অ্যালামনাই ও পিকনিক: ভিক্ষা ভিক্ষা খেলা এবং ক্ষমতায়ন
আমি সাধারণত বহুলচর্চিত বা গৎবাঁধা বিষয়ের বাইরে গিয়ে অপ্রচলিত কোনো কিছু নিয়ে লিখতে পছন্দ করি। সে জন্য আমি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে পিকনিকজাতীয় খাদ্যনির্ভর বা খাওয়াদাওয়া সংস্কৃতি থেকে ক্ষমতায়নের মডেলে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটি নির্বাচন করেছি। এ ক্ষেত্রে আমি গড়পড়তা পিকনিক নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পিকনিক নিয়ে কথা বলব। কারণ, আমি ক্ষমতায়নের মডেল সম্পর্কে কথা বলতে চাই।
২০২১ সালের ১৮ জুন বিশ্ব পিকনিক দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত ‘থমকে যাওয়া পৃথিবীতে আজ পিকনিক দিবস’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। তাতে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ডিকশনারিকে (অভিধান) উদ্ধৃত করে পিকনিকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘আপনি যখন কোনো উপলক্ষ ছাড়া বাইরে খেতে যান, সেটাকেই মূলত পিকনিক বলা হয়।’
এদিকে বাংলা ভাষায় পিকনিকের অর্থ বনভোজন। এ ছাড়া চড়ুইভাতি কিংবা অরণ্যভোজও বলা হয়।
যাহোক, আজকের লেখাটির জন্য আমি নতুন একটি ধারণার সাহায্য নেব, যার নাম ‘ভিক্ষা ভিক্ষা খেলা’। এটাকে গবেষণা ও ক্ষমতায়নের পথ ছেড়ে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও দান-অনুদানও বলতে পারি। লেখাটির জন্য আমি দুটি গ্রুপকে বেছে নিয়েছি, যাতে তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সবার বোধগম্য করে তোলা যায়। একটি গ্রুপ হলো খুলনা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (কেইউএএ), কানাডা; অন্যটি হলো একটি আদর্শ গ্রুপ (অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি)।
আসুন, এবার অ্যালামনাই কী তা জেনে নিই। এর বৈজ্ঞানিক ধারণাটি এ রকম, ‘কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রাক্তন শিক্ষার্থী (অ্যালামনাই), যাঁরা একাডেমিক জীবন ও বৃহত্তর সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং প্রায়ই আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে সমৃদ্ধ করেন এবং একাডেমিক সম্প্রদায়ে তথা গবেষণায় অবদান রাখেন। অ্যালামনাই তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সমাজে কাজ করেন, যা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও মর্যাদা আরও শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।’ (মিউনিখ বিজনেস স্কুল, ২০২৫) এই সংজ্ঞা থেকেই বুঝা যায়, শুধু পিকনিক আয়োজন বা তাতে যোগ দেওয়াই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মুখ্য কাজ নয়।
অথচ দেখুন, এ বছরেরই মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত কেইউএএ–কানাডার পরিচালিত এক ফেসবুক জরিপে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে পিকনিক ও মেডিকেল বা চিকিৎসা–সম্পর্কিত অনুদান। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, এই প্ল্যাটফর্ম থেকে অ্যালামনাইর প্রধান যে লক্ষ্য—নলেজ ট্রান্সফার বা জ্ঞান স্থানান্তর তথা গবেষণা, সেটি বাদ পড়ে গেছে। তা নিয়ে যেন কারও মাথাব্যথা নেই। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সমাজে কাজ করা বা অবদান রাখার চেয়ে পিকনিক আয়োজন বা তাতে যোগ দেওয়াই বেশির ভাগ অ্যালামনাইর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
যাঁরা এই প্ল্যাটফর্মের (কেইউএএ, কানাডা) নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ একই সঙ্গে একাধিক ব্যবসায়িক ও বিভিন্ন গ্রুপভিত্তিক সভা-সমিতির সঙ্গে জড়িত। ভালো চাকরিবাকরিও করেন কেউ কেউ। আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটলে অনেকেই আবার নিজেদের এলিট ভাবতে শুরু করেন। একবার যাঁরা এলিট হয়ে যান, তাঁদের আচার-আচরণে পরিবর্তন আসে। তাঁরা কিছু দান-অনুদানের সুবাদে অন্যদের বা অনেককেই ভিক্ষুক হিসেবে দেখতে, ভাবতে এবং ওই অবস্থায় রাখার খেলাটাই বেশি পছন্দ করেন। এই খেলা এভাবে শুরু হয়—আপনি কোনো প্রয়োজন বা বিপদে পড়ে কারও কাছে গেলেন। যাঁর কাছে গেলেন, তিনি আপনার কিছু দান করলেন বা অনুদান দিলেন বটে, কিন্তু আপনার সমস্যার স্থায়ী সমাধান করলেন না, বরং সমস্যা জিইয়ে রাখলেন। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এই খেলা উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষমতায়নের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে আছে। এই সুযোগ বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগী মোড়লেরা নিয়ে থাকে। তারা বছরের পর বছর বা যুগের পর যুগ ঋণ-অনুদান দেয়, কিন্তু যে দেশকে দেয়, সেটির কোনো উন্নতি হয় না।
