ধারাবাহিক গল্প: কিডন্যাপ-৩
হঠাৎ মনে হলো বাসটা জোরে ব্রেক কষল। কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙল আমার, কিন্তু চোখ খুলতে পারছি না। আচমকা ঘুম ভাঙার কারণে বুঝতেও পারছি না কী হচ্ছে। কোথায় ছিলাম কিংবা এখন কোথায় আছি, সেটাও মনে পড়ছে না। বেশ অনেকক্ষণ পর বুঝলাম, আমার চোখ বাঁধা, সঙ্গে হাত–পাও। আমি এখন বাসে নেই, এটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না, কারণ আমি শুয়ে আছি বাঁধা অবস্থাতেই। হয়তো বড় লরি টাইপ কিছুতে আছি, কারণ দুলছি অনবরত অথবা ট্রেনও হতে পারে। কিছুক্ষণের ভেতর ঘুমের ঘোর কেটে গেল। মনে পড়ল আমি বাসে ঘুমাচ্ছিলাম। এরপর আর কিছু মনে পড়ছে না। আমাকে কি তাহলে আমার ক্লাসমেটরা কিডন্যাপ করেছে ব্যাপারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য! কিন্তু তাদের তো জানার কথা নয়, আমি ঢাকাগামী বাসে চড়ে বসেছিলাম। আর তারা আমাকে বেঁধে নাহয় একটা ঘরে নিয়ে রাখবে, সেখানে এমন দুলুনি তো হবে না। এসব চিন্তায় মগজের হাজার কোটি স্নায়ুকোষ একসঙ্গে দপদপ করা শুরু করে দিল।
পায়ের কাছে কিছু একটা লাগছে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল ফুটবলের মতন কিছু, কিন্তু গোঙানোর শব্দ শুনে মনে হচ্ছে এটা মানুষের মাথা। পায়ে জুতা থাকার কারণে এতক্ষণ বুঝিনি। তার মানে আমার সঙ্গে আরও কেউ এখানে আছে। গোঙানোর শব্দে বোঝা যাচ্ছে না এটা ছেলে, নাকি মেয়ে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘অই, দেখ তো কোনটা আওয়াজ করে? বেশি আওয়াজ করলে একেবারে কপালের মধ্য বরাবর গুলি করে সাবাড় করে দিবি। একটার জন্য ধরা খাইয়া বাকি মালগুলা ডেলিভারি দিতে না পারলে আমারে বস গুলি কইরা দিব।’ ছেলেটার কথা শেষ হতে না হতেই কেউ একজন আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল মনে হলো। তারপর ধুপধাপ কিছু মার দেওয়ার শব্দ শুনলাম। মনে হয়, যে গোঙাচ্ছিল, তাকে ঘুষি–লাথি কিছু একটা দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে গোঙানো আরও বেড়ে গেল। তখনই একটা মেয়েলি কণ্ঠ কানে এল। ‘চুপ কর শালি। এক্কেবারে গুল্লি কইরা দিমু কইলাম। কইছিলাম মাইয়া মানুষ ধইরা আনার দরকার নাই। মাইয়া মানুষ আজাইরা ঝামেলা বাড়াইয়া দেয়। ১০টা পোলা ধরলেই হইত। হুদাই ২টা মাইয়া আনল। মাইয়াগুলার জন্য দামও কম পাওন যায়।’ আশ্চর্য, গলার স্বরে মনে হচ্ছে, যে এ কথাগুলো বলছে, সেও একটা মেয়ে, অথচ সে মেয়েদেরকেই দোষারোপ করছে। মেয়েটার ধমকের সঙ্গে সঙ্গেই গোঙানোটা বন্ধ হয়ে গেল। মনে হয় সত্যি সত্যি কপালে বন্দুক রেখেছে। যে গোঙাচ্ছিল, সে একটা মেয়ে, এটা বুঝতে পারলাম। আরও বুঝলাম, আমার সঙ্গে আরও আট থেকে নয়জন আছে, সবাই কি একই জায়গায় আছি, নাকি সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। অবশ্য সবই আমি আন্দাজ করছি। কারণ, চোখ বাঁধা আমার। অনেকক্ষণ ধরে বাঁধা, তাও চোখ দুটি অন্ধকারের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারছে না।
যে দুজন কথা বলছিল, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে একটু পরপর। আমি এই দিকে কান পেতে রইলাম, যদি কিছু বুঝতে পারি সে আশায়। কিছুক্ষণ জমিজমা–সংক্রান্ত কথাবার্তা বলল তারপর সাংসারিক কথাবার্তা। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হলো ‘মাল ডেলিভারি’ শব্দ দুটি শুনলাম।
‘অই শেফালী, মাল ডেলিভারি বর্ডারে হইব। ট্রাক যাতে আখাউড়া বর্ডারের আগে কোনোখানে না থামে, ড্রাইভাররে কইয়া দে। আর ড্রাইভারের শাগরেদটারে আমার ভালা ঠেকে না। হেয় কি সব জানে নাকি? অরে চোখে চোখে রাখবি। অল্প বয়সী পোলা, কখন ডরে কী কইরা বসে ঠিক নাই। ওর নামডা জানি কি?’
