একগুচ্ছ অণুগল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

১. আনন্দ
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আম-কাঁঠালের ছুটিতে গ্রামে দাদার বাড়ি গিয়েছিলাম। দাদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদি, আপনি আমাদের বাসায় না থেকে গ্রামের বাড়িতে একা একা থাকেন কেন? আমাদের বাসায় সব সময় থাকলেই তো পারেন।
গ্রামের বাড়িতে থাকলে তো তর দাদারে দেখতে পাই।
ঢাকায় আমাদের বাসায় থাকলে দাদাকে দেখতে পান না?
না, হেয় ওইহানে যায় না।
দাদা কি আপনাকে আদর করত?
আমারে আদর না করলে আমি কি ওই বুড়াডার কাছে থাকতাম!
মুরগি কক্কর কক্কর শব্দ করে ঘুর ঘুর করলে দাদি বলতেন, অই সর সর, মুরগি ডিম পাড়ব। মুরগিরে ঘরে যাইতে দে।
বেশ কিছুদিন পর দাদি মুরগিকে ডিম তা দিতে বসালেন। তায়ের সময় শেষ হলে মুরগির ছানাগুলো পৃথিবী দেখার আনন্দে উল্লাসে খোসা ভেঙে বাইরে এসে লাফালাফি করে। অবশিষ্ট দু–একটা ডিমে মুরগি ঠোকর দিয়ে খোসা ভেঙে দিলে ছানারা চেঁচামেচি করে তাদের মাকে দেখার আনন্দে।

২. অপয়া
দীর্ঘদিন পর হৃদয়ের সঙ্গে মুক্তার দেখা বাণিজ্য মেলায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সহপাঠী ছিল। বিয়ের এক যুগ পর নিঃসন্তান দম্পতির ছাড়াছাড়ি হয়। মুক্তার সঙ্গে সাত-আট বছরের এক বালককে দেখে হৃদয় বিস্মিত নয়নে প্রশ্ন করে, কেমন আছ তুমি? কোথায় থাকো এখন?
হুম, ভালো। আমি স্বামীর সঙ্গে জার্মানি থাকি। আমার ছেলে অনিক।
হৃদয় বিস্মিত হয়ে বলে, তাহলে?
হ্যাঁ, তোমার সংসারে আমার ব্যর্থতা আকাশসমান। সন্তানহীনতার কারণে তোমার মা–বাবা আমাকেই দায়ী করতেন। তোমার পিতার অলিখিত কোনো পাপ তোমাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে হয়তো। এ জন্যই আমি তোমার বাড়িতে ছিলাম অপয়া। তোমার মা আমার মুখ দেখতে চাইতেন না। বলতেন, আমার মুখ দেখলে তিনি অসুস্থ বোধ করেন।
হৃদয়ের অন্তর কালো করে অযাচিত মেঘের এক ছায়া নেমে আসে তার চেহারায়। নিষ্পলক বাকরুদ্ধ হয়ে হাত নেড়ে ভিড় ঠেলে হারিয়ে যায় সে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে।

৩. নাগরিকত্ব
বাবা–মায়ের একমাত্র কন্যাসন্তান উশিন চীন থেকে টরন্টোয় এসে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরি খুঁজছে এখন। চীনে আগে ছিল এক সন্তান নীতি। সরকার বর্তমানে দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণে অনুমতি দিয়েছে। উশিন মনে করে, ভবিষ্যতে তৃতীয় সন্তান গ্রহণে রাষ্ট্র ও সরকার নমনীয় হবে।

পঠিত বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পেয়ে উশিন একটি চায়নিজ গ্রোসারি স্টোরে সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে। তার বাবা–মায়ের ইচ্ছা, ‘গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়েছে, তা হলে দেশে চলে এসো।’ উশিনের ইচ্ছা বেশ কিছুদিন চাকরি করে কানাডায় রেসিডেন্স পারমিশনের জন্য আবেদন করবে। রেসিডেন্স পারমিশন পেলে কানাডার নাগরিক হওয়ার পথ ত্বরান্বিত হবে। উশিনের বাবা জানিয়েছেন, দেশে ফিরে না গেলে তিনি কন্যাকে আর কোনো টাকা পাঠাবেন না। পিতা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়।

তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের একটি বেডরুমের ভাড়া ৯৫০ ডলার। বাবা–মায়ের হৃদয়ের আকুলতা উপেক্ষা করে নাগরিকত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় থাকা, খাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য উশিনকে এখন অড জব করতে হচ্ছে। শীর্তের সকালে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস টেম্পারেচারে কাজে যাওয়ার সময় জীবনের তাপে পুড়ে উশিন ভাবে, আমার জন্য কি তাদের মন পোড়ে? আমার শূন্যতায় তারা কি কাঁদে? বাবা-মায়ের মতামত উপেক্ষা করলে কি জীবনের পথ বন্ধুর হয়ে যায়?

৪. নিয়তি
রৌদ্র তার বাবাকে ডাকছে, বাবা দেখে যাও কবুতর বারান্দায় বাসা করেছে। রৌদ্রর বাবা বারান্দায় এসে দেখেন, ঠোঁটে বহনযোগ্য ছোট পাতলা, শুকনা ডাল এনে গোল করে অনেক যত্নে খুব সুন্দর একটা বাসা বানিয়েছে কবুতর। ডিম থেকে বাচ্চার আশায় মা পাখির স্বপ্নের বুনন দেখে তিনি বিস্মিত হন। দেখেন, রৌদ্র তার দুই হাতে ডিসপোজেবল হ্যান্ড গ্লাভস নিয়ে প্লাস্টিক ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার মায়ের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর টিম ও বুলডোজার নিয়ে যেমন করে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করেন। হুম, রেলিংয়ে কবুতরটা দেখে তখনই আমার মনে হয়েছিল, তোমাকে বলেছিলাম, পাখিটা তাড়াও, মনে হয় ডিম দেবে।

বিল্ডিংয়ের ম্যানেজমেন্ট অফিস বারান্দার ব্যালকনি রেনোভেট করার জন্য চিঠি দিয়েছে, বারান্দায় তোমার ব্যবহৃত জিনিস নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সরিয়ে বেজমেন্টের লেবেল পি-থ্রিতে (মাটির নিচের তৃতীয় তলায়) অবস্থিত লকারে নিয়ে রাখো। তোমার বারান্দায় প্রবেশের দরজা টেম্পোরারি সিল করে দেওয়া হবে। তুমি বারান্দায় যেতে পারবে না। তোমার মালামাল তুমি নিজ দায়িত্বে সরিয়ে না নিলে কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কাররা সব ফেলে দেবেন। রৌদ্রর বাবা গত সামারে লাউ ও পুঁইগাছ লাগিয়েছিলেন। মাটিসহ ১২-১৩টা প্লাস্টিক কনটেইনার রয়েছে। তারই আড়ালে পাখি বেচারি ডিম পাড়ার জন্য স্বপ্ন রচনা করেছিল। কষ্টে রচিত বাসাটি ফেলে দেওয়ার পর নিরুপায় হয়ে কবুতর প্লাস্টিক কনটেইনারে দুটো ডিম পেড়ে মহানন্দে স্বপ্ন বাস্তবায়নে রত। বিল্ডিংয়ের অফিস থেকে রৌদ্রর বাবার সেলে ফোন আসে, হ্যালো, আমি পলিন। তোমার ব্যালকনি থেকে তোমার বিলংগিং আইটেম সরিয়ে না নিলে ওয়ার্কাররা সব ফেলে দেবে। হ্যাঁ জানি, কবুতর দুটো ডিম দিয়ে তা দিচ্ছে। কী করা যায়? ইট দেম।

রৌদ্র তার বাবাকে বলে, বাবা, এটা তো সো স্যাড! আল্লাহ পাখিকে বলে দিলে পাখিটা অন্য কোথাও গিয়ে ডিম পারতে পারত।
*লেখক: কামাল উদ্দিন, টরন্টো, কানাডা