বৈশ্বিক রাজনীতির এই সংস্কৃতি ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, এমনকি পরিবার পর্যায়েও দেখা যায়। আমি বিষয়টি আরও খোলসা করার জন্য দুটি উদাহরণ দেব। প্রথমত, আমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের প্রথম ব্যাচের (১৯৯৭) শিক্ষার্থী। তখন আমাদের কয়েকজন শিক্ষক অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন। ফলে অনেকেই আশায় বুক বাঁধলাম, আমরাও হয়তো কোনো সুযোগ পাব! কিন্তু না, তেমন কিছু হলো না। অনেক দিন পর আমি অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর একজন শিক্ষককে পেলাম। তিনি আমাকে গবেষণা সহকারী হিসেবে নেবেন বলায় খুব খুশি হলাম। কিন্তু আমাকে অনেক দিন ঘুরিয়ে তিনি একটি ভারতীয় মেয়েকে নিলেন! আরেকটি ঘটনা বলছি। এটি অতি সম্প্রতি ঘটেছে। আমি একটা বৈজ্ঞানিক মডেল সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। এবারও ফল শূন্য। আমি অবশ্য অবাক হইনি।
এবার আমি অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির আদর্শ গ্রুপের মডেলটি বিশ্লেষণ করব, কীভাবে ভিক্ষা ভিক্ষা খেলাকে ক্ষমতায়নে রূপ দেওয়া যায়।
আইনি ক্ষমতায়ন: স্বার্থের সংঘাত আইনীকরণ ও একাধিক স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনে সীমিতকরণ।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: সদস্যপদ ফি প্রবর্তন (মাসভিত্তিক ১০-১৫ ডলার), বাজেট বণ্টন (একাডেমিক ৫০ শতাংশ; মেডিকেল দান ৩০ শতাংশ এবং সংস্কৃতি ও পিকনিক ২০ শতাংশ)।
শিক্ষাগত ক্ষমতায়ন: অ্যালামনাই ধারণা ডিফাইন করা, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম (ডেটাবেজ, লিংকডইন ও ওয়েবসাইট) তৈরি করা, যোগাযোগ ও দৃশ্যমানতা প্রটোকল অনুমোদন করা, ওপেন ডে ক্যারিয়ার মেলা, স্কলারশিপ, মেন্টর ও মেন্টি কার্যক্রম, ক্ষমতায়ন থেকে ক্ষমতায়ন, গবেষণা ও প্রকাশনা সহজলভ্য করা এবং সেমিনারে অংশগ্রহণ।
পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়ন: পর্যায়ক্রমিক সম্প্রদায়ের প্রভাব মূল্যায়ন। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া, প্রশ্নাবলি, সম্মেলন বা সেমিনার জরিপের মাধ্যমে ডেটা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
গ্রিফিথ মডেলটি থেকে আমরা শিখতে পারি, শুধু পিকনিক আয়োজন না করে গবেষণায় জোর দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি গঠনেও সহায়তা করতে পারে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনগুলো। খুলনা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (কেইউএএ), কানাডা গত ৫ মে একটি ওয়েবসাইট তৈরির ঘোষণা দিলেও এর সর্বশেষ আপডেট বা অগ্রগতি তা আমরা জানি না। এ ক্ষেত্রে ফান্ড বা তহবিল নিয়ে কোনো জটিলতা থাকলে পিকনিকের সংখ্যা সীমিত করে এবং সবার কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ‘গো ফান্ড’-এর মতো একটি প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমি কেইউএএ–কানাডার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যকে একটি লিংকডইন প্ল্যাটফর্ম গঠনের জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমার মেসেজে একটি লাইক দিয়ে আর যোগাযোগ রাখেননি।
নিজেদের ব্যক্তিগত ফেসবুক বা লিংকডইনে সভা, সেমিনার ও পিকনিকের উপচে পড়া ছবি থাকলেও অ্যালামনাইয়ের গবেষণা নিয়ে কারও কোনো লেখা বা মেসেজ দেখলাম না। তাহলে এ ধরনের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আদৌ কোনো কমিউনিটি ইমপ্যাক্ট হয় কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। অথচ প্রথম আলোতেও আমরা কখনো কখনো প্রবাসীদের মিলনমেলা বা পিকনিকের খবর, ছবি দেখতে পাই। বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম ও গবেষণার তথ্য-ছবি পাঠালেও বিদগ্ধ পাঠকের অতিপ্রিয় গণমাধ্যম হিসেবে প্রথম আলো সেগুলোও নিশ্চয়ই প্রকাশ করবে।
*লেখক: শাহিদা খানম, বোর্ড মেম্বার, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন, কানাডা