যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে নানা ভাবনা, দুজনের সমান নির্বাচনী ভোট হলে কী হবে?

কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: রয়টার্স

যদি কোনো দৈবাৎ ঘটনা না ঘটে, তাহলে ৫ নভেম্বর রাতেই যুক্তরাষ্ট্রে একজন নতুন প্রেসিডেন্ট আসবেন। দৈবাতের কথা বলছি এ জন্য যে দুই প্রার্থী যদি একই নির্বাচনী ভোট পান, তাহলে মার্কিন কংগ্রেস (পার্লামেন্ট) তাদের সংখাগরিষ্ঠ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে, যেমনটা হয়েছিল ১৮০০ সালে টমাস জেফারসন ও এরন বারের মধ্যে। যেহেতু এবার প্রধান দুই প্রার্থীর জনমত ৫০-৫০ শতাংশে আটকে আছে কয়েক সপ্তাহ ধরে, তাই দুজনের পক্ষে সমানসংখ্যক (২৬৯-২৬৯) নির্বাচনী ভোট একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার ২০০০ সালের নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ডেমোক্র্যাট আল গোর। সব ভোট গণনার পর দেখা গেল, যিনি ফ্লোরিডায় জিতবেন, তিনিই হবেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ফ্লোরিডায় দুজনের ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র দুই হাজার। এ অবস্থায় ভোট পুনর্গণনা হলো বেশ কয়েকবার এবং সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াল নিষ্পত্তির ভার। সুপ্রিম কোর্ট ডব্লিউ বুশকে জয়ী ঘোষণা করলেন। নির্বাচনের পর এক মাস লেগেছিল নির্বাচনী মীমাংসা করতে। তবে দৈবাৎ বা অদৈবাৎ, সময় যা–ই লাগুক না কেন, প্রেসিডেন্ট হবেন ডেমোক্রেটিক পার্টির কমলা হ্যারিস অথবা রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প।

গ্লাস সিলিং

আমরা একবার ২০১৬ সালের নির্বাচনের দিকে ফিরে দেখি, হিলারি ক্লিনটন বনাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনের পূর্বপর্যন্ত ৮টি জাতীয় জনমত জরিপের প্রতিটিতেই হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। গড় ছিল হিলারি ৪৫% এবং ট্রাম্প ৪১%। নির্বাচনের রাতে দেখা গেল, ট্রাম্প বিরাট ব্যবধানে জিতেছেন। আর তারই আট বছর পর ট্রাম্প হেরে গেলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির দুর্বলতর প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে। এর থেকে কি আমরা গ্লাস সিলিং (নারী প্রার্থীর জন্য প্রতিবন্ধকতা) সম্বন্ধে কোনো উপসংহার টানতে পারি?

আমার এক বন্ধু খাঁটি কথা বলেছেন, মার্কিনরা নারীদের খুব কমই বড় রাজনৈতিক নেতৃত্বে দেখেছে, যার জন্য নারী নেতৃত্বের স্বপক্ষে মতামত নিতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত। নারীরা স্কুলশিক্ষক, নার্স বা সেক্রেটারি হবেন, এটাই যেন স্বাভাবিক।

নারীবিদ্বেষের ব্যাপারটাও সামনে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলের বেশ কিছু লোক, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান যাঁদের বলা যায় ঘাওরা বা রেড নেক, তাঁরা নারীদের কখনোই ভোট দেবেন না। তাঁরা মনে করেন, নারীদের নৈশ ক্লাব, বার বা ক্যাবারেতেই বেশি মানায়। তবে ধীরে ধীরে এ গ্লাস সিলিং ভাঙছে এবং নারীবিদ্বেষও কমে যাচ্ছে। বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যের গভর্নর এখন নারী।

এ বছর রিপাবলিকান ভোটার যাঁরা ট্রাম্পীয় কদাচারে একদম বিরক্ত, আশা করা হচ্ছে যে তাঁরা কমলার পক্ষে ভোট দেবেন। এর মধ্যে আছেন ডিক চেনি, যিনি ইরাক যুদ্ধের সময় ডব্লিউ বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অনেক রিপাবলিকান জনপ্রিয় নেতা যেমন সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জেফ বুশ ও মিট রমনি, খোলাখুলি ট্রাম্পকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ রিপাবলিকান সুপ্ত ভোট কি গ্লাস সিলিংয়ের পার্থক্য ঘোচাতে পারবে? অনেকেই তা আশা করছেন।

