য।
মানুষ জাতি চাপে পড়ে সমস্যার সমাধান খোঁজে। আমরা যদি সত্যিই চাপের মধ্যে পড়তাম, তবে সমাধান বের করতাম। আমার মনে হয় মুষ্টিমেয় কিছু লোক চাপের মধ্যে আছে, সর্বাঙ্গীণভাবে চাপ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না। সেক্ষেত্রে প্রথম যে কাজটি করতে হবে আমাদের সবাইকে, সেটা হলো চাপ সৃষ্টি করা নিজেদের ভেতর থেকে। যেমন একটি ডিম বাইরের চাপে ভেঙে ধ্বংস হয়ে যায় অথচ তার ভেতরের চাপে সৃষ্টি করে একটি জীবন। আমাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে পরিবর্তনের জন্য আর সেটা হতে পারে আমাদের বিবেককে কলুষমুক্ত করা। এটা যদি করতে পারি তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ শুধু নিজেকে নয়; গোটা বিশ্বকে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ দেখাতে পারবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্ব বিশ্লেষণ
*ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রভাব
১. বাণিজ্যনীতি : ট্রাম্প প্রশাসনের অধীন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত বাণিজ্য চুক্তি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল ও সুরক্ষাবাদী নীতি অনুসরণ করে। তাঁর পুনর্নির্বাচন হলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার কঠোর হতে পারে। বিশেষত, তৈরি পোশাক খাতের মতো প্রধান রপ্তানি খাতে শুল্কের পরিমাণ বা বিধিনিষেধ বাড়ানো হতে পারে।
২. অভিবাসননীতি: ট্রাম্পের আমলে অভিবাসননীতি ছিল কঠোর, যা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে অভিবাসী প্রেরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের অনেক মানুষ শিক্ষার জন্য বা কাজের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যান, তাই এ ধরনের নীতিগুলো তাঁদের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
কমলা হ্যারিস বা ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বের প্রভাব
১. বহুপক্ষীয় সহযোগিতা: ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব, বিশেষত কমলা হ্যারিস, সাধারণত আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে ও বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে জোর দেন। এর ফলে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা ও উন্নয়নসহায়তা প্রকল্পে আরও সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২. বাণিজ্য ও মানবাধিকার: ডেমোক্রেটিক প্রশাসন সাধারণত মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গুরুত্ব দেয়। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও সহায়তা উভয়ই বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ইতিবাচক হতে পারে, যদিও এর ফলে সরকারকে নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও চাপ মোকাবিলা করতে হতে পারে। তবে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রচারে ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য কোনটি ভালো
বাংলাদেশের জন্য সাধারণত ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব বেশি উপকারী বলে মনে করা হয়, কারণ, তারা বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও মানবাধিকার উন্নয়নের ওপর জোর দেয়। কমলা হ্যারিসের মতো নেত্রী, যিনি একজন অভিবাসী পরিবারের সন্তান, অভিবাসন ও বৈশ্বিক মানবাধিকার বিষয়ে সহানুভূতিশীল হতে পারেন। এটি বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে।
অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, বিশেষত, বাণিজ্যনীতি ও অভিবাসন কঠোর হওয়ার কারণে। তবে ট্রাম্পের কৌশলগত নীতি, যেমন চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান, বাংলাদেশের জন্য কিছু সুবিধাও আনতে পারে। এটি কৌশলগত অংশীদারত্বের সুযোগ তৈরি করতে পারে, যা অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের স্বার্থে আসতে পারে।
** দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল [email protected]