বয়কট বনাম বিদেশপ্রীতি!

এবারের মাসব্যাপী বাংলাদেশ সফরকালে রমজানের শুরুতে মুরগি ও মাছ কিনতে গিয়েছিলাম সাহেবপাড়া (সিদ্ধিরগঞ্জ) কাঁচাবাজারে। দোকানি কয়েক ধরনের মুরগি দেখিয়ে বললেন, ‘এখন সব ক্রেতা পাকিস্তানি মুরগিটা বেশি টানেন।’ বললাম, ‘এই মুরগি যে পাকিস্তানি, সেটি কী করে বুঝব? তা ছাড়া পাকিস্তানি মুরগি যে বেশি সুস্বাদু, তারই-বা প্রমাণ কী? এসব কল্পকাহিনি বলে ক্রেতার মন পেতে চেষ্টা কোরো না’, বলেই চলে গেলাম পাশের দোকানে।

সেই দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার মুরগিও কি পাকিস্তানি?’ লোকটি নিম্ন স্বরে বলল, ‘স্যার, একটা সত্য কথা বলি। আমাগো কারও মুরগিই পাকিস্তানি না। ভারতীয় পণ্য বয়কটের কারণে পাকিস্তানি নামটা বললে ক্রেতার আগ্রহ বেড়ে যায়। এ ছাড়া কিছু না।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাংলাদেশি বললে সমস্যা কী? স্বদেশি পণ্যে বিদেশি ট্যাগ লাগিয়ে বিক্রি করা তো অপরাধ।’ লোকটি উত্তর দিলেন, ‘ স্যার, মনে কিছু নিবেন না । এ জন্য কাস্টমাররাই দায়ী। বাংলাদেশ কইলে কেউ কিনবার চায় না। আমাগো বেচা অইল কতা। অবশ্য পাকিস্তানি জাতের বলে একধরনের মুরগি বহু আগে থেকেই পরিচিত।’

এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, ভারতীয় পণ্য বয়কটের বহু আগে থেকেই বাঙালিরা মনে মনে বাংলাদেশি পণ্য বয়কট করে রেখেছেন। এই রোগ আমারও ছিল। ঢাকায় থাকাকালে শপিং করতে গেলে দোকানিরা বলতেন, ‘প্যান্ট পিসটা জাপানি, শার্ট পিসটা থাইল্যান্ডের।’ বন্ধুরা বলত, হ্যাঁ এটি পিউর জাপানি! একবার ভেবেও দেখিনি, জাপানিদের ঘণ্টায় আয় কত। রপ্তানি বাণিজ্যে জাপানিরা পোশাকশিল্পে খ্যাত বাংলাদেশে কোনো শার্ট, প্যান্ট বা শাড়ি বিক্রি করে কি না। টয়োটা, হোন্ডা, নিশান ইত্যাদি গাড়ি শিল্প বা উঁচু মানের ইলেকট্রনিক আইটেম রপ্তানির দেশ জাপান এর শ্রমিক খরচ আকাশচুম্বী, বিষয়টি কখনো মাথায় আসেনি। মিথ্যা কথা বলে বাঙালি দোকানিরা আমার দেশেরই পোশাক বিক্রি করতেন আমার কাছে। আমরা কত বোকা! দোকানিরা বাংলাদেশের নাম বললে প্যান্ট ও শার্ট পিস ছুড়ে দিয়ে বলতাম, ‘থাই বা জাপানিটা থাকলে দেখান।’ কী জঘন্য! অথচ স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস ও বিজয় দিবসে আমরা দেশমাতৃকাকে ভালোবাসার কী অভিনয়টাই না করি!

আজ যখন কানাডার নামকরা স্টোর-ফ্র্যাঞ্চাইজিতে শার্ট, প্যান্ট বা জ্যাকেট কিনতে গিয়ে দেখি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’, গর্বে বুকটা ভরে যায়। চোখের সামনে সব কমিউনিটির মানুষ কিনে নিচ্ছেন আমার দেশে তৈরি পোশাক। কানাডাসহ পৃথিবীর সব দেশ থেকে ডলার যাচ্ছে বাংলাদেশে। আমরা যদি দেশীয় পণ্য ব্যবহার করি, তবে তো দেশের মুদ্রা দেশেই থাকে! আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেড়ে গেলেই দেশ এগিয়ে যাবে! সে ক্ষেত্রে যেসব পণ্য বয়কট করা উচিত তা করব, আর নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে যা আমদানি করার, তা করব।

লেখক: শিক্ষক, টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড, কানাডা  

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]