হাওরের মায়া-২

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইটনায় স্থানীয় এক বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয়। উনি বেশ কয়েক বছর এখানে চাকরি করছেন। আমাদের অনেক জিজ্ঞাস্য। বললাম, ‘ভাই, এই যে হাওরের মাঝে মাঝে বেশ কিছু গাছ দেখা যায়, ওগুলোর নাম কী?’ বেসরকারি সংগঠনের কর্মকর্তা, ‘বড় বড় ৩০ থেকে ৩৫ ফুট গাছগুলো হিজল আর কিছুটা ছোটগুলো করচগাছ।’ হিজল-করচ একটানা ছয়-সাত মাস পানিতে ডুবে থাকলেও মরে না। এখানকার মানুষের জন্য আল্লাহর দান। বর্ষায় হাওরের পানির প্রচণ্ড ঢেউ আফাল মোকাবিলায় প্রাকৃতিক ঢাল হিজল-করচ। হিজলগাছে শীতকালে অতিথি পাখির আবাস, বর্ষায় এর গোড়ায় হাওরের পানিতে মাছ পাওয়া যায়। লম্বা পুষ্পদণ্ডের মাঝে অসংখ্য গোলাপি ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। খুব সুগন্ধযুক্ত ফুলগুলো রাতে ফোটে, সকালে ঝরে যায়। ডায়রিয়ায় এর পাতার রস হাওরের লোকজন ব্যবহার করে। ঝোপালো দ্রুত বর্ধনশীল করচগাছ আফাল থেকে বাড়িঘরের ভাঙন ঠেকাতে বিরাট ভূমিকা রাখে। এটাও প্রায় ২৫-৩০ ফুট হয়। একসঙ্গে কলোনির মতো জন্মায়। বাত-চর্মরোগে এটা হাওরে ব্যবহৃত হয়। এটাকে হাওরের বায়োডিজেল বলে। একধরনের তেল পাওয়া যায় বলে ব্যাপকভাবে এই গাছ নিধন করা হচ্ছে। হাওরে একটা কথা চালু আছে—

‘হিজল করচ আড়াং বন

হাওরের মূলধন।’

আরও পড়ুন

বেসরকারি সংগঠনের কর্মকর্তা হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘হাওরে আফালের পাল্লায় পড়েছেন?’ শুনে গা শিউরে উঠল। কদিন আগে চামড়া বন্দরে আকাশে কালো রং দেখে পরপর দুই ঘণ্টায় দুটি ট্রলার যাত্রা বাতিল করে। তৃতীয় ট্রলারটি যখন ঘাট ছাড়ে, বড়িবাড়ীর কাছে উথালপাথাল ঢেউয়ে পড়ে একবার নিচে আরেকবার ওপরে উঠে আধাঘণ্টার যে তাণ্ডবে পড়েছিল, সেটা আজীবন মনে থাকবে। হাওরের সাহসী সহযাত্রীদের অনেকে ভয় পেয়ে ‘আইজ নাও ডুবব’ বলে আহাজারি করছিলেন। লাইফ জ্যাকেট পরা আমাকে যেকোনো মূল্যে নৌকা আঁকড়ে থাকার জন্য সবাই পরামর্শ দেন। সবাই ছইয়ের ওপর উঠে গিয়েছিলেন।

ঢাকায় আব্বা-আম্মার সঙ্গে কথা বলার জন্য টিএইচএফপিও সাহেবের টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি চাইলে স্যার আকাশ থেকে পড়েন, ‘আরে তুমি এইডা কী কও? কই আগরতলা আর কই চৌকির তলা। টেলিফোনডা দেখছ?’ বিশাল টেলিফোনের পাশে চাবির মতো একটা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে এক্সচেঞ্জে জানাতে হয়। এক্সচেঞ্জ অপর প্রান্তের গ্রাহককে যুক্ত করে। পুরো ইটনায় এই রকম তিন পিস টেলিফোন—হাসপাতাল, থানা আর উপজেলা সদরে। ভরসা মুঠোফোন। কিন্তু আশপাশে টাওয়ার না থাকায় পকেটে মুঠোফোন নিয়ে ঘুরেও কোনো লাভ নেই। ইটনা বাজারের বাহার মিয়া-মন্নাফ মিয়ার দোকানে দুটি বাঁশ জোড়া দিয়ে অ্যানটেনা লাগানো আছে। আপাতত সেটাই ভরসা।

‘স্যার, আমার ময়না হাগে না’, রোগীর অ্যাটেনডেন্টের কথা শুনে টিএইচএফপিও সাহেব শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ‘না, আপনেরেই দেখাইবাম’—রোগীর অ্যাটেনডেন্টের এই আবদারে স্যার বললেন, ‘ময়নার বয়স কত? সমস্যা কয় দিনের?’ দুই দিন পায়খানা না হওয়ায় টিএইচএফপিও সাহেব দরজা থেকেই সরাসরি ইমার্জেন্সিতে নিয়ে ডুশ দেওয়ার পরামর্শ দেন। রোগীর অ্যাটেনডেন্ট ‘ইতা কিতা কইন, স্যার?’ বলে খাঁচাসহ সত্যিকারের ময়না পাখি প্রদর্শন করায় টিএইচএফপিও সাহেবের রাগে দুঃখে রিভলবিং চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড়! আমার হাতের চা মাটিতে পড়ে যায়। আমরা তিনজন একযোগে ময়না, অ্যাটেনডেন্ট এবং স্যারের প্রতিক্রিয়ায় হাসি চাপতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে যাই। বেশ কিছুক্ষণ পর স্যার ঠান্ডা হয়ে আমাদের আবার ওনার রুমে চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। স্যার হাসতে হাসতে বলেন, ‘দেখছ কারবার! কোন মুল্লুকে ডাক্তারি করতে আইছ?’ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অল্প দূরে পশু হাসপাতাল, সেখানকার ডাক্তার না থাকায় আজ এই অবস্থা।

