কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়: ত্রয়োদশ পর্ব
দ্বাদশ পর্বের শেষে উল্লিখিত হয়েছিল যে বুরসা অভিযানে কয়েক বছরের অবরোধে বুরসার সাধারণ মানুষও বেশ বিরক্ত হয়ে উঠছিল। তা ছাড়া কয়েকটি বছরের এমন অবরোধে দুর্ভিক্ষের উপক্রম দেখে বুরসার সাধারণ জনগণ ক্ষোভেও ফুঁসে উঠছিল। অন্যদিকে ১৩২১ সন থেকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বৃদ্ধ রোমান সম্রাট আন্দ্রেনিকোস তাঁর নাতির সাথে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হন। এ সুযোগ ওসমান বুরসা অভিযানে কাজে লাগাতে থাকেন। ফলে দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ বুরসার রোমান জনগণ ওসমান ও তাঁর রাষ্ট্রের প্রতি আকর্ষিত হতেও থাকে। ধীরে ধীরে বুরসার জনগণের কাছে ওসমানের জনপ্রিয়তা ও প্রশংসাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা ছাড়া রোমান সাম্রাজ্যের দাসত্বের শিকল থেকে বেরিয়ে ওসমানের রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে বসবাসের প্রতিও আগ্রহ ছিল বুরসার কিছুসংখ্যক খ্রিষ্টান জনগণের। ফলে অভিযানের দায়িত্বে থাকা ওরহান আরও অগ্রসর হতে থাকেন। ১৩২৪ পর্যন্ত এভাবেই ওরহান বুরসা অবরোধকে আরও কঠিনতর করে ফেলেন। কয়েক বছর ধরে এমন অবরোধ থাকায় বুরসা শহরের সাধারণ মানুষও অতিষ্ঠ হয়ে যায় এবং দুর্ভিক্ষের আগমন বার্তা উপলব্ধি করতে থাকে। এভাবে বুরসা শহরের জনগণও একসময় ওসমানের অধীন হওয়ার আশা করতে থাকে।
১৩২৫ সনে ওরহান শতবর্ষী তুরগুত আল্প ও বিখ্যাত যোদ্ধা কোসে মিহালকে সাথে নিয়ে ওসমানীয় সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে আত্রানোস দুর্গে হামলা করে তা জয় করে নেন। আত্রানোস দুর্গের পতন হওয়ায় বুরসা তখন পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ওসমানীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে। ওরহান ১৩২৬ সনে ওসমানীয় সৈন্যবাহিনীকে তীব্র থেকে তীব্র অবরোধের নির্দেশ প্রদান করেন। ওরহান প্রায় ৮ হাজার সৈন্য নিয়ে চূড়ান্ত অবরোধ গড়ে তোলেন এবং এ অবরোধ বেশ বেগবান হয়ে উঠেছিল। কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধ হলেও ওরহান রোমান বাহিনীকে বুরসার আশপাশের অঞ্চলে বেশ কয়েকবার পরাজিত করেন। ওসমানীয় সৈন্যরা এত দিন ধরে এভাবে অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার পরও ক্লান্ত না হয়ে পুনরায় চূড়ান্ত অবরোধ করায় রোমান সম্রাট বেশ ভীত হয়ে পড়েন। বুরসার রোমান গভর্নরও নিজের শহরকে বাঁচানোর আর কোনো আশা দেখতে পাচ্ছিলেন না। অন্যদিকে বুরসায় থাকা রোমান সৈন্যরাও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এত দিনের অবরোধে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ওসমানীয়দের তীব্র অবরোধ ও বুরসার জনগণের রোমান সাম্রাজ্যের প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হতে দেখে রোমান সম্রাট আন্দ্রেনিকোস তখন বুঝে ফেলেন যে দীর্ঘ ৯ বছরের অবরোধে বুরসাকে ধরে রাখা আর সম্ভব নয়। মুসলিমদের হাতে বুরসার পতন হওয়া তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে। রোমান সম্রাট কয়েক দিনের মধ্যেই বুরসার গভর্নর সরোজকে ওরহানের নিকট আত্মসমর্পণ করতে চিঠি পাঠান। অতঃপর সরোজ ও তাঁর রোমান সৈন্যবাহিনী ওরহানের নিকট আত্মসমর্পণ করে ও বুরসা শহরের চাবি ওরহানের নিকট সমর্পণ করে।
