ইউরোপের ডায়েরি-৩
প্রবাসীদের জীবন একেকটা উপন্যাস
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ইউরোপ মানেই স্বপ্নের হাতছানি। কত রঙিন স্বপ্ন। সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা। আমাদের রেমিট্যান্স–যোদ্ধাদের নজর থাকে ইউরোপ। কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভাই পর্তুগালের ভিসা পেয়েছেন। কী পরিমাণ যে খুশি। ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আবার যাঁদের আত্মীয়স্বজন ইউরোপে থাকেন, তাঁরা মনে করেন ইউরোপে রাজার হালে আছেন। কত শান্তি তাঁদের। আমারও ধারণা ছিল যে যাঁরা ইউরোপে থাকেন, তাঁদের জীবন কতটা রঙিন, কত চাকচিক্যময়। কিন্তু আসলে কি তাই?
দেশে থাকার সময় ফ্রান্সে বাসাভাড়া ঠিক করে দেওয়ার কথা ছিল আমার বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর। তিনি প্যারিসেই থাকেন। আমি তাঁর সঙ্গে কয়েক দিন কথাও বলি। উনি আশ্বস্ত করেন। এদিকে ভিসা নিয়ে জটিলতা হওয়ায় আমিও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। একদিন আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করি। উনি যেটা বললেন, তাতে আমি কিছুটা হতাশ হলাম।
আমার এক সহকর্মী এর আগে প্যারিসে গিয়েছিলেন। ওনার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে শেয়ার করলাম। উনি পরামর্শ দিলেন প্রথমে কয়েক দিন হোটেলে থাকার পর বাসা খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আজাদ নামের একজনের ব্যাপারে খুব সুনাম করলেন। উনি সাহায্য করবেন বলে জানালেন। আমাকে নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন। আমিও আমার সহকর্মীর কথামতো ধরেই নিলাম হোটেলে কয়েক দিন থাকার পর বাসা ভাড়া নেব। কিন্তু সেটা যে কত বড় বোকামি হতো, তা এখানে এসে বুঝেছি। তাঁর কাছ থেকে আজাদ ভাইয়ের হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করি। উনি সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিলেন। কথা হলো। আমি বাসা ঠিক করে দিতে অনুরোধ করলাম। উনি রাজি হলেন।
এত ভালো মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আমি তো ধরেই নিয়েছি প্যারিসে গেলেই বাসা ভাড়া করতে পারব। আজাদ ভাইকে বলে আমি আর যোগাযোগ করি না। যোগাযোগ করি না বললে ভুল হবে। কাউকে কেন যেন বিরক্ত করা আমার ভালো লাগে না। সব সময় আমি চিন্তা করি অন্যজন বিরক্ত হচ্ছেন কি না। আজাদ ভাই দুই দিন পরেই ফোন দিলেন। বললেন, তাঁর এক বন্ধু বাসায় আমার থাকার ব্যবস্থা করেছেন। আমার সহকর্মী, উনি খুব ভালো মানুষ, খুব হেল্পফুল। কিন্তু এতটা তা বুঝিনি।
আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইয়ের নাম আজাদ। আমার সে ভাই ও আমি পিঠাপিঠি। এ জন্য ওর সঙ্গে আমার স্মৃতি বেশি। ওকে খুব ভালোবাসি। আজাদ ভাইকে জানালে উনি বললেন, আমাকে ভাইয়ের মতোই পাবেন। উনি আরও আশ্বস্ত করলেন যে প্যারিস নাকি আমার কাছে বাড়ির মতোই মনে হবে। আসলে হয়েছেও তাই। প্যারিসে আমি কখনো একাকিত্ব বোধ করিনি। আজাদ ভাই জানালেন প্রথম দুই-তিন দিন আমাকে তাঁর বাসায় রাখবেন। তাঁর বাসায় যিনি থাকেন তিনি দেশে যাওয়ায় রুম খালি আছে। আমি বারবার বলি, হোটেলে থাকব। আমি আসলে তাঁকে বিরক্ত করতে চাইনি।
