বিদেশে প্রশিক্ষণে সরকারি বাধা

চীনের অধ্যাপক মিংয়ের সঙ্গে লেখকছবি: লেখকের পাঠানো

প্যারিসের বিখ্যাত বিসেট হাসপাতালে নিউরোলজির বিশেষায়িত শাখা ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজিতে ফেলোশিপ করছি। স্ট্রোক ও কাটাছেঁড়া ছাড়াই মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার নিয়ে কাজ করে এ শাখা। আমি যে হাসপাতালে কাজ করছি, সেখানে কাজ করেছে এ শাখার নামকরা চিকিৎসকেরা। এ ক্যাথল্যাব থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি।

আমার সঙ্গে এখানে ফেলোশিপ করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঁচজন চিকিৎসক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এন্ডারসন, চিলি থেকে এসেছে এন্ড্রেস সিলভা, মিসরের মুহাম্মদ ইসমাইল, চীনের মিং ওয়েং ও ফ্রান্সের আলেকজান্ডার।

আমি এখানে আসার পর তাদের মধ্যে প্রথম যার সঙ্গে পরিচয় হয়, সে হলো চীনের মিং। অধ্যাপক লরেন্ট স্পিল আমাকে মিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ফেলোদের রুমে ল্যাপটপে কী যেন কাজ করছিল সে। অন্যরা ক্যাথল্যাবে কাজ করছিল। মিং আমাকে বলল, তুমি কি ক্যাথল্যাবে যেতে চাও?

ওর কথা শেষ না হতেই আমি বললাম, অবশ্যই, কেন নয়!

এত কষ্ট করে, এত অপেক্ষার পর এসেছি ক্যাথল্যাবে কাজ দেখার জন্যই। গত দিন ১৬ ঘণ্টা প্লেন জার্নি করে রাতে এসেছি প্যারিসে। মাত্র ৩ ঘণ্টা ঘুমিয়ে সকালেই চলে এসেছি। কোনো ক্লান্তি নেই যেন।

মিং আমাকে অপারেশনের ড্রেস চেঞ্জ করার জায়গায় নিয়ে যায়। চীনের মানুষের সঙ্গে আগে কখনো পরিচয় হয়নি। মিংকে দেখে ভালোই লাগল।

মিসরের মুহাম্মদ ইসমাইল খুবই ভালো ছেলে। মানুষকে সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকে। এত ভালো মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।

আমি যতটা না আগ্রহ নিয়ে ক্যাথল্যাবে যাই, মিংকে অত আগ্রহী দেখি না। বরং ল্যাপটপে রিসার্চের কাজই করে বেশি। ইসমাইল আমাকে একদিন বলল, মিং চীনের বেশ নামকরা চিকিৎসক। তখনই আমার আগ্রহ জন্মায়, তাহলে সে এখানে কেন?

আমি বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতাম। একদিন বাংলাদেশি হোটেল থেকে বিরিয়ানি নিয়ে গিয়েছি। মিংকে খাবারের অফার করলাম। সে খেয়ে এত্ত মজা পেয়েছে যে খাবারের পর নেটে সার্চ করে দেখল কীভাবে রান্না করতে হয়। চীনে ফিরে গিয়ে বিরিয়ানি রান্না করবে। এর পর থেকে মাঝেমধ্যে বিরিয়ানি খেতে চাইত। সেদিনের পর থেকে প্রতিদিনই আমি ওকে খাবার অফার করতাম। খুব মজা করে খেত। এর মধ্যে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। একদিন খাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি এখানে এসেছ কেন? তুমি তো নিজেই কাজ করছ?

সে যা বলল, তা আমি কল্পনাও করিনি। সে বলল, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আগে অনেক চীনের ছেলেমেয়েরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের জন্য যেত। এখন তো বন্ধ। তাই তাদের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াবে। তাদের চিকিৎসাসংক্রান্ত অথরিটি থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিবছর ইউরোপে ছাত্র পাঠাবে। এতে যাঁরা নামকরা প্রফেসর, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক হবে, যা পরের প্রজন্ম কাজে লাগাবে। সে জানায়, চীনে ফিরে গিয়ে এখানের প্রফেসরকে নিয়ে প্রোগ্রাম করবে। এখান থেকে সপ্তাহখানেকের জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানে যাবে অন্য একজন প্রফেসরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে। সে জানাল, চীনের অন্য একজন চিকিৎসক অন্য একটি হাসপাতালে কাজ করছে।

আমি জানতে চাইলাম, তুমি যে এখানে ছয় মাসের জন্য আছ, তোমার খরচ হচ্ছে তো অনেক!

