কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়: শেষ পর্ব

আজকের শেষ পর্বে আমরা ওসমানের ব্যক্তিগত জীবন ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে, ন্যায়বিচারের শাসন এবং তাঁর সহচর আল্পগণ সম্পর্কে জানব।

ওসমানের আল্পদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন কনুর আল্প। তিনি ছোটবেলা থেকেই ওসমানের বন্ধু ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন রণাঙ্গনের বিখ্যাত কমান্ডার ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তিনি ওসমানের আদেশে অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর ভাই গোকতুক আল্পের কথাও কয়েকটি সূত্রে জানা যায়। গোকতুক আল্পও ছিলেন ওসমানের বিখ্যাত যোদ্ধাদের একজন। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, তাঁকে ছোটবেলায় মোঙ্গলরা পাচার করে তাঁর জন্ম-পরিবার সম্পর্কে মগজধোলাই করে দিলে পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের ময়দানে তিনি একজন মোঙ্গল যোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভাই কনুর আল্পের মুখোমুখি হন। যদিও কিছুদিন পর কনুর আল্পের কল্যাণেই তিনি নিজের পরিবার ও ছোটবেলা সম্পর্কে সব স্মৃতি পুনরায় ফিরে পান। পরে তিনি বসতিতে ফিরে আসেন এবং ওসমান গাজীর আল্প হিসেবে তাঁকে সেবা প্রদান করতে থাকেন। বড় ভাই কনুরের মতো গোকতুক আল্পও ছিলেন বেশ দক্ষ ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তা ছাড়া ওসমানের ঘনিষ্ঠ আল্প হিসেবে আকচাকোচা, হাসান ও আয়কুত আল্পের কথাও কিছু ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন। যাঁরা ওসমানীয় সাম্রাজ্য গঠন ও সূচনা থেকে কমান্ডার ও গভর্নর হিসেবে বেশ অবদান রেখেছিলেন।

আরও পড়ুন

তা ছাড়া ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সব সময় পাশে ছিলেন ওসমানের পিতা আরতুগ্রুলের সহচর বিখ্যাত তুরগুত আল্প, আবদুর রহমান গাজী ও সামসা চাভুস। বিশেষ করে, তুরগুত আল্পের সব পরামর্শ ওসমান গ্রহণ করতেন। তুরগুতের সঙ্গে ওসমানের সখ্য ছিল ছোটবেলা থেকেই। তুরগুতও ওসমানকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। তুরগুত আল্প তাঁর শত বয়সেও ওসমানের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করে গেছেন। এমনকি তুরগুত আল্পের শত বয়সেও তাঁকে ওসমানীয় রাষ্ট্রের প্রধান সেনাপতি হিসেবে মোতায়েন করেছিলেন ওসমান। তুরগুতের একমাত্র পুত্র সন্তান ইলিয়াস বেও ওসমানীয় সাম্রাজ্যে বড় অবদান রেখেছিল। রোমান সাম্রাজ্য থেকে আসা মিহাইল কোসেসও ওসমানের বেশ ভালো বন্ধু ছিলেন এবং তাঁকে সর্বদা সহায়তা করে পাশে থাকতেন।

