কিশোর গ্যাং—মুক্তি কীভাবে

কিশোর গ্যাংপ্রতীকী ছবি

২০০০ সালে শাহরুখ খান ও ঐশ্বরিয়া রাইয়ের একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল, ‘জোশ’। শাহরুখ খান সেখানে এলাকার গুন্ডা, স্থানীয় দুই গ্যাঙের মধ্যকার কামড়াকামড়ি নিয়ে সিনেমার কাহিনি এগোয়।

সিনেমাটি বক্স অফিসে কিছু করতে পেরেছিল কি না মনে নেই, তবে আমাদের দেশে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান সম্ভবত সেই সিনেমার পর থেকে। এক এলাকার কুত্তা (ইচ্ছা করেই কুকুর শব্দটি ব্যবহার করলাম না) অন্য এলাকায় গেলে দেখবেন স্থানীয় কুত্তাগুলো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। ‘জোশ’ সিনেমায়ও একই ব্যাপার দেখানো হয়েছে। দুই এলাকার দুই গ্যাংয়ের এলাকা ভাগ করা থাকে। অমুক দলের কেউ তমুক এলাকায় গেলেই মারধর শুরু হয়।

২০০১ সালে এসএসসি শেষে যখন আমি ঢাকায় ফুফুর বাড়িতে গেলাম, দেখি সেই অ্যাপার্টমেন্টে কমপ্লেক্সের শিশুদের মধ্যেও নেড়িকুত্তার এই স্বভাব ঢুকে গেছে। ওদেরও দুটি আলাদা গ্যাং আছে এবং এই দলের ছেলে ওই দলের এলাকায় যেতে পারবে না।

ধীরে ধীরে দেখলাম, গোটা মহল্লাতেও ঘটনা এক। সব শিশু–কিশোরের দল, এলাকার ‘বড় ভাইরা’ ওদের আইডল। বড় ভাইরা স্থানীয় চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়, বিড়ি–সিগারেট, মদ-মাদক খায়, ওরা চ্যালা–চামচামি করে। বড় ভাইরা অমুক তমুকের সঙ্গে ‘গ্যাঞ্জামের’ কাহিনি শোনায়, ওরা মুগ্ধ হয়ে শোনে। নিজেদের গ্যাঞ্জামও ওরা সেভাবেই মেটায়।

অমুকের তমুক মেয়েকে পছন্দ। নিজের ক্ষমতা নেই মেয়েটাকে গিয়ে সরাসরি বলার, পটাবার, প্রেম করার। ভদ্রঘরের মেয়ে। ওর কাছে অমুক হচ্ছে রাস্তার ছ্যাঁচড়া পোলার বেশি কিছু না। তার পছন্দ ভদ্রস্থ ঘরের সন্তান। হয়তো কোনো ছেলেকে সে পছন্দও করে।

আরও পড়ুন

কথাটা যখন অমুকের কানে যায়, সে গিয়ে সেই ভদ্র ছেলেটার ওপর আক্রমণ করে। ক্ষমতা অনুযায়ী হয় থ্রেট দেবে, না হয় মারধর করবে। মেয়েটা থেকে দূরে থাকতে বলে।

আমাদের যুগে এসব ঘটনা কেবল গার্লফ্রেন্ডকেন্দ্রিক ছিল। এখন এই কিশোর গ্যাংয়ের পোলাপান চাঁদাবাজি করে, খুনাখুনিও করে। চিটাগংয়েই অতি সম্প্রতি এক চিকিৎসককে খুন করেছে ওরা। জানা গেছে, এলাকায় ওদের টর্চার সেলও আছে, কেউ যদি ওদের কথাবার্তা না শোনে, সেখানে নিয়ে মারধর করা নিয়মিত ঘটনা। গোটা শহরে কয়েক শ কিশোর গ্যাং আছে, যাদের সদস্যসংখ্যা ৫-১৫, এবং সবাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক ছায়ায় লালিত হয়ে আসছে। এটি অবশ্য এমনিতেও বোঝা যায়। রাজনৈতিক প্রশ্রয় না পেলে শিশু–কিশোরদের গ্যাং এমন বেপরোয়া আর নাগালের বাইরে চলে যেত না।

আপনি বলতে পারেন, পুরো দায় পরিবারের। কিন্তু আপনি আপনার ছেলেকে ভদ্র ছেলে বানান, সে রাস্তায় গিয়ে দিনরাত মার খাবে, বাড়িতে এসে আপনাকে বলবে, আপনি সর্বোচ্চ কী করতে পারবেন? পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, অভিভাবকদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই—আপনার ছেলে তখন আত্মরক্ষার জন্যই অন্য কোনো গ্যাংয়ে যোগ দেবে। এভাবেই কিশোর গ্যাংগুলো গড়ে উঠেছে এবং শক্তিশালী হয়েছে।

এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

একযোগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে প্রশাসন, কোথাও যদি কেউ নিজের কাজে ফাঁকি দেয়, তাহলে পুরো সিস্টেমটা ভেঙে পড়বে।

১.