১৩২৬ সনের ৬ এপ্রিলে ওরহান ও তার সাথে থাকা ৫ হাজার ওসমানীয় সৈন্য সদ্য বিজিত বুরসা শহরে প্রবেশ করে। এ সময় ওরহান ওসমানীয় সৈন্যবাহিনীকে বুরসার সাধারণ জনগণের কোনো রকম ক্ষতিসাধন না করতে কড়া নির্দেশ প্রদান করেন। আত্মসমর্পণের পর গভর্নর সরোজ ও তার সাথে থাকা ৩ হাজার রোমান সৈন্যবাহিনীকে বুরসা থেকে নিরাপদে বের করে দেন ওরহান। যদিও রোমান গভর্নর সরোজ পরে একসময় ওসমান গাজীর সাথে দেখা করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ওসমানীয় সাম্রাজ্যে চলে আসেন ও ‘বে’ উপাধি লাভ করেন।
ওরহান বুরসা জয়ের সুসংবাদের চিঠি তার বাবা ওসমান গাজীর নিকট প্রেরণ করেন। বার্ধক্যে উপনীত ও শয্যাশায়ী ওসমান গাজী তাঁর বহু প্রতীক্ষিত বুরসা জয়ের সংবাদ পেয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করেন। এমন জয়ে নতুন উদ্যম পেয়ে ৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধ ওসমান বুরসা অভিমুখে তাঁর কিছু সঙ্গী নিয়ে রওনা হন। ওসমান বুরসায় প্রবেশ করে নিজের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। দীর্ঘ ৯ বছরের অবরোধের পর বুরসার এ জয় সত্যিই বেশ আনন্দের ছিল ওসমানের কাছে। শতবর্ষী ওসমানীয় কমান্ডার তুরগুত আল্প এ সময় বুরসায় শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখেন। তা ছাড়া তুরগুতের পাশাপাশি বুরসা জয়ে ভূমিকা ছিল আরেক শতবর্ষী যোদ্ধা আব্দুর রহমান গাজীরও। সামসা চাভুসের ভূমিকাও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যায়। আরতুগ্রুলের সময় থেকেই যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করে আসা এ যোদ্ধারা বুরসা জয়ের স্বাদ পেয়েছিল, যা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
১৩১৭ থেকে ১৩২৬ সন পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছরের বুরসা অভিযানে মোট ১০ হাজার ওসমানীয় সৈন্য অংশ নিয়েছিল। বিপরীতে বুরসা রক্ষায় নিয়োজিত ছিল মোট ছয় হাজার সৈন্য। এ দীর্ঘ অভিযানে ২ হাজার ওসমানীয় সৈন্য হতাহত হয়, অন্যদিকে ৩ হাজার রোমান সৈন্য হতাহত হয়।
ওসমান বুরসার খ্রিষ্টান জনগণকে ন্যায়ের শাসনের প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় তিনি ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সবার সমান অধিকার ও ইনসাফের নিশ্চয়তা দেন। তিনি বুরসা জয়ে প্রাপ্ত গনিমতের অধিকাংশই বুরসায় দীর্ঘদিনের অবরোধে ক্লান্ত জনগণকে দান করতে ওরহানকে নির্দেশ প্রদান করেন। বুরসায় প্রায় ৪০ হাজার মানুষ বসবাস করত। দীর্ঘ ৯ বছরের অবরোধে অতিষ্ঠ জনগণের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়। বুরসার জনগণের কথা ভেবে ওসমান তাদের কয়েক বছরের জন্য কর প্রদান থেকে মুক্তি দেন। ফলে বুরসার জনগণ শান্তিতে বসবাস শুরু করে। ওসমান বুরসাকে নিজের রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করেন। ফলে বুরসায় ওসমানীয় রাষ্ট্রের অনেক তুর্কি জনগণ আসতে শুরু করে। এর কয়েক দিন পরই বুরসাতেই ওসমান মৃত্যুবরণ করেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, ১৩২৬ সনে বুরসা বিজয়ের পরই ওসমান গাজীর মৃত্যু হয়। চলবে....
বি.দ্র. জনপ্রিয় ‘কুরুলুস ওসমান’ সিরিজের সমাপ্তি ঘটেছে ষষ্ঠ সিজন শেষ হওয়ার মাধ্যমে। তবে ঐতিহাসিক বুরসা অভিযান ও তা বিজয়ের ইতিহাস না দেখতে পাওয়ায় অনেক ভক্তেরই আক্ষেপ ছিল। আশা করি এই পর্ব এবং পূর্ববর্তী পর্বের মাধ্যমে বুরসা অভিযানের ইতিহাস সম্পর্কে জানার মধ্য দিয়ে আপনাদের আক্ষেপ কিছুটা হলেও ঘুচবে।
লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়