মস্তিষ্কের চিকিৎসায় উচ্চতর প্রশিক্ষণে ফ্রান্সের পথে

লেখক

নিউরো ইন্টারভেনশন নিউরোলজির একটি বিশেষায়িত শাখা। স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি মাথা না কেটে মস্তিষ্কের অপারেশন করাই এই বিভাগের কাজ। এমবিবিএস পাস করার পর থেকেই আমার আগ্রহ জন্মায় ইন্টারভেনশনে কাজ করার। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিই নিউরো ইন্টারভেনশন নিয়ে কাজ করব। এ কারণে নিউরোলজি সাবজেক্টকে বাছাই করি। নিউরোলজির এমডি কোর্সের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যাঁরা নিউরো ইন্টারভেনশন নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এমডি পাসের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার বিষয়ও নেই নিউরো ইন্টারভেনশনকেন্দ্রিক। পাস করার পর একজন অধ্যাপকের কাছে কাজ শিখতে যাই।

কিন্তু উনি যে ঘৃণ্য আচরণ করলেন, তা আমাকে পিছিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে আরও উদ্যমী করল। কিন্তু কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। পরে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শিরাজী শফিকুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে দেখা হয়, কথা হয়। আমার আগ্রহের কথা জানালাম, উনি খুশি হলেন। আমাকে নিনসে যোগাযোগ করতে বললেন। স্যারের সঙ্গে নিনসে দেখা করলাম। স্যার ও আমার শ্বশুরের সহায়তায় নিনসে পোস্টিংয়ের পর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন খান ও অধ্যাপক কাজী মহিবুর রহমান স্যার বেশ সাপোর্ট করেছেন।

নিনসে জয়েন করার পর ভয় ছিল ডিপার্টমেন্ট থেকে কখনো সরিয়ে দেয় কি না। এ জন্য এত বেশি পরিশ্রম করতাম যে সবাই যেন মনে করেন, এ কামলাকে সরালে ডিপার্টমেন্ট ঝামেলায় পড়বে।

লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে এবং কাজে সততা থাকে তাহলে আল্লাহ সাহায্য করেন। ডিপার্টমেন্টে চিকিৎসক শিরাজী স্যার আমাকে ছেলের মতো আগলে রেখেছেন।

করোনার সময় ২০২২ সালে জাপানে যাওয়ার সুযোগ হলো। নিউরো ইন্টারভেনশন নিয়ে বড় আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম। সেটাই আমার প্রথম দেশের বাইরে একাডেমিক যাত্রা। বিশ্বের নামকরা নিউরো ইন্টারভেনশনিস্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। অনেকটা স্বপ্নের মতো লাগছিল। সেখানেই পরিচয় প্যারিসের বিখ্যাত বিসেট হাসপাতালের নিউরো ইন্টারভেনশনের অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলের সঙ্গে। তাঁকে বললাম, আমি তোমার সঙ্গে ফেলোশিপ করতে চাই। উনি রাজি হলেন। বললেন যোগাযোগ করতে। আমি দেশে এসে ডিপার্টমেন্টে কথা বললাম। কিন্তু কোনো কারণে না বলে দেওয়া হলো। কাজেই প্রফেসর লরেন্টের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হলো না। ডিপার্টমেন্টের কথামতো প্যারিসের অন্য প্রফেসরের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উনি রাজি হলেন।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর ইন্টারভেনশনাল অ্যান্ড থেরাপিউটিক নিউরোরেডিওলজি (WFITN) আমাদের মতো দেশের তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এ সংস্থার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক তানাকা। উনি জাপানের মানুষ। খুব ভালো। জাপানে ওনার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। আমার স্কলারশিপের ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। উনি হেল্প করার কথা বলেছিলেন। স্কলারশিপের জন্য আবেদন করলাম। কিন্তু সমস্যা বাধল অন্যখানে। ওই সময় ওই সংস্থার এডুকেশন গ্রান্টের চেয়ারম্যান ছিলেন ভারতের অধ্যাপক শাকের হোসাইন। উনি আমাকে দিবেন না, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এক বছরের বেশি সময় পার হলেও কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। অবশেষে আমি অধ্যাপক তানাকার সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি আমাকে জানালেন, সেপ্টেম্বরে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করবেন।

ভিসা পাওয়ার পর হাতে মাত্র দুই সপ্তাহ সময়। টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার টিকিট আড়াই লাখ টাকায় কিনে উড়াল দিই। অনেকটা সময় পিছিয়ে গেছি। আর পিছিয়ে যেতে ইচ্ছুক নই।