পরিবারগুলো নিজেদের শিশুদের বেশি বেশি সময় দেবে। টাকাপয়সা উপার্জন, চিত্তবিনোদন সব যার যার জায়গায় ঠিক আছে; কিন্তু আমার সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কাদের সঙ্গে খেলছে, কাকে পীর মানছে ইত্যাদি বিষয় আমাদেরই নজরদারি করতে হবে। ওদের ভাষার প্রতি লক্ষ রাখুন। গালাগালি শুরু করতেই ধমক দিন। কারোর সঙ্গে বেয়াদবি করলে, অন্যায় করলে, কোনো শিশুকে বুলিং করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিন। অধঃপতনের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পায় মুখের ভাষায়, আচার–আচরণে। এ বিষয়গুলো যেন আপনার নজর না এড়ায়। অতি ভদ্রঘরের অতি ভদ্র গোবেচারা ছেলেকেও কিশোর অপরাধে জড়াতে দেখেছি। কাজেই ‘আমার ছেলে এসব করবে না’ টাইপ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন।

আরও পড়ুন

২.

এলাকায় কোথায় কোথায় মাদক পাওয়া যায়, কে কে জড়িত, কারা কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে ইত্যাদি সব তথ্য জানার চেষ্টা করুন। শিশুদের ছোটবেলা থেকে শেখান, যেন ওদের এড়িয়ে চলে। বাড়িতেই গ্যাং, গুন্ডামি ইত্যাদি বিষয়ে ঘৃণার পরিবেশ গড়ে তুলুন। এতটাই যে ওরা যখন কোনো গুন্ডাকে গুন্ডামি করতে দেখবে আপনাতেই যাতে ওদের মন বিষিয়ে ওঠে। এটা অত্যন্ত জরুরি। ‘জোশ’ সিনেমায় শাহরুখ খানকে হিরো না বানালে অনেক কিশোর এই ফালতু জগতে পা বাড়াত না।

৩.

শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকতেই হবে। আমাদের দেশে আমরা শিশুদের জীবন অসুস্থ করে ফেলছি। দিনরাত শুধু পড়ালেখা আর পড়ালেখা। খেলার জন্য কোনো মাঠ নেই, আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে গড়ে উঠছে একের পর এক দালান। শিশুরা অবসরে খেলবে কোথায়? ঘাম ঝরাবে কোথায়? স্কুলেই খেলার মাঠ নেই, ওরা খেলবে কোথায়? ইনডোর স্পোর্টস (টেবিল টেনিস/ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) বা আউটডোর (ক্রিকেট/ফুটবল) যা–ই হোক না কেন, খেলার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু না থাকলে সাইকেল চালাও বা পুকুরে গিয়ে সাঁতরাও। শিশুদের অবসর দেওয়া চলবে না। শরীর ঘামাতে হবে এবং পড়ালেখা করতে হবে—এই হবে ওদের রুটিন।

ঢাকায় আমরা প্লাস্টিকের বলেও ক্রিকেট খেলেছি যাতে বাড়ির কাচ, গাড়ির বডির সমস্যা না হয়। শিশুরা যা দিয়েই খেলুক, তাতেই বিনোদন খুঁজে পাবে। ফলে বিনোদনের জন্য ওদের ফালতু আড্ডার খোঁজ করতে হবে না।

৪.

কিশোরদের বড়দের মতো ট্রিট করুন। ওরা বেড়ে উঠছে, ওদের কাঁধে ছোট–বড় দায়িত্ব দিতে শুরু করুন। কিভাবে বিল শোধ করতে হয়, বাজার করতে হয় তা শেখান। পারিবারিক নানা সমস্যা নিয়ে ওদের সঙ্গে আলোচনা করুন, সমাধানে ওদের মত জানুন। ওদের ভুলগুলো কেন ভুল সেটা বোঝান। কেন আপনার ডিসিশন সঠিক, সেটা ব্যাখ্যা করুন।

৫.

পুলিশের বিকল্প নেই। পুলিশ যদি শক্ত হাতে একে দমন না করে, তাহলে এর মূলোৎপাটন সম্ভব নয়।

৬.

রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। শৈশব-কৈশোর সময়গুলো লেখাপড়ার সময়, নির্মল বন্ধুত্বের সময়, আমাদের জীবনের সেই সময়টা অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি করতে হলে পড়ালেখা শেষ করে করুক। কিন্তু অকালে এর বিষাক্ত ছায়ায় চলে এলে মনমস্তিষ্ক ঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ হারায়।

৭.

সবচেয়ে বেশি যা জরুরি, তা হচ্ছে এলাকায় অভিভাবকদের নিয়ে একটি সমিতি গড়ে তুলুন। নিয়মিত মিটিং হবে, সেখানে এলাকার এসব সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে। যাঁর সন্তান তাঁকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এলাকার সামাজিক বিভিন্ন কাজকর্মে নিজেরা যুক্ত হন, শিশুদেরও যুক্ত করুন। ওদের মাথায় ঢুকিয়ে দিন, হিরো হতে হলে লেদার জ্যাকেট পরে বাইক চালাতে হয় না, সাধারণ পোশাকেও হিরো হওয়া যায়, কাজটা হিরোর মতো হতে হবে।

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]