প্যারিসে প্লেন থেকে নেমেই আজাদ ভাইকে ফোন দিই। উনি বাসায় আছেন। আমি বাসা খুঁজে পাব না বলে কাজে যাননি। ট্যাক্সি নিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে তাঁর বাসায় পৌঁছে যাই। কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল। চিনি না, জানি না এমন একজনের বাসায় তিন দিন থাকব। কিন্তু নাছোড়বান্দা আজাদ ভাইয়ের জন্য হোটেল ঠিক করা হয়নি।
বাসার নিচে থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন। বাথরুম দেখিয়ে ফ্রেশ হতে বললেন। এসেই আমার ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। দেশে এখন রাত তিনটা। ভাবলাম ও এখন ঘুমে বিভোর। দেশ থেকে আসার আগে ওকে স্কুলে দিয়ে আসি। ও বলছিল বাবা, এত দিন থাকবে না। আমার ভালো লাগবে না।
গোসল করে এসেই দেখি আজাদ ভাই খাবার রেডি করেছেন। ভাত ও দুই প্রকারের তরকারি। ভাত দেখেই পেট চোঁ চোঁ করা শুরু করেছে। আজাদ ভাই খাওয়াতে ভালোবাসেন। পেট পুরে খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকাল আটটার মধ্যে হাসপাতালে যাব। প্রফেসর ই–মেইল করেছেন, তুমি দু-এক দিন রেস্ট নাও। কিন্তু আমার ভাবনা যে কাজে এসেছি, তা আগে।
ফজরের নামাজের সময় আজাদ ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। নামাজ পড়ে ড্রাইভারকে ফোন দিলাম। ছেলে এখন স্কুল থেকে বাসায় যাচ্ছে। ওকে দেখে মনটা ভালো হলো।
কিছুক্ষণ পর আজাদ ভাই পরোটা ও ডিমভাজি নিয়ে হাজির। আমি অবাক হলাম। নাশতা করে আজাদ ভাই আমাকে নিয়ে বের হলেন হাসপাতালের উদ্দেশে। ধরে ধরে প্যারিসের রাস্তা চলাচল করা শেখালেন। রাস্তাঘাট আমি খুব কম চিনি। এটার আমার বড় সমস্যা। উনি হাতে ধরে না শেখালে আমার আসলে বেশ কষ্টই হতো।
পরের দিনও আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আসেন। বন্ধের দিনগুলোতে প্যারিসের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। আর রান্না করে খাওয়ানো তো আছেই। এক-দুই সপ্তাহ পর পর দাওয়াত দেন। খুব ভালো রান্না করেন। জোর করে খাবার তুলে দেন। এত খাবার খেতে হয় যে খাওয়ার পর না শুলে চলে না। পেট ভরে খাওয়ানোর পর আবার দুই-তিন দিন চলে, এমন তরকারি সঙ্গে দিয়ে দেন।
এত ভালো মানুষটার জীবনটা কিন্তু অন্য রকম। উনি দেশ ছেড়েছেন ১২ বছরের বেশি সময়। দেশ থেকে যখন আসেন ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে আর ছোট মেয়েটার বয়স ছয় মাস। সেই মেয়ে এখন বড় হয়েছে। সেভেনে পড়ে। ভাবা যায় একটা মেয়ে জ্ঞান হওয়ার পর তার বাবাকে দেখেনি। বাবার আদর পায়নি। বাবাকে কোনো দিন জড়িয়ে ধরেনি।
