ধারাবাহিক গল্প: কিডন্যাপ–৪

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল, বুঝতে পারছি না। তবে খুব বেশিক্ষণ যে না, সেটা আন্দাজ করতে পারছি। হুঁশ ফেরার পর বুঝতে পারলাম আর অজ্ঞান হওয়া যাবে না। এখন আমার প্রতিটা মুহূর্ত জেগে থাকতে হবে পালানোর সুযোগ পাওয়ার আশায়। যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তবু যদি পাই। আজকে এ মুহূর্তে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা’ ভাবসম্প্রসারণের মর্মার্থ বুঝতে পারছি। আচ্ছা এ ট্রাকের ত্বরণ কত হতে পারে! ঝাঁকুনিতে মনে হচ্ছে বেশ অনেক জোরেই চলছে। আদিবেগ, ত্বরণ আর দূরত্ব জানলে কত ঘণ্টায় বর্ডারে পৌঁছাতে পারব, সেটা হিসাব করা যেত। অথবা আমি এই এলাকার ভৌগোলিক মানচিত্রটা দেখলেও একটা আন্দাজ করতে পারতাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার পড়ালেখার কথা মাথায় আসছে কেন! বাংলা, পদার্থ, ভূগোল! মনে হয় আমার মস্তিষ্কের এলআরআইপি ইনহিবিটরি নিউরন নামক কোষটা যথাযথভাবে কাজ করছে না কিংবা অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে গেছে, যার দরুন আশপাশের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় সব ইনফরমেশন নিয়ে একেবারে জগাখিচুড়ি করে ফেলেছে।

‘কিরে শেফালী ট্রাক থামছে কেন? কইলাম না যাতে না থামে কোথাও।’
‘ওস্তাদ, ড্রাইভারের চা খাওনের নেশা উঠছে। কাইল রাইত থেইক্কা টানা ট্রাক চালাইতাছে।’

‘শালার চা খাওনের প্যাঁচে না আবার ধরা খাই। আইচ্ছা, থামছেই যখন আমার লাইজ্ঞাও এক কাপ পাঠাইতে পারস কিনা দেখ।’

‘আপ্নে কি এইহানেই থাকবেন? লন টং দুগানে বইয়া চা খাই। ভালা লাগব, কহন থেইকা এই এক ট্রাকের ভিত্রে বসা। দম বন্ধ লাগতাছে। সব গুলান তো বান্ধাই আছে। পালাইতে পারব না।’

‘কথা মন্দ কস নাই। বর্ডার কিন্তুক বেশি দূরে না। একটা কাম কইরা আয়।’
‘কী কাম?’

‘উপরি দেউনের লাইজ্ঞা যে পোলাডা আনছি ওইডারে আগে আরেকটা বাক্সে আটকায় আয়। যদি বসের লগে আগে ভাগে দেখা হইয়া যায়, যাতে ওইডারে আগেই না দেইখা ফেলায়। এমন কইরা আটকাইস না যে আবার দম বন্ধ হইয়া মইরা যায়।’
‘আইচ্ছা বুঝচ্ছি।’

প্রায় পাঁচ মিনিট পরেই মনে হলো একটা ছেলে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে একটা শক্ত কিছুর ওপর ফেলে দিল। তারপর কিছু ধামধুম শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনিনি কিংবা বুঝিওনি। যে আমাকে টেনে নিয়ে আসছে সে আর যাহোক মেয়ে হয়তো না ভেবেছিলাম কিন্তু তার কণ্ঠ শুনে বুঝলাম সে শেফালী। কোনো মেয়ের হাত এত শক্ত হতে পারে, আমার ধারণার বাইরে ছিল। ‘বেশি নড়চড় করবি না, নড়লেই অসুবিধায় পড়বি। যত শান্ত থাকবি তত লাত্থি উস্টা কম খাবি’ বলেই সে চলে গেল। আবার সবকিছু চুপচাপ। অনেকক্ষণ ধরেই শেফালী আর শেফালীর ওস্তাদের কথা শুনতে পাচ্ছি না।

বোধ হয় চা খেতে গিয়েছে। এই সুযোগে অনেকক্ষণ আশপাশে কী আছে, সেটা বোঝার জন্য চরকির মতন কিছুক্ষণ ঘুরলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম না কিছুই। আমাকে কি আসলেই বাক্সের ভেতরে বন্দী করে রেখেছে! প্রচণ্ড ঘামছি, শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।

আসলেই কি আমার অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে নাকি আমার ব্রেন আগেই জেনেছে যে আমাকে বাক্সবন্দী করা হবে, তাই ধরেই নিয়েছে যে আমার অক্সিজেনের অভাব হবে তাই পেনিক হয়ে এমন লাগছে!

আরও পড়ুন

হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন আমার হাত ধরে টানছে। তার মানে আমাকে তুলে দেওয়া হবে এখনি তাদের বসের হাতে উপরি হিসেবে খুশি করার জন্য।
‘ভাইজান, আমি আপ্নের চোক্ষের পট্টি খুইল্লা দিমু। তয় আপ্নে পিছে চাইবেন না। সামনের দিক সোজা বরাবর দৌড়াইবেন। জংলার ভেতর দিয়া টানা আধা ঘণ্টা দৌড়াইলে আপ্নে বাসস্ট্যান্ডে যাইয়া থামবেন। ডাইনে বামে যাইয়েন না, সোজা মানি সোজা।’

ভাই কে আপনি! অন্তত নামটা বলেন। আর আমার সাথের বাকিদের না ছেড়ে আমাকে ছাড়ছেন কেন? পেছন থেকে কি গুলি করে আমাকে মেরে ফেলার অর্ডার এসেছে বসের কাছ থেকে? বস কি উপরি চায় না

‘আরে মিয়া অত কথা কন কেরে? কী মাল লইয়া বর্ডারে যাইতাছি, সেইটা চেক করতে আইসা দেখি আপনারে বাইন্দা ফালায় রাকছে এই বাক্সে। এই বাক্সে তালা লাগান নাই, হের লাইজ্ঞা খুল্বার পারছি, বাকি সব বাক্সে তালা লাগান। ভাঙ্গার চেষ্টা করমু জলদি কিন্তু আগে আপ্নে ভাগেন। একজনরে বাঁচাইতে পারলেও আমার শান্তি লাগব। আর আমি হিরন মিয়া। অহন দৌড় দেন।”

আরও পড়ুন

হিরন মিয়া কে! সে কি শেফালীর ওস্তাদ নাকি ড্রাইভারের নাম হিরন মিয়া? নামটা আমি শুনেছিলাম কিন্তু কার নাম মনে পড়ছে না। নাম নিয়ে ভাবতে ভাবতে দৌড়াচ্ছি। পেছনে তাকাচ্ছি না, যদি দেখি কোনো এক হিরন মিয়া বন্দুক ধরে আছে সেই ভয়ে।

কতক্ষণ দৌড়িয়েছি, জানি না। সামনেই একটা মসজিদ দেখা যাচ্ছে। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি নাই পা–দুটোতে। আজকে কতদিন খাই না সেটাও জানি না। মসজিদের সামনে গিয়ে ধপাস করে পরে গেলাম। কয়েকজন আমার মাথার কাছে জটলা বেঁধে বলছে ‘ইমাম সাব রে ডাক কেউ’। এতটুকুনই শুনেছি। আর কিছু শুনি নাই। চলবে...

লেখক: নুসরাত আহমেদ আশা, সফটওয়্যার কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ইঞ্জিনিয়ার কার্ল যাইস ডিজিটাল ইনোভেশন জিএমবিএইচ, মিউনিখ, জার্মানি

আরও পড়ুন