ওসমান ছিলেন ন্যায়বিচারের মূর্তপ্রতীক। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। শাইখ এদেবালির শিষ্য হওয়ায় সুফি-দরবেশদের প্রতি বেশ ভক্তি ছিল তাঁর। তাঁর শাসন ছিল খুবই শান্তিময়। তাঁর রাষ্ট্রে মুসলিম জনগণের চেয়ে খ্রিষ্টান জনগণের সংখ্যা কিছুটা হলেও বেশি ছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক রাষ্ট্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার ছিল। তিনি করের বোঝা কমিয়ে দিতেন বলে জনগণেরও বেশ ভালোবাসা পেতেন। তাঁর রাষ্ট্রে রোমান সাম্রাজ্যের বহু খ্রিষ্টান জনগণ বসবাস করতে এসেছিল। ওসমানের ইনসাফ শাসনের নিশ্চয়তায় খ্রিষ্টানরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত এবং তাঁর প্রশংসাও করত। এমনকি তাঁর সময়ের একটি ঘটনার বেশ প্রচলন রয়েছে। ওসমানের রাষ্ট্রে এক ইহুদি পরিবার এক মুসলিম পরিবারের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ করে। তখনকার প্রধান বিচারপতি শাইখ এদেবালি অপরাধের প্রমাণ পেয়ে সেই মুসলিম পরিবারকে শাস্তির নির্দেশ দেন। ইহুদি পরিবারটির পক্ষে রায় আসায় সেই পরিবারের সদস্যগণ আকস্মিকতা অনুভব করে বলেন, ‘ইসলামিক রাষ্ট্রে মুসলিমদের সুবিধা না দিয়ে ইহুদিদের পক্ষে রায় দেওয়ার ঘটনায় তাঁরা সন্তুষ্ট ও মুগ্ধ।’ এর জবাবে বলা হয়, ওসমানের ইসলামিক রাষ্ট্রে কাউকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না এবং এখানে সবার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সমান।

ওসমান ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি এস্কিসেহিরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। জনহিতকর কার্যকলাপ দ্বারা তিনি প্রজাদের সার্বিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করেছিলেন। তা ছাড়া ওসমানের জীবনযাপনও ছিল বেশ অনাড়ম্বর। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আরবের প্রথম খলিফাদের মতো তিনি রুচি ও অভ্যাসে অনাড়ম্বর ছিলেন। তিনি সোনা-রুপা রেখে যাননি। কেবলমাত্র একটি লবণ আধার (যা আতিথেয়তার প্রতীক), একটি চামচ, একটি কোট ও পাগড়ি; তাঁর পতাকা ও কতিপয় ঘোড়া রেখে যান।’

ওসমানের অনাড়ম্বর জীবন, প্রজাবৎসল শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর ইনসাফ কায়েমের একেকটি বৈশিষ্ট্য। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, তাঁর এমন উৎকৃষ্ট ও সুন্দর শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ইসলামিক শরিয়া। এ জন্য ওসমান গাজীর জীবন ও শাসনামলের সঙ্গে হজরত উমরের (রা.) আদর্শের কিছুটা মিল পেয়েছেন কতিপয় ঐতিহাসিক।

ওসমান ১৩২৬ সনে বুরসা জয়ের কিছুদিন পরই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে বুরসাতেই দাফন করা হয়। বুরসা জয়ের পর তাঁর রাষ্ট্রে জনগণ ছিল দেড় লক্ষাধিক এবং সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০ থেকে ১২ হাজারের মতো। ওসমানের প্রতিষ্ঠা করা ‘ওসমানীয় সাম্রাজ্য’ ধীরে ধীরে ব্যাপক শক্তিশালী হয় ও বিস্তৃতি লাভ করে তাঁর বংশধরের মাধ্যমে, যা তিন মহাদেশ পর্যন্ত সীমানা ছাড়িয়েছিল। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সময়সীমা ছিল ৬২৪ বছর, যা বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সমাপ্ত।

বি.দ্র. (প্রিয় পাঠক, আজকের পর্বের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে ওসমান গাজীর ইতিহাস। ওসমানের ইতিহাস লেখার দীর্ঘ এক বছরের যাত্রায় অনেকেই প্রশংসা করেছেন আমার লেখা নিয়ে। আপনাদের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা রইল। ওসমানের ইতিহাস সম্পর্কে আপনাদের অনেকেরই জানার আগ্রহ দেখে আমিও মুগ্ধ। আশা করি আবারও নতুন কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রের ইতিহাস নিয়ে ফিরে আসব আপনাদের মাঝে)।

বলা বাহুল্য, ওসমানের ইতিহাস অবলম্বনে নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত সিরিজ ‘কুরুলুস ওসমানে’ ওসমান ও বালা হাতুনের কন্যা সন্তান হালিমাকে দেখানো হলেও, প্রকৃতপক্ষে হালিমার ব্যাপারে ঐতিহাসিক তেমন কোনো রেকর্ড নেই।

* লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]