আজাদ ভাই জানান, একটা প্রোগ্রামে ইউরোপে এসেছিলেন। এরপর থেকে যান। ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার জন্য আবেদন করেন। ভেবেছিলেন দুই-তিন বছরের মধ্যে স্থায়ীকরণ কার্ড পেলেই দেশে যাবেন। এভাবে বছরের পর বছর ঘুরে কিন্তু তিনি আর কার্ড পান না। এ কার্ড ছাড়া ইউরোপ ছাড়লে আর আসতে পারবেন না। এ কার্ডের মায়ায় ১২টা বছর কেটে গেছে। তাঁকে ছাড়াই ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়েছে। ছেলের বিয়ের কথা চলছে।
মাঝেমধ্যে আজাদ ভাইয়ের মন খারাপ বুঝতে পারতাম। আমি তাঁর ঘটনা জানার পর আল্লাহর কাছে অনেক দিন দোয়া করেছি। দিন পনেরো আগে হঠাৎ মেসেজ আসে উনি কার্ড পেয়েছেন। খুব ভালো লাগল। ১২ বছর পর দেশে যাচ্ছেন। ছেলেমেয়েগুলোর আনন্দ আমি বুঝতে পারি।
ইউরোপে যাঁরা থাকেন, তাঁদের জীবনের গল্পগুলো এমন। একজনের গল্প যেন একেকটা উপন্যাস।
আমি যে বাসায় থাকি, পাশের রুমে থাকেন সিলেটের গিয়াসউদ্দিন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। চোখের নিচে কালি জমেছে। খুব ভালো রান্না করেন। প্যারিসে খাবার নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম। দুই-তিন দিন বাংলাদেশি হোটেলে খাওয়ার পর কিছু কারণে ভালো লাগল না। রান্না আমি পারি না। ইউটিউব দেখে দুই-তিন রান্না করলেও ভালো লাগে না। গিয়াসউদ্দিন আমাকে জানালেন আমার জন্য রান্না করবেন। সপ্তাহে তিন দিন রান্না করেন গিয়াস। বাকি দিন আরেকজন। আমি শুধু খাই। আর তাঁদের রান্না করা খাবার হাসপাতালে নিয়ে যাই।
গিয়াসের কাহিনি করুণ। তিনি প্যারিসে এসেছেন লিবিয়া হয়ে। লিবিয়ায় আদম ব্যাপারী এক মাস এক রুমে বন্দীর মতোই রাখে। খাবার বলতে দিনে একটা রুটি ও এক কাপ পানি। এক মাস রাখার পর ওকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালি পাঠায়। সে কাহিনি শুনে আমার লোম খাড়া হয়ে যায়। একটি প্লাস্টিকের নৌকায় ৮০ জন মানুষকে তোলে। রাতের অন্ধকারে তাদের মধ্য থেকে একজনকে নৌকার মাঝি করে ছেড়ে দেয়। নৌকা ভূমধ্যসাগরে চলতে থাকে। ইতালিয়ান কোস্টগার্ড জাহাজ নিয়ে ঘুরতে থাকে। কপাল ভালো হলে তারা জাহাজে তুলে নিয়ে ইতালিতে দিয়ে আসে। গিয়াসের নৌকার মাঝি রাস্তা ভুল করে। রাতের আঁধারে কোথায় গেছে, কেউ জানে না। একদিন নৌকা চালানোর পর ইতালিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা থাকলেও দুই দিনেও মাটির দেখা পায়নি। পরে মাঝ দরিয়ায় ওদের ভাসতে দেখে পণ্যবাহী জাহাজ উদ্ধার করে ইতালিয়ান কোস্টগার্ডের হাতে তুলে দেয়। গিয়াসদের সঙ্গে আরও তিনটি নৌকা ছাড়ে। পরে গিয়াস খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন একটি নৌকা সাগরেই ডুবে গেছে। ইতালি থেকে পরে প্যারিসে আসেন গিয়াস। এভাবেই জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ইউরোপে ছুটে আসেন।