কমলার ওপর আরব ও মুসলমানরা দারুণ ক্রুদ্ধ

গাজা যুদ্ধের পুরোটা সময় কমলা হ্যারিস ছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একনিষ্ঠ ডানহাত। মার্কিনরা একাধারে ইসরায়েলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দিয়ে আসছে। ইসরায়েল ৪৩ হাজার গাজাবাসীকে হত্যা করেছে আর কমলা ও বাইডেন প্রতিবার ইসরায়েলি সাফল্যে বাহ বাহ দিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবিরোধীদের কাছে বাইডেনের পরিচয় হলো, ‘জেনোসাইড বাইডেন’। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রে আরব ও মুসলমানরা কমলার ওপর দারুণ ক্রুদ্ধ। আরবদের অনেকেই লেবানন ও সিরিয়া থেকে আগত খ্রিষ্টান। যুদ্ধে অনেক মার্কিন ফিলিস্তিনি তাঁদের অনেক নিকট আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন যে কোনো অবস্থায়ই তাঁরা কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন না।

আরব ও মুসলিম ভোটের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে মিশিগান অঙ্গরাজ্যে, যেখানে ১৫টি নির্বাচনী ভোট। এখনকার জনমতে কমলা ও ট্রাম্প সমান সমান। যাদের ভোট মিশিগানে নির্বাচনী ফল ওলটপালট করে দিতে পারে, সেই আরব ও মুসলমান জনমত চারটি ধারায় বিভক্ত: ১) কমলা তুলনামূলক নিরাপদ পছন্দ। বাইডেন বিদায় নিলে তিনি অনেক পরিবর্তন আনবেন এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরও সদয় হবেন। ২) ট্রাম্প নিজেকে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিবাদী ভাবতে পছন্দ করেন। তাই তিনি এসেই যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন। ফিলিস্তিনিরা একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। ৩) এই দুজনের কেউ নয়, কোনো তৃতীয় পার্টির প্রার্থীকে ভোট দেবে। (৪) ভোট দেবেই না, ভোটের দিন বাড়িতে বসে থাকবে।

শেষ তিনটি পক্ষ যে ট্রাম্পের জয়ে সহায়ক হবে, তা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়। ইউ-গভ প্রতিষ্ঠান আরব আমেরিকানদের এক সাম্প্রতিক জনমত জরিপ প্রকাশ করেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে যে ট্রাম্প এদের মধ্যে ৪৫ থেকে ৪৩ শতাংশে এগিয়ে আছেন। বুশরা বাবা যিনি একজন ধনী আরব এবং গতবার বাইডেনের পক্ষে কাজ করেছিলেন, তিনি এবার সক্রিয়ভাবে ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকেরা বাইডেন ও কমলার কথা শুনলেই ঘৃণা ও ক্লান্তি বোধ করেন। বরং ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন।’

মজার ব্যাপার হলো, গত নির্বাচনে ‘মুসলমানদের ওপর নিষেধাজ্ঞা’ নিয়ে ট্রাম্প অনেক চেঁচামেচি করেছেন। এবার এ ব্যাপারে তিনি একটা কথাও উল্লেখ করেননি। আরব-মুসলিম ভোট ছাড়া কমলা হ্যারিস মিশিগান জয় করতে পারবেন না আর মিশিগান ছাড়া সম্ভবত তিনি প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হতে পারবেন না।

ট্রাম্প জিতলে কি পরিবর্তন হবে?

কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হলে তিনি যে খুব দ্রুত বাইডেনের নীতির খুব পরিবর্তন করবেন না, তা ধরেই নেওয়া যায়। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচিত হলে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। আমরা দেখব, ট্রাম্পের আমেরিকায় কী কী পরিবর্তন হতে পারে। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প বেআইনি অধিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার কথা বারবার বলেছেন এবং নির্বাচিত হলে তিনি তা কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর।

যুক্তরাষ্ট্র ২০০ বছর ধরে গণতন্ত্রের চর্চা করছে, এমনটা কখনো হয়নি। ট্রাম্প বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের বিচার করবেন এবং তাঁদের জেলে পাঠাতে দ্বিধা করবেন না। ট্রাম্প বলেই দিয়েছেন যে তিনি মুক্তবাণিজ্য মানবেন না। তিনি ১০% হারে আমদানি করা জিনিসের ওপর শুল্ক প্রয়োগ করবেন। চীনের প্রতি তিনি আরও কঠোর হবেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ধীরে ধীরে তিনি চীন থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও ইলেকট্রনিকসের আমদানি বন্ধ করে দেবেন।

ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতিতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে রাশিয়া। পুতিন ট্রাম্পের পুরোনো বন্ধু। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বাইডেন ইউক্রেনকে যে অস্ত্রশস্ত্র ও টাকাপয়সা দিচ্ছেন, ট্রাম্প অবধারিতভাবে তা বন্ধ করে দেবেন।

ইউরোপীয় দেশগুলো ট্রাম্পকে নিয়ে দারুণ শঙ্কিত। ন্যাটো জোট গঠন করা হয় ইউরোপীয় দেশগুলোকে রুশ-চীন কমিউনিস্ট হুমকি থেকে রক্ষা করার জন্য। ন্যাটোর অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক কার্যবিধির সব অর্থায়ন মূলত যুক্তরাষ্ট্রই দিয়ে আসছে। ট্রাম্প ২০১৬–২০২০ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় থেকেই হুমকি দিয়ে আসছেন যে অন্যান্য সদস্যদেশ যদি তাদের চাঁদার ভাগ না বাড়ায়, তাহলে তিনি ন্যাটো ভেঙে দেবেন। তিনি চান যুক্তরাষ্ট্রের দায় কমাতে। এইবার তিনি তাঁর হুমকি কার্যকর করলে, মার্কিন বিদেশনীতির একটা স্তম্ভই ভেঙে পড়বে।

নির্বাচন নিয়ে শেষ কথা

কে হাসবেন শেষ হাসি, নিশ্চত করে বলা যায় না। নেট সিলভার একজন প্রখ্যাত মার্কিন পরিসংখ্যানবিদ। নির্বাচনের মডেল ও জনমত বিশ্লেষণ করা তাঁর নেশা ও পেশা। তিনি ২৭ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন, ‘এখন যে সংখ্যা আমরা দেখছি, একমাত্র সম্মানযোগ্য উত্তর হলো, জয়ের সম্ভাবনা দুজনেরই ৫০-৫০। তবে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন যে আমার অন্তর্দৃষ্টি কী বলছে, আমি বলব, ট্রাম্পই জয়ী হবেন। অবশ্য, আপনাকে আমার অন্তর্দৃষ্টি বিশ্বাস করতে হবে, তা আমি বলছি না।’ সিলভার মনে করেন, ট্রাম্পের অনেক ভোটার গ্রামগঞ্জে থাকেন, যাঁরা আগে ভোট দিতেন না এবং জরিপকারীদের পক্ষে এদের কাছে পৌঁছানো এবং কথা বলা প্রায়ই অসম্ভব। এরা ট্রাম্পের সুপ্ত ভোটার।

অনেকেই সিলভারের অন্তর্দৃষ্টি বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচিত হলে যেসব প্রলয় হবে, তার জন্য সম্ভাব্য ভুক্তভুগী সবাইকে আগেভাগে প্রস্তুতি নিতে হবে।

অপর দিকে কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, ট্রাম্প যে তাঁকে মেনে নেবেন না, তা তিনি আগেভাগেই বলে দিয়েছেন। এখন বাইডেনের প্রেসিডেন্সির একদম শেষ পর্যায়ে, বাইডেনকে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে এখনো মেনে নেননি। ২০২১ সালের জানুয়ারির ৬ তারিখ, যখন বাইডেনের নির্বাচনকে কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে সত্যায়ন করছিল, তখন ট্রাম্প তাঁর লোকজন দিয়ে কংগ্রেস ভবনে আক্রমণ করান। এবার হারলে তিনি যে আরও বড় হাঙ্গামা করবেন, তা ধরেই নেওয়া যায়। ২০২৪ সালই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার শেষ সুযোগ। ভবিষ্যতে আরও দেখার বিষয় হলো, ট্রাম্প চলে যাওয়ার পর, ‘ট্রাম্পবাদ’ কি যুক্তরাষ্ট্রে বেঁচে থাকবে? তবে এখন এত দূরে না তাকিয়ে, আমরা ৫ নভেম্বরের দিকে চোখ রাখব।

*লেখক: সালেহ উদ্দিন আহমদ: লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কম্পিউটারবিশেষজ্ঞ