সে বলল, আমাকে সরকার থেকে প্রতি মাসে দুই হাজার ইউরো করে দেয়।

দুই হাজার ইউরো মানে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন লাখ টাকা। বেশ ভালোভাবেই চলা যায়। মিসরের ইসমাইলকেও সরকার টাকা দিচ্ছে।

আমি মিংয়ের কথা শুনে অবাক হলাম। সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, যেটা মিংকে এড়াল না। সে জানতে চাইল, তোমাকে সরকার সাহায্য করছে, তাই না?

আমি শুধু শুষ্ক হাসি হাসলাম। এখানে আসতে আমাকে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা আমি জানি। আমি তিন বছর ধরে প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছি; শুধু একটা বিদেশি স্কলারশিপ পাব বলে। কিন্তু একজন ভারতীয় আমাকে কোনোভাবেই স্কলারশিপ পেতে দেয়নি। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিই টাকা ম্যানেজ করব। তিন বছর ধরে কষ্ট করে টাকা জমিয়েছি। ইউরোপে তিন মাস থাকতে অনেক টাকার প্রয়োজন।

তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও পুরো টাকা জমাতে পারিনি। সপ্তাহে সাত দিন কাজ করেছি। একটা দিন অবসর পাইনি। শেষ মুহূর্তেও টাকার সংকট দেখা দেয়। আমার পাশে এসে দাঁড়ান তিনজন মহান ব্যক্তি। আমার দুজন শিক্ষক ও আমার বড় ভাই। একজন শিক্ষক ভালো একটা স্পনসরশিপ জোগাড় করে দেন। আমার বড় ভাই নেদারল্যান্ডস থাকেন। এ জন্য সাহস ছিল। টাকার সমস্যা হলে ভাই তো আছেই। ভিসা জটিলতায় টিকিট কাটা নিয়ে দোটানায় ছিলাম। এদিকে টিকিটের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। দেড় লাখ টাকার টিকিট হয়ে যায় আড়াই লাখ টাকা। আমি যে বাজেট করেছিলাম, এক লাখ টাকা শুরুতেই ঘাটতি দেখা দেয়। আমার একজন শিক্ষক একদিন আমাকে ডেকে এক হাজার ডলার ধরিয়ে দেন। আমি শতবার না করলেও স্যার ডলার দেবেনই। আমি এই তিনজন মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার অ্যাকাউন্টে এখন গত তিন মাসের বেতন মাত্র।

সবচেয়ে বেশি টেনশনে ছিলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছুটি পাব কি না? টাকা ম্যানেজ করতে পারলেও ছুটি পাব, তার নিশ্চয়তা নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে মনে হয় শুধু চিকিৎসকেরা আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ না করলে দেশের রিজার্ভ হু হু করে বাড়বে। চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়ার জন্য কত প্রকার নিয়মকানুন করেছে, তার ইয়াত্তা নেই। মন্ত্রণালয় নিয়ম করেছে, কোনো চিকিৎসক বছরে দুবারের বেশি বিদেশি সেমিনারে যেতে পারবে না। বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য যেতে হলে আয়োজনকারী সংস্থাকেই এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন তারা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের বাসা থেকে নিয়ে যাবে আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবে। মানে প্লেন, হোটেল, খাওয়াদাওয়ার—সবকিছু আয়োজনকারী সংস্থাকে বহন করতে হবে। অন্য কেউ করলে হবে না। এমনো হয়েছে যে তৃতীয় কোনো সংস্থা খরচ বহন করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় মানতে রাজি না। আবার প্লেন ও হোটেলের ব্যবস্থা করবে আয়োজনকারী সংস্থা। কিন্তু কেন খাবার দেবে না, এ জন্য ছুটি বাতিল।

বিদেশিদের কী এমন দায় পড়েছে যে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের এত্ত জামাই আদর করতে হবে। ভালো সম্পর্কের কারণে তারা এমনটা করতে রাজি হলেও ছুটি মিলবে কি না বলা কঠিন। মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হয়। হাতজোড় করে জি হুজুর জি হুজুর করতে হয়। তারপরও চিকিৎসকদের ছুটি মেলে না।

ফ্রান্সের একটি সংস্থা আমাকে সব খরচ বহন বলে চিঠি দেয়। প্রোগ্রাম হবে থাইল্যান্ডে। আমি দুই মাস আগে ছুটির জন্য আবেদন করি। কিন্তু ছুটি মেলে না। ফ্লাইটের ১৫ দিন আগে মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করে ছুটির ব্যবস্থা করলেও সময়ের কারণে ভিসা না পাওয়ায় সে প্রোগ্রামে যেতে পারিনি। এর পর থেকে আর তারা আমাকে স্কলারশিপ দেয়নি।

