স্মৃতিগদ্য: একাত্তরের স্মৃতি

একাত্তরের এই লড়াকু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশছবি: অমিয় তরফদার

একাত্তর সালে ক্লাস এইটে ছিলাম আমি। আপা তখন স্বামীবাগে থাকতেন। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ দুপুরে আব্বা, মা, ছোট বোন বেবী ও আমি আপার বাসায় বেড়াতে যাই। সন্ধ্যার পর সবাই নারায়ণগঞ্জ চলে গেলে আমি আপার বাসায় থেকে যাই। প্রতিবছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল ছুটিতে আপার বাসায় গিয়েছি আমি ও বেবী। দুলাভাইয়ের সঙ্গে মধুমিতা সিনেমা হলে ‘যে আগুনে পুড়ি’ ছবিটা দেখেছিলাম তখন। আপার বাসার পূর্ব দিকে রেললাইন, রেললাইনের পূর্ব দিকে পৌরসভা আবর্জনা ফেলে ভরাট করছিল তখন। বাতাসে উড়ে আসে ভয়াবহ উৎকট গন্ধ, সেই সঙ্গে ছিল মাছির উৎপাত। ওই দিন মধ্যরাতের পর ২৬ মার্চ রাতে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ। সারা রাত শুনেছি গুলির শব্দ। বাসার ঠিক দক্ষিণে ছিল পুকুর। পুকুরটি এখন আর নেই। কারফিউ শিথিল হলে এই পুকুরের পূর্ব দিকে রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে বাজারে যাই। সুনসান বাজার, মানুষের মনে ভয়। যুদ্ধ শুরুর পর কারফিউ শিথিল হলে বড়দা আপার বাসায় আসেন আমাদের নিতে। যুদ্ধের ভয়াবহতা উপেক্ষা করে এবং নিজের জীবন বাজি রেখে বড়দা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছেন আমাদের নিতে। বড়দার মনে কি ভয় ছিল না তখন? এটাই কি রক্তের টান? বড়দা আজ না ফেরার দেশে! ইতিমধ্যে আব্বা-মা সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছেন। দুলাভাইয়ের ছোট বোন, তাঁর স্বামী ও শিশুকন্যা আমাদের সফর সঙ্গী। দুলাভাইয়ের বোন ও ভগ্নিপতি করোনাকালে চলে গেছেন না–ফেরার দেশে। প্রথমে স্কুটারে চেপে আমরা নারায়ণগঞ্জে মসজিদ খানপুরের বাসায় আসি। তখন স্কুটারকে বেবিট্যাক্সি বলা হতো।

যুদ্ধের আগেই আমাদের প্রতিবেশী চিকিৎসক রোস্তম আলী হামিদ মিয়ার বাসা ছেড়ে আজিম দালালের আজমিরী মঞ্জিলে বাসা নেন। নিঃসন্তান হামিদ মিয়া মৃত্যুর আগে তাঁর স্থাবর সব সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছেন। চিকিৎসক রোস্তম আলী চলে যাওয়ার পর তাঁর বাসাটি খানপুর এলাকার অধিপতিরা দখল নেয়। বাসাটি হয় পোল স্টার ক্লাবের স্থায়ী ঠিকানা। প্রাণভয়ে ভীত হয়ে ঢাকা থেকে আসার পর বাসায় ঢোকার সময় পোল স্টার ক্লাবের জানালায় চোখ রাখলে দেখি ঘরের ভেতরে বাসাবাড়ির তৈজসপত্র, আসবাবে ঘরটি ঠাসা। ক্লাবের ভেতর এসব কেন? ভাবনার রাজত্বে আমি ঘুরপাক খাই। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও যেন ভয় কাজ করে। নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেই। বড়দা গেটের তালা খুললে আমরা সবাই অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের পথ কি এমনই অন্ধকার? নিজের বাসায় এসে কিছুটা সাহস ফিরে পাই। আব্বার বড় একটি দেয়ালঘড়ি ছিল। আব্বা যখন ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়তেন, ঘড়িটি সেই সময়ের। ঘড়িটিতে আব্বা প্রতি সপ্তাহে একবার চাবি দিতেন, বড়দাও দিয়েছেন, এরপর আমিও টুলের ওপর দাঁড়িয়ে চাবি দিয়েছি নিয়মিত। ঘড়িটি সঙ্গে নিয়ে আমরা সবাই রিকশায় নবীগঞ্জ ঘাটে যাই। আব্বা মায়ের ঠিকানায় চলে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ ঘড়িটি নিরুদ্দেশ হয়। অজানা ঠিকানায় ঘড়িটি কি আগের মতো শব্দ করে ঘণ্টা বাজিয়ে আব্বার রেখে যাওয়া স্মৃতির কথা বলে?

