হাওরের মায়া-১

অলংকরণ মাসুক হেলাল

‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে—পুবালি বাতাসে,

বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি,

আমার নি কেউ আসে রে।’

—হাওরের পানিতে ভাসতে ভাসতে কোত্থেকে এই বুক মোচড়ানো গান আসছে? একবার সাউন্ড বাড়ে, একবার কমে; মনে হচ্ছে তরঙ্গের ওঠানামা। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস আর হাওরের ঢেউ পাড়ি দিয়ে দুঃখী এক গাঁয়ের বধূর কষ্টের গানটি কে গাইছেন? কে লিখেছেন? দুপুরের পর থেকেই মোটামুটি আমরা ফ্রি। সন্ধ্যায় হাওরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখি, পালের নৌকা দেখি, মাইক বাজানো বিয়ের সাজানো নৌকা দেখি, দূরে দ্বীপের মতো বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা—আরও অনেক দূরে দিগন্তের কাছে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের বৈদ্যুতিক আলোকমালা দেখি।

চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় যে ধনু নদীকে দেখেছিলাম, সেটা এখন একাকার হয়ে গেছে হাওরের আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানির সঙ্গে। সন্ধ্যায় হালকা হলদে বাল্বের টিমটিমে আলো বাড়ে আর কমে, তারপর টুপ করে লোডশেডিং। বিকেলে নাশতার পর দীর্ঘ রাতের জন্য ফ্লাস্কভর্তি চা, কলা-বিস্কিটের মজুত নিয়ে ডরমিটরিতে ফিরি। এই একতলা ঝুরঝুরে প্রায় পরিত্যক্ত কোয়ার্টারটি ইটনা বাজারের পেছনে, হাসপাতাল থেকে প্রায় এক মাইল দূরে। সন্ধ্যার পরপর বারান্দার গ্রিলে তালা দিয়ে দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিতে হয় নিরাপত্তার খাতিরে। পুরো কোয়ার্টারটি অনেকগুলো বিশাল সেগুনগাছ দিয়ে ঘেরা। পাশের কোয়ার্টারটি শিরীষগাছ দিয়ে ঘেরাও করা।

সন্ধ্যায় প্রতিদিন আমাদের খোঁজখবর নিতে আসেন সিনিয়র স্টাফ নার্স জাহাঙ্গীর, সঙ্গে আসেন হাসপাতালের আনিস, আকরাম সাহেব। মাঝে মাঝে এলাকার বিশিষ্ট মানুষজন কলে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতে আসেন। কলে বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে যাওয়া একটা বিশাল স্ট্যাটাসের ব্যাপার; এ জন্য তদবির পার্টিও আসে। এই অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে বেরোনো রিস্কি। কখন ধাক্কা দিয়ে অন্ধকার হাওরে ফেলে দেয়, ঠিকঠিকানা নাই।

আধা মাইল পরপরই পানি। নৌকা ছাড়া অন্য কোনো বাহন নাই। এখানে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়ে ম্যানেজার সাহেবের রুমে উনাকে না পেয়ে কিছুটা সময় বসে আবার নক করি। আগে থেকেই রুমে থাকা লুঙ্গি পরিহিত সুখী চেহারার ভদ্রলোকটি বললেন, আমিই ম্যানেজার। উনার রুমে দুজন পুরুষ স্টাফকে ডেকে আমার অ্যাকাউন্ট নম্বর খুলে দেওয়ার তাগিদ দিতে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন, হাসপাতালের নতুন ডাক্তারসাহেব। ওমা! এরাও দেখি লুঙ্গি পরা; পায়ে প্লাস্টিকের পাম্প শু! এখানের স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন ঠাকুর সাহেবকে বিকেলে বা সন্ধ্যায় যখনই দেখেছি, খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করেন। বিষয়টি নিয়ে একদিন ইন্ডিকেট করতেই, হোঃ হোঃ করে হেসে বলেন—‘দুই মিনিট পরপর প্যাঁক-পানি, স্যান্ডেল-জুতা পরলে অসুবিধা।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জাহাঙ্গীর সাহেবকে ওই গানের ব্যাপারে জানতে চাইলে জানান উকিল মুন্সির এই গানটি হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমায় বারী সিদ্দিকী গেয়েছেন। আমরা অপেক্ষায় থাকি, কখন ভোর হবে? প্রায় রাতেই পার্শ্ববর্তী ঋষিপাড়ায় কীর্তন, ঢোল-করতালের আওয়াজে মনে হয় আমাদের আশপাশে লোকজন আছে। আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যেই সুনসান নীরবতা। এটা একদিক থেকে আমাদের জন্য ভালোই—পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ভর্তির জন্য পড়াশোনা করার উপযুক্ত ঠান্ডা পরিবেশ।