‘অয় তো হিরণ মিয়া। অরে লইয়া ডরাইয়েন না। পোলা ভালা, তয় বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করে। কই যাই, বাক্সে কী, এই–সেই। রাইতে মাইজে–মইদ্ধে ড্রাইভারের ঘুম লাগলে হিরণ মিয়া গাড়িডা চালায়। মনে লয় ড্রাইভার ভাইয়ে হিরণ মিয়ারে কী মাল নিতাছে, এসব কিছু কয় নাই। নতুন লইছে, আগে বিশ্বাসী হউক। এর বাদে জানাইব আমরা কী কাম করি।’
তার মানে আমরা ট্রেন কিংবা লরিতে না, আমরা ট্রাকে। হয়তো মোটা লেদারের শামিয়ানা দিয়ে ঢাকা। আর বাইরে বোধ হয় অনেক রোদ। তার জন্যই এত গরম লাগছে। আর ওরা আখাউড়ার বর্ডারের দিকে যাচ্ছে। কুমিল্লা থেকে বেশি দূরে না জায়গাটা। আচ্ছা, ব্যাপারটা কি আসলেই আমার সঙ্গে ঘটছে? কোথায় ছিলাম, কোথায় যাচ্ছিলাম আর এখন কোথায় যাচ্ছি। আব্বা–আম্মাকে ঠকাতে প্ল্যান করেছিলাম। মনে হয় এর জন্যই আল্লাহ আমাকে শাস্তি হিসেবে এমন অবস্থায় এনে ফেলেছে এখন। এসব চিন্তার মধ্যে আবার বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিল সেই দুই পাচারকারী।
‘বর্ডারে লোক ঠিক করা আছে আমাগোর। কাজই, এর আগে যাতে ধরা না খাই, সেইটা মাথাত রাখিস। এইডা আমাগোর পইল্লা চালান, এইডা ভালা মতন করতে পারলে পরের চালানে বেশি টেকা দিব।’
‘আইচ্ছা। তয় মাইয়া দুইডারে কেরে আনছেন? মাইয়া মানুষ খালি ঝামেলা।’
‘অই, তুই কি মাইয়া না! আর এই দুইডারে ভুলে আনছে। আনার কথা অন্য দুইডা পোলা। কিন্তু কপাল খারাপ, পোলা দুইডারে উঠাইতে পারে নাই। শালার কাশেম রে তো চিনছই। হে কয় পোলা দুইডার থেইক্কা মাইয়া দুইডারে আনা সোজা লাগছে হের কাছে। যে পথ দিয়া জাইতাছিল, সেইখানে কেউ বলে আছিল না, অক্করে সুনসান রাস্তা। তাই আগেপিছে না ভাইব্বা মাইক্রোতে তুলছে। মাল তো ১০টা দিতেই অইব, তার লাইজ্ঞা আমিও আর কিছু কই নাই।’
‘কিন্তু ওস্তাদ, মাল তো পিছে ১১ডা।’
‘হু, জানি। স্কুলের কাপড় পিন্দনে পোলাডারে আঁতকা সামনে পাইছে আমগোর শরীফ। শরীফ যাইতে আছিল কেরানীগঞ্জ বাসে কইরা। এই পোলা শরীফের লগে বইছিল। বাসের হেলপারের লগে পোলার কথাবার্তা হুইন্না হে বলে বুঝচ্ছে যে এই পোলা কোনো সময় ঢাকা যায় নাই। এই পইল্লা যাইতাছে তাও একলা। আবার ঘুমায়েও গেছে অর্ধেক পথ যাইয়া। তখন আমারে মোবাইল করছিল। আমিই কইছি যে সুযোগ পাইলে লইয়া লইতে। ১০টার লগে একটা উপরি দিমু বসরে। বসরে যদি খুশি করবার পারি, তাইলেই না আমগোর পেট চলব।’
‘উপরি! কেন? একটা বেশি দিলে টেকা বেশি দিব না? টেকা না দিলে হুদা কষ্ট কইরা কী লাভ!’
‘এইডারে পিছে রাখবি, পইল্লা দেখাবি না। সব লেনদেন শেষ অইলে এরপর এইডারে লইয়া কথা কমু বসের লগে।’
ওদের কথা শুনে আমার আত্মা উড়ে যাওয়ার উপক্রম। তার মানে, এসব আমার সঙ্গে আসলেই ঘটছে। আমাকে একদল পাচারকারী কিডন্যাপ করেছে, তাও তাদের বসকে উপরি, মানে খুশি করার বস্তু হিসেবে ঘুষ দেওয়ার জন্য। কেন রে ভাই, আমি কি ঘুষ দেওয়ার জিনিস? ঘুষ দিলে এক কেজি মিষ্টি কিনে দে আর নইলে বাকি যাদের চালান করবি, তাদের মাথাপিছু টাকা কম নে। এ কোন মুসিবতে আমি পড়লাম জানি না। আমাকে পালাতে হবে। কীভাবে পালাব, সেটাও জানি না কিন্তু পালাতে হবে। ওরা হয়তো আমার একেকটা অঙ্গ অনেক টাকায় বিক্রি করবে কিংবা আরব দেশে চালান করে দেবে, যেখানে উটের ওপরে উঠে দৌড় প্রতিযোগিতায় নিজের জীবন বলি দিতে হবে অথবা আমাকে ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ বানাবে কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য। নাহ, আর ভাবতে পারছি না। কী হতে যাচ্ছে আমার সঙ্গে জানি না, এখন আর সেটা ভাবতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। কোনোভাবে যদি বেঁচে ফিরতে পারতাম! মাথা পুরা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চলবে...
লেখক: নুসরাত আহমেদ আশা, সফটওয়্যার কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ইঞ্জিনিয়ার কার্ল জাইস ডিজিটাল ইনোভেশন জিএমবিএইচ, মিউনিখ, জার্মানি
**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected]-এ