প্যারিসের একটি সংস্থা বছর দেড়েক আগে দিল্লির একটি প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য সব খরচ বহনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু ছুটি না পাওয়ায় আমি যেতে পারিনি। তারাও আর আমাকে কোনো দিন ডাকেনি।

আয়োজনকারী সংস্থ খরচ বহন করবে—এমনটা লিখে দেওয়ার জন্য চিকিৎসকেরা প্রশিক্ষকের কাছে মেইল করেন। প্রশিক্ষক খুব অবাক হন। মিথ্যা কথা তারা কেন লিখবে, ভেবে পান না। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের মধ্যে খারাপ ধারনা জন্মায়। পরে অন্য কেউ প্রশিক্ষণে যেতে চাইলে নেন না।

তিন বছর কেন প্রশিক্ষণে যেতে পারিনি, এটাও অন্যতম কারণ। বিদেশি স্কলারশিপ ম্যানেজ করা ছাড়া তো ছুটি সম্ভব নয়। অবশেষে আমাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। আমাদের সোসাইটি থেকে একটি চিঠি লিখে নিই যে তারা আমার সব খরচ বহন করবে। তারপরও টেনশনে ছিলাম, আদৌ ছুটি পাব কি না। আল্লাহর অশেষ রহমতে ছুটির ব্যবস্থা হয়। এ জন্য আমাকে ক্ষমতাধর মানুষের সহায়তা নিতে হয়েছে।

আমাদের এ অবস্থা কাটবে কবে? চীন কীভাবে আগে থেকেই ব্যবস্থা করছে।

চিকিৎসকেরা যদি দেশের বাইরে না যান, তাহলে নতুন টেকনোলজি শিখবেন কীভাবে?

প্যারিসে একটি সেমিনারে পরিচয় হলো জার্মানির খুব নামকরা চিকিৎসক প্রফেসর রেনে সাপোর সঙ্গে। তিনি নতুন অনেকগুলো চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তাঁকে জানালাম, আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাই। রাজি হলেন। দুই সপ্তাহের জন্য গেলাম জার্মানিতে। অতিরিক্ত টাকা খরচ হলেও আমার ভালো লেগেছে। তাঁর কাছে দুই সপ্তাহে যা শিখেছি, তা দেশের মানুষের চিকিৎসায় অনেক কাজে দেবে। আমি নতুন যা শিখেছি, তা আমার ছাত্রদের শেখাব। আমি যত সুক্ষভাবে কাজ করতে পারব, তারা আমার চেয়ে বেশি দক্ষ হবে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নতুন চিকিৎসা চলে আসে।

প্যারিসের সেমিনারে পরিচিয় হয় ভিয়েতনামের প্রফেসর কোয়াংয়ের সঙ্গে। ভিয়েতনামে খুব নামকরা তিনি। জুনে ভিয়েতনামে স্ট্রোকের একটি সেমিনারের আয়োজন করেন তিনি।

আমার একজন ছাত্রকে সব খরচ বহনের করে সেমিনারে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে আনুরোধ করি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন। পরদিনই তিনি সব খরচ বহনের অফার লেটার আমাকে ই–মেইল করেন।

এত কষ্ট করে চিকিৎসকেরা দেশের বাইরে থেকে নতুন কিছু শিখে এসে দেশের মানুষের চিকিৎসা করেন। দেশে যে চিকিৎসা হয়, তা কিন্তু চিকিৎসকেরা বিদেশ থেকে এভাবে খেয়ে না খেয়ে শিখে আসেন। কিন্তু কেন তাঁদের বিদেশে যেতে বাধা দিতে হবে, তা আমার বোধগম্য নয়।

আরও পড়ুন

অনেকে বলেন, চিকিৎসকেরা সেমিনারের নামে হানিমুন ট্রিপে যান। সেমিনারে যে আলাপ হয়, তা শুনলেও অনেক জ্ঞান বাড়ে। আর বাইরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে তা দেশের জন্য কাজে লাগে। সেমিনারের পর ঘোরাঘুরি কি খুব ক্ষতি?

দেশের স্বার্থে চিকিৎসকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না করে সরকার তো সহায়তা করছেই না, উল্টো বিভিন্নভাবে চিকিৎসকদের হয়রানি করছে। চলবে...

*হুমায়ুন কবীর হিমু, চিকিৎসক, সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]