টিএইচএফপিও সাহেব হাসপাতাল থেকে জানালা দিয়ে সর্বোচ্চ বিশ ফুট দূরের হাওরে প্রায় সময়ই উদাস হয়ে কী যেন দেখেন! জানালা দিয়ে ঝকঝকে সাদা আকাশ আর নীল পানিতে অর্ধবৃত্তাকারে বিশাল ঢেউ তুলে এগিয়ে আসা স্পিডবোট দেখে মনে হয় টিভিতে দেখা মিয়ামি বিচ। আমরা মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দূরের বালুর বার্জ, ট্রলার, লঞ্চ, বড় বড় বাঁশের ভেলা (মাচালি) দেখে প্রশংসা করলে স্যার আমাদেরকে ধমক দেন, ‘তুমরার কপালে শনি আছে! এ হাওরের মায়ায় পড়লে শিকড় গজাইবো? আর বাইর হইতে পারবা না। কাইলকা কোন সাবজেক্ট পড়ছ? পড়া দেও!’ স্যার আরও বলেন, ‘নো ডিগ্রি, নো প্রমোশন; উপজেলায় পইচ্চা মরতে হইব।’ টিএইচএফপিও খালেক তালুকদার স্যার প্রায়ই আমাদের পড়াশোনার খোঁজ নেন—দ্রুত কোনো একটি কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টার কথা বলেন। স্যার ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করার পরও নিজের অপ্রাপ্তির কথা বলেন। চাকরির প্রথমেই প্র্যাকটিসের মোহে পড়লে ডিগ্রি করাটা কঠিন হয়ে যাবে। এ জন্য যেকোনো পোস্টগ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ছুটি চাইলেই মঞ্জুর করেন।

‘প্রতিদিন মাছ খেতে খেতে আর ভালো লাগছে না, এখানে পোলাও-বিরিয়ানির ব্যবস্থা নাই?’—অপু ভাইয়ের এই আকুতি আমারও। হাসপাতালের পোর্টার আলী মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে, ‘চলেন স্যার, আমি জানি কোন হডেলে পোলাও-বিরানি পাওয়া যায়।’ ইটনা বাজারে বৃষ্টির মধ্যে আয়াত আলী বোর্ডিংয়ের আশপাশে ঘুরিয়ে একটি ভাতের হোটেলে বসিয়ে বলে, ‘স্যার আইজকা পোলাও-বিরানি রান্দে নাই। এরা মুড়িঘণ্ট খুব ভালা বানায়।’ ভদ্রতার খাতিরে এটা খেয়েই ফেরত আসি। গরিব মানুষের কাছে হোটেলের পোলাও-বিরিয়ানি বা মুড়িঘণ্ট সবই প্রচণ্ড উপাদেয়।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বিকেলের নাশতায় ভেরিয়েশন আনতে ডা. পাহাড়ী একেবারে হাওরের সীমানার বাঁশের টং মার্কা হোটেলে নিয়ে আসে। হাওরের তাজা মাছের গরম গরম হলুদ-লবণ মাখানো ফ্রাই খেয়ে ডা. অপুর মতো পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁত খুঁত করা মানুষও জানতে চান, আর কী কী মাছের ফ্রাই তৈরি হয়। ‘এই টাটহা মাছের ভাজি ঢাহায় কই পাইবাইন স্যার?’ হোটেল ম্যানেজারের কথায় আমরা তিনজনই সায় দিই। হোটেলওয়ালা পাশের চায়ের দোকান থেকে গরম গরম দুধ, লবণ মিশিয়ে এনে আমাদের খেতে দেন। আমি আর অপু ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেও পাহাড়ী বিনা দ্বিধায় গ্লাসটি নেয়, আমাদেরও অনুরোধ করে গরম দুধ খেয়ে ফেলার জন্য। দুধের দাম দিতে গেলে ম্যানেজার অস্বীকৃতি জানিয়ে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, তাঁর ভাঙাচোরা বাঁশের টংয়ের হোটেলে বসে খাবার জন্য। অপু ভাই বলেন, ‘তিন–তিনজন সরকারি ডাক্তার এইখানে বসে খেয়েছে, এটাই তাঁর স্ট্যাটাস বাড়িয়ে দেবে।’ দুধ দিয়ে আপ্যায়নের মাধ্যমে মেহমানদের সম্মানিত করেন তাঁরা।

ঢাকায় পোস্টগ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষার ফরম ফিলাপের জন্য ছুটিতে যাচ্ছি। এখানের বিশেষ কী জিনিস ঢাকায় আব্বা-আম্মার জন্য নিয়ে যেতে পারি, এই পরামর্শ চাইলে আনিস সাহেব বলেন, ‘হাওরের তাজা মাছ।’ ভোরে ঘাটের পন্টুনের কাছে জাহাঙ্গীর সাহেবকে নিয়ে দাঁড়াতেই জীবন্ত কাইক্যা আর গলদা চিংড়ির অসংখ