ধারাবাহিক গল্প: কিডন্যাপ-১

এক.

আমি শরৎ, শাহেদুল কবির শরৎ। সরকারি ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের আওতাধীন জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে চাকরি করা একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার ছোট পুত্র। এ চাকরি করার সুবাদে আব্বার সঙ্গে সঙ্গে আমি, আমার বড় দুই ভাই, ছোট বোন আর আম্মা এখানে-সেখানে যাযাবরের মতো জীবন কাটাচ্ছি। এ পর্যন্ত আমরা সর্বমোট ১১ বার জেলা পরিবর্তন করে এখন কুমিল্লায় আছি। কুমিল্লার যে এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি, সেটা একটা অজপাড়াগাঁ। আমার মা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ধরনের মানুষ। তবে তার সেসব আশা-আকাঙ্ক্ষা কেবল আমাদের ভাইবোনকে নিয়ে।

আম্মাকে দেখলে মনেই হয় না বয়স ৩০ পেরিয়ে গেছে সেই কবেই। চার ভাইবোন এবং আব্বা-আম্মাকে নিয়ে আমাদের বিশাল পরিবার। আম্মার পরিকল্পনা ছিল তার ছয় ছেলেমেয়ে হবে, কিন্তু আমার ছোট বোনের জন্মের পর আম্মার জরায়ু ক্যানসার ধরা পরেছিল। এখন আল্লাহর রহমতে আম্মা সুস্থ আছে। কিন্তু অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলে দেওয়ায় আমাদের ভাইবোনের সংখ্যা চার পর্যন্ত এসে থেমে গেছে।

যেহেতু আগে থেকেই ছয় ছেলেমেয়ের পরিকল্পনা করা ছিল, তাই আম্মা আমাদের নাম বাংলা ষড়্ঋতুর নামে রেখেছিল। আমার সবচেয়ে বড় ভাইয়ের নাম বসন্ত, সে একটা সরকারি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বছরের বেশির ভাগ সময় হলেই থাকে। নাম শুনলে বসন্ত রোগী মনে হলেও সে দেখতে খুবই সুদর্শন। মেজ ভাইয়ের নাম হেমন্ত, সামনেই তার এইচএসসি পরীক্ষা। আম্মার আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সে রাতদিন এক করে পড়ালেখা করছে। তারপর আমি এবং সবার ছোট আমার বোন। বর্ষা এখন কোনো ক্লাসে পড়ে, সেটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, কারণ আমার মাথায় একটা জটিল বিষয় নিয়ে জট লেগে আছে। আমি এখন বারান্দায় গিয়ে হেঁটে হেঁটে এই জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করব।

আমার ব্যাপারে আগে একটু ধারণা দেওয়া দরকার। আমার নামের শেষের অংশের সঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামের প্রথম অংশের হুবহু মিল থাকা সত্ত্বেও আমি সাহিত্যানুরাগী নই। সাহিত্যানুরাগী তো অনেক পরের ধাপ, আমি কোনো ধরনের পড়ালেখা-সম্পর্কিত কাজেরই অনুরাগী নই। বড় দুই ভাই পড়ালেখায় অত্যন্ত ভালো হওয়ায় আম্মা-আব্বা ধরেই নিয়েছে আমিও তাদের মতন খুবই ভালো ছাত্র। অবশ্য আগে ভালোই ছিলাম, কিন্তু এখন খুবই নিম্নমানের। ব্রেন খারাপ নয়, কিন্তু একাডেমিক পড়ালেখা করতে আমার এখন ভালো লাগে না। অষ্টম শ্রেণিতে সাধারণ বিভাগে বৃত্তি পাওয়া আমি শরৎ এখন এসএসসি পরীক্ষায় ফেলও করতে পারি বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার কোনো দোষ নেই বলে বিশ্বাস। আমার ইতিহাস কিংবা ভূগোল নিয়ে পড়তে খুব ভালো লাগত। লাগত না আসলে, এখনো লাগে। তাই আমি মানবিক বিভাগে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার বড় দুই ভাই বিজ্ঞানের ছাত্র, সুতরাং আমাকেও বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হতে হবে—এটাই আম্মার সিদ্ধান্ত ছিল। প্রথম দিকে আব্বা আমার পক্ষে থাকলেও আম্মার যুক্তির কাছে আমি আর আব্বা টিকতে পারিনি। আম্মার এক কথা, ইতিহাস কিংবা ভূগোল নিয়ে পড়তে চাইলে আমি অনার্সে গিয়ে সহজেই এসব সাবজেক্ট নিতে পারব। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিভাগের সাবজেক্টেই যাওয়া যাবে। কী আর করার! আম্মার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার কাছে হেরে গিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে এখন কপাল চাপড়াচ্ছি। আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই আমার এসএসসি পরীক্ষা, কিন্তু পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব কি না, সে ব্যাপারে আমি এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। পরীক্ষা না দিলে আম্মা হার্ট অ্যাটাক করবে। আবার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করলেও আম্মা হার্ট অ্যাটাক করবে। হার্ট অ্যাটাকের জন্য আম্মাকে আরও কয়েক দিন সময় দেব কি না, সেটা এখনো ঠিক করতে পারছি না। রাত বাজে দুইটা, কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। আমাকে আজকালের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ পরশু সকালে আমি স্কুলে যাব প্রবেশপত্র আনতে। এরপর আর বাসা থেকে বের হতে পারব না, দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ালেখার ভান করতে হবে।

বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে দেখলাম হেমন্ত বারান্দার এক কোনায় বসে। হঠাৎ দেখে ভয় পেয়েছিলাম। এত রাতে সোনাভাই না ঘুমিয়ে করছেটা কী বুঝলাম না। হেমন্তকে আমি আর আমার বোন ‘সোনাভাই’ ডাকি। তাই বলে আপনারা ভাববেন না যে আমরা বড় ভাইকে রুপাভাই কিংবা তামাভাই ডাকি। বড় ভাইকে সবাই ‘বড়দা’ ডাকি।

কিরে সোনাভাই, ঘুমাস নাই?
নারে, ঘুম আসছে না।
কেন? প্রেমিকা ছেড়ে চলে গেছে?
প্রশ্নটা শুনে হেমন্ত এমনভাবে তাকাল আমার দিকে, মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে খুন করে ফেলবে।

না, রসায়নের একটা অধ্যায় আমার শুধু একবার রিভিশন দেওয়া হয়েছে। আর কয় দিন পরেই পরীক্ষা। তাই চিন্তায় ঘুম আসছে না।

এ পাগল বলে কী! একবার রিভিশন দিয়েও তার চিন্তায় ঘুম আসছে না। আর আমি তো এমন কিছু অধ্যায় আছে, যা জীবনে পড়িইনি। ওর কথা শুনে নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে। ওরা সবাই কত ভালোভাবে পড়ালেখা করছে। আমি যে কেন নবম শ্রেণিতে উঠে আম্মার সঙ্গে রাগ করে পড়ালেখা শিকেয় তুলে দিয়ে সারা দিন খেলা নিয়ে পড়ে থাকতে গেলাম। এখন মাশুল দিতে হবে সেসবের। কিন্তু এ মুহূর্তে সোনাভাইকে তো ঘুমাতে সাহায্য করতে হবে। বুদ্ধি বের করে দৌড়ে গেলাম বড়দার ঘরে, প্রায় তিন মিনিটের ভেতর আবার ফেরত এলাম হাতে একটা শিশি নিয়ে।
এটা কী শরৎ?
ঘুমের ওষুধ।

কিন্তু ঘরে তো আমি ঘুমের ওষুধ খুঁজে পাই নাই। অনেকক্ষণ ধরে খুঁজলাম। তুই এটা কই থেকে বের করলি?
এটা আসলে কাশির ওষুধ।
আমার তো কাশি না।

এটা খুবই উপকারী ওষুধ, একের ভেতর বহু। পুরা শিশির ওষুধটা এক টানে খেয়ে ফেল। দেখবি রাতে ভালো ঘুম হবে।

তুই এখন চোখের সামনে থেকে যা, না হলে এক চড়ে তোর ৩২টা দাঁত ফেলে দেব।
আমার তো ২৮টা দাঁত। এখনো আক্কেলদাঁত ওঠেনি।

আমার উত্তর শুনে হেমন্ত যে চাহনি দিয়েছে, তাতে মনে হয় আমাকে সে এখনই ভস্ম করে দেবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে গিয়ে কীভাবে এই পরীক্ষার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে চিন্তা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভেবে আমার ঘরে চলে এলাম।

এখন পর্যন্ত আমার হাতে দুই দিন সময় এবং চারটি অপশন আছে। প্রথম অপশন বিয়ে করা ফেলা। বিয়ে করে ফেললে বিয়ের ঝামেলায় পরীক্ষার দিকে কেউ খেয়াল করবে না। এখানে অবশ্য একটু সমস্যা আছে, আমাকে পছন্দ করে—এমন কেউ নেই, যাকে কিনা আমি ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিয়ে করে ফেলব। অবশ্য আমি পছন্দ করি—এমন কাউকে জোর করে উঠিয়ে এনে বিয়ে করা যায়, সে ক্ষেত্রে পুলিশি সমস্যা হতে পারে।

তার ওপর বাল্যবিবাহের কেস খেয়ে ফেলতে পারি। জেল-জরিমানা সম্পর্কিত ব্যাপারে জড়াতে চাচ্ছি না আপাতত। অপশন নম্বর ২: আত্মহত্যা করা। কিন্তু মরে যাওয়া কখনো সমাধান হতে পারে না আর আত্মহত্যার মতন ভয়ংকর কাজ করার জন্য যে পরিমাণ সাহস দরকার, সেটা আমার নেই। তৃতীয়টি হচ্ছে আব্বা-আম্মাকে সরাসরি বলা যে আমি পরীক্ষা দেব না। এটা একটা ভালো অপশন, কিন্তু আম্মা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। কারণ, তার ছোট বোনের বড় ছেলেও এবার আমার সঙ্গেই এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আমার খালা এবং আম্মা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাজে ধরনের কমপিটিশনে থাকে। সেখানে আমি যদি এখন পরীক্ষাই না দিই, তাহলে আম্মা হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে, এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। সর্বশেষ উপায় হচ্ছে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমার হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই, যা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে চলতে পারব। আর পালিয়ে যাবই-বা কোথায়! এ চারটি বিকল্প পন্থারই একটি না একটি সমস্যা আছে। সমস্যা ছাড়া আর কী কী অপশন থাকতে পারে, তা ভেবে বের করতে হবে খুব জলদি। চলবে...

লেখক: নুসরাত আহমেদ আশা, সফটওয়্যার কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ইঞ্জিনিয়ার কার্ল জাইস ডিজিটাল ইনোভেশন জিএমবিএইচ, মিউনিখ, জার্মানি