শুরু হলো যাত্রা—

২১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। ১৪ ঘণ্টার যাত্রা শেষে যখন প্যারিসে পৌঁছাই, তখন রাত ৯টা বাজে। বাইরে তখনো ঝলমলে রোদ। অবাক হলাম। ট্যাক্সি ভাড়া করে গেলাম বাংলাদেশি প্রবাসী আজাদ ভাইয়ের বাসায়। অসম্ভব ভালো মনের মানুষ তিনি। রাতের খাবার খেয়ে এশার নামাজের জন্য অপেক্ষা করি। সাড়ে ১১টায় এশার নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই। পরের দিন সকাল ৮টায় হাসপাতালে যেতে হবে।

বিসেট হাসপাতালে শুরু হলো কাজ—

পরের দিন উঠে আজাদ ভাইয়ের বানানো পরোটা মজা করে খেয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দিই। সঙ্গে আছেন আজাদ ভাই। প্যারিসে কিছু চিনি না। উনি সঙ্গে আছেন। এক ঘণ্টা মেট্রোরেলে ভ্রমণ করে হাসপাতালে যাই। বিশাল বড় হাসপাতাল। প্রফেসর লরেন্ট স্পিলের মোবাইলে ফোন দিলে উনি ঠিকানা বলে দেন। দরজায় পৌঁছে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছিল। প্রফেসর নিজে দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে যান। ডিপার্টমেন্ট ঘুরে দেখান। অপারেশনের ক্যাথল্যাবে নিয়ে যান। উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছিল। কত দিনের স্বপ্ন ধরা দিয়েছে আজ। চলবে....

  • হুমায়ুন কবীর হিমু, চিকিৎসক, সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস

ডিপার্টমেন্টের বাইরে গিয়ে নিজের মতো দেশের বাইরে যোগাযোগ শুরু করলাম। অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলের সঙ্গে ই–মেইলে যোগাযোগ হলো। গত বছর স্ট্রোকের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ইস্তাম্বুলে যাই। সেখানেই একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলের সঙ্গে কথা বলি। উনি অফার লেটার সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। আমি এপ্রিলের ১ তারিখে জয়েন করার কথা জানিয়ে দিই।

ভিসা পেতে সমস্যা—

অধ্যাপক লরেন্ট স্পিল আমাকে যে অফার লেটার দেন, তাতে লেখা ছিল এপ্রিল-জুলাই, ২০২৫ ফেলোশিপ প্রোগ্রামে আমি যাব। দিন গুনলে হয় ৯১ দিন। এ কারণে যিনি ভিসার কাগজ প্রসেসিং করে দিয়েছিলেন, উনি লং স্টে ভিসা মানে ছয় মাস-এক বছরের ভিসার কাগজ জমা দেন। সরকারি পাসপোর্ট হওয়ায় আমাকে আগে থেকে দূতাবাসে ভাইভার ডেট নিতে হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে দূতাবাসে আমার কাগজ জমা দিতে গেলাম। আমার সরকারি পাসপোর্টে ৯০ দিনের বেশি ভিসা দেওয়ার নিয়ম নেই। অনেকক্ষণ ধরে আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করে জানাল, আমাকে জানাবে। ২ সপ্তাহ পর হঠাৎ করে ই–মেইল পেলাম আবার নতুন করে শর্ট স্টে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। ই–মেইলে আমার সঙ্গে অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলকে কপি দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক স্পিল যোগাযোগে খুব ধীরগতির। আমি মনে মনে ভাবলাম, উনি এক মাসের আগে ই–মেইলের উত্তর দেবেন না। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে উনি দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে ফিরতি ই–মেইলে অফার লেটার পরিবর্তন করে দিলেন। আমি পরের দিনই আবার ভিসার জন্য আবেদন করলাম। দুই সপ্তাহ পর হাতে পেলাম শেনজেন ভিসা।

উচ্চ দামে টিকিট—

আমি ২১ এপ্রিল হাসপাতাল বিসেটে যোগদান করব, অধ্যাপকের সঙ্গে এমনটাই কথা ছিল। ভিসা পাওয়ার পর হাতে মাত্র দুই সপ্তাহ সময়। টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার টিকিট আড়াই লাখ টাকায় কিনে উড়াল দিই। অনেকটা সময় পিছিয়ে গেছি। আর পিছিয়ে যেতে ইচ্ছুক নই।