গিয়াস সকাল আটটায় বাসা থেকে বের হন। কাজ করেন কাবাবের দোকানে। কাঠ পুড়িয়ে যে আগুন হয়, তা দিয়ে মুরগির কাবাব বানান। সাত বছর ধরে একই কাজ করেন। আমাদের জন্য মাঝেমধ্যে নিয়ে আসেন। বেশ স্বাদ। কিন্তু স্বাদ হলেও গিয়াসের জীবন বিস্বাদ। প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন তিনি। ইউরোপে কাজ মানে কাজ। এক মিনিট বসে থাকার উপায় নেই। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মুরগির গ্রিল করেন। প্রচণ্ড গরম থাকে রান্নাঘরে। আমি একদিন এমন দোকানে মুরগির গ্রিল কাবাব কিনতে গেছি। বাইরের এত তাপ লাগছিল যে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। আর গিয়াসউদ্দিন সাত বছর ধরে প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করেন।
সকাল ৮টায় বের হয়ে ফেরেন রাত ১২টায়। খুব ক্লান্ত থাকেন। না খেয়েই প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়েন। প্রতি মাসে বেতন পাওয়ার পর প্রায় পুরো টাকা পাঠান দেশে।
ছেলেটাকে দেখলে খুব মায়া লাগে। দেশে বাড়ি বানাচ্ছে। তিনতলা বাড়ির দুইতলা দুই ভাইকে দিয়ে দিয়েছেন। বিদেশে তাঁরা এত্ত কষ্ট করে টাকা পাঠান, বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাত বছর ধরে দেশে যান না। উনিও অপেক্ষায় আছেন স্থায়ীকরণ কার্ডের। মাসখানেক আগে সাত বছরের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। প্যারিসে তাঁকে এক বছরের জন্য স্থায়ী করেছে। সেপ্টেম্বরে বাড়ি যাচ্ছেন। মুঠোফোনে বিয়ে হয়েছে সাত মাস হলো। বউকে ঘরে তুলবেন এবার।
একদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছি। মেট্রোস্টেশনের পাশে আমাদের দেশের মতো ভুট্টা পুড়িয়ে বিক্রি করছেন কালো গায়ের রঙের একজন। আমি আফ্রিকান মনে করেছিলাম। ভুট্টা পোড়া খেতে খুব ইচ্ছা হলো। কাছে গেলে বাংলায় কথা বলেন। তিনি যা জানালেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। ১০ লাখ টাকা খরচ করে এসেছিলেন সাইপ্রাসে। দুই বছর কাজ করে কিছু টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু এরপর কাজ চলে যায়। সাইপ্রাসে কিছু না করতে পেরে ১০ লাখ টাকা দিয়ে প্যারিসে আসেন। এখানে এসেছেন সাত মাস হলো। কিন্তু কোনো কাজ নেই। কাজ না করলেও তো খেতে হয়, বাসাভাড়া দিতে হয়। বাসাভাড়া দেড় শ ইউরো। খাওয়া এক শর মতো লাগে। এত দিন দেশি ভাইদের হাতেপায়ে ধরে চললেও এখন আর কেউ সাহায্য করেন না। তাই এক দেশি ভাইয়ের পরামর্শে ভুট্টা পুড়িয়ে বিক্রি করছেন। কিন্তু আহামরি লাভ নেই। দিনে ৫-১০ ইউরো লাভ হয়। দেশে টাকা পাঠান না জানতে চাইলে, কান্না চাপিয়ে বললেন নিজেই তো না খেয়ে থাকি।
এভাবেই প্রবাসীরা নিজের সব সাধ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। তাঁদের টাকায় দেশে আত্মীয়স্বজন রাজরাজড়াদের মতো চললেও প্রবাসীরা দিনে এক বেলাও পেট পুরে খাবার খান না।
রক্ত পানি করা টাকাও পান না তাঁরা। আত্মীয়স্বজন তাঁদের টাকা লুটে নেয়। বয়স হয়ে গেলে যখন তাঁরা দেশে ফিরে যান, তখন দেখেন সহায় সম্পত্তি সব অন্যের নামে করা। নিজের নামে কিছুই নেই। প্রবাসীরা শুধু দিয়েই যান, বিনিময়ে কিছুই পান না। চলবে...