আকরাম সাহেব সামনের ঈদটা কিশোরগঞ্জে করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। বলেন, ‘শোলাকিয়া ঈদগায় প্রায় তিন লাখ মানুষের জামাত হয়।’ নরসুন্দা নদীর পাড়ে শোলাকিয়া ‘সাহেব বাড়ি’র পূর্বপুরুষ সৈয়দ সুফি আহমেদ নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে ঈদ জামাতের আয়োজন করেন। এ নামের পেছনে মুসল্লিদের প্রাচুর্য প্রকাশে সওয়া লাখ কথাটি ব্যবহার করেন। আবার অনেকের ধারণা সোয়া লক্ষ মুসল্লির জমায়েতের কারণে এই নামটি এসেছে। কেউ কেউ বলেন মোগল আমলে এই পরগনার রাজস্ব সোয়া লাখ টাকা থেকেই নামটি এসেছে। ঢাকা, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিশেষ ট্রেন, বাস, ট্রলারে করে ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই মুসল্লিরা জমায়েত হয়ে ঈদ উৎসবকে আরও বর্ণময় করে তোলেন।

আরও পড়ুন

হঠাৎ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার রুমে জরুরি তলবে তিনজনই একযোগে হাজির। বুকে ব্যথা নিয়ে এক ভদ্রলোক কষ্ট পাচ্ছেন। শুধু চাকরির প্রয়োজনে এই ভাটি অঞ্চলে আছেন। সঙ্গে উনার সহকর্মী। অপু ভাই পরীক্ষা করে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকার হৃদ্‌রোগ হাসপাতাল বা নিদেনপক্ষে কিশোরগঞ্জের সদর হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তাগাদা দেন। নিঃসঙ্গ, আত্মীয়–পরিজনহীন মানুষটিকে ট্রলার রিজার্ভ করে নিতে নিতে বিকেল হয়ে যায়। এখানে বিকেল চারটার পরে আর কোনো ট্রলার চলে না ডাকাতের ভয়ে। রাত নয়টার দিকে ঘাটে অনেক মানুষের কলগুঞ্জনে খবর পাই হাওরের মাঝখানে সেই নিঃসঙ্গ মানুষটি ইন্তেকাল করেছেন। বেলা এগারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সহকর্মীদের কে এগিয়ে আসবেন, কীভাবে কিশোরগঞ্জে নেবেন—এই সিদ্ধান্ত আসতে আসতেই সব শেষ। খুব কষ্ট পেয়ে জাহাঙ্গীরকে বললাম সরাসরি রাস্তার ব্যবস্থা থাকলে এই দুর্গতি হয়তো হতো না। জাহাঙ্গীর জানায়, ‘সাবমারসিবল রোড তৈরি হচ্ছে।’ এটা বর্ষাকালে ডুবে থাকবে শীতকালে গাড়ি চলবে। তবে হাওরের ওপর দিয়ে উঁচু করে কোনো রাস্তার ব্যবস্থা থাকলে অনেক মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে বাঁচানো যাবে। পুরো ইটনা শহরের দুই থেকে তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তায় মাত্র আট–দশটি রিকশা চলে।

ঢাকায় ছুটিতে যাওয়ার সময় প্রথম মহিলা বাঙালি কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি এই কিশোরগঞ্জে জানতে পারি। বাসে সহযাত্রীকে উনার বাড়ি কিশোরগঞ্জ-করিমগঞ্জ সড়কের কোথায় জানতে চাইলে ফুলেশ্বরী বা ফুলিয়া নদীর তীরে পাতুয়াইর গ্রামে বলে জানান। সেখানে উনার তৈরি একটি শিবমন্দির এখনো আছে। ষোড়শ শতকের মনসামঙ্গল–এর কবি দ্বিজবংশী দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী-মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা, রামায়ণের একটা বিরাট অংশ লিখেছিলেন। কবি তাঁর প্রাণের মানুষ ধর্মান্তরিত জয়ানন্দ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিবপূজায় মন দেন। পরবর্তী সময়ে আত্মগ্লানিতে জয়ানন্দ ফেরত এলেও তাঁদের মিলন হয়নি। জয়ানন্দের আত্মাহুতিতে চন্দ্রাবতীও ফুলেশ্বরীতে ঝাঁপ দেন।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার মধ্যে বিস্তৃত হাওরপাড়ের মানুষ সিলেট-ময়মনসিংহ-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিক্সড ভাষায় কথা বলেন; আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশও এক। বাসে বসে অদেখা কিন্তু অসংখ্যবার নাম শোনা চন্দ্রাবতী আর যোগাযোগের দুর্গমতার জন্য হাওরপাড়ের অসংখ্য মানুষের বিভিন্ন দুর্গতির কথা ভাবতে ভাবতে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। চলবে...

* লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।