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com

বরফকল নামের নবীগঞ্জ ঘাট থেকে বড়দা নৌকা ভাড়া করার পর নদীপথে আমরা বিক্রমপুরে লৌহজং থানার গাওদিয়া গ্রামে (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) যাওয়ার জন্য রওনা হই। নৌকা থেকে দেখেছি, নদীতে নারী-পুরুষের অসংখ্য লাশ ভাসছিল। নদীর পানিতে প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী নারীর দেহ চিত হয়ে ভাসছিল, আর পুরুষের দেহ উপুড় হয়ে। তৃষিত হলে নদী থেকেই পানি খাই মাঝির দেওয়া পাত্র থেকে। শরীরে জল গ্রহণের পর আবার জলবিয়োগের চাপ হলে মাঝি মাঝেমধ্যে নৌকা থামান। রাতে নৌকা থেকে নামার পর অন্ধকারকে সাথি করে দীর্ঘ পথ হেঁটে মধ্যরাতে বাড়ি পৌঁছাই। অন্ধকারই আমাদের পথ দেখিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। দরজার কাছে গিয়ে শব্দ করে ডাকতেই আব্বা-মা হারিকেন হাতে নিয়ে দরজা খোলেন। তাঁদের অন্তর হয়তো জানত, আমরা আজ রাতেই ফিরব। এ জন্য ঘুম তাড়িয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আশপাশের সবাই দরজা খুলে হারিকেন হাতে কাছে আসেন, আমাদের দেখার জন্য। ঘুমভাঙা চোখে বিস্মিত হয়ে সবাই দেখেন আমাদের। আমাদের গায়ে কি বারুদের গন্ধ! সবার বিস্মিত মনে একটাই প্রশ্ন, ঢাকার কী খবর? আমাদের সব আত্মীয়র সঙ্গে মা দুলাভাইয়ের বোন-ভগ্নিপতির পরিচয় করিয়ে দেন। অল্প কিছুদিন পরই তাঁরা সপরিবার পদ্মা নদী হয়ে যশোর চলে যান।

আরও পড়ুন

ব্যাটারিচালিত রেডিও থেকে সবাই বিবিসির বাংলা শুনত। চরমপত্র শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত সবাই। উঠানে সবাই একত্র হয়ে আমাদের রেডিও থেকে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শুনত। উদ্দীপনামূলক গান শুনত, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’। কিছুদিন পর মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্য বাড়িতে এসে আব্বাকে বললেন, ‘আমরা আপনার বন্দুক ও পিস্তলটি চাই।’ খুব ভোরে মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে নাম না জানা এর বাড়ি ওর বাড়ি যান। এরপর আমরা সবাই যুদ্ধের সময়ই গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি। শীতলক্ষ্যায় আব্বার ব্যবসার অফিস (গদি) ছিল। অফিসসংলগ্ন বিশাল তিনটি রুম। বিভিন্ন জিলা থেকে পাট নিয়ে ব্যাপারীরা আসতেন। সঙ্গে আমাদের জন্য বড় মাটির পাতিলে নিয়ে আসতেন টাঙ্গাইলের চমচম, মুক্তাগাছার মণ্ডা। ‘পুরোনো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়...’। তাঁদের রাতযাপনের জন্যই ছিল বিশাল এই আয়োজন। তখন গদির ওপরতলা খালি ছিল। আমরা গ্রাম থেকে খানপুরের বাসায় না গিয়ে শীতলক্ষ্যায় আব্বার অফিসের ওপরতলায় আশ্রয় নিই। আমাদের সঙ্গে চেয়ারম্যান কাকাও (আবদুল আজিজ) ছিলেন সপরিবার। আজিজ কাকা গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রায় দুই যুগ। এ জন্য তিনি সবার কাছেই চেয়ারম্যান। আমাদের কাছে চেয়ারম্যান কাকা। তিনি চলে গেছেন না–ফেরার দেশে। এখানেও আসে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপ। আব্বাকে বলেন, আপনার চেয়ারম্যান ভাই কোথায়? আব্বা বলেন, চেয়ারম্যান কোথায়, আমি কী জানি! না, আপনিই তাঁর ঠিকানা জানেন। আব্বা শেষ উত্তর ছিল, তাঁর কাছে পৌঁছাতে হলে আমার রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। আর এ জন্যই হয়তো আমাদের সবার তিনতলা থেকে দোতলায় আসা নিষেধ ছিল। স্বাধীনতার আগেই আমরা আবার খানপুরের বাসায় চলে আসি।

১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে আব্বা বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল, সবুজ, হলুদ রঙের পতাকা উত্তোলন করেন। ভেবে অবাক হই, মার্চের আগেই আব্বা পতাকাটি নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন। তাহলে আব্বা কি বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের স্বপ্ন দেখতেন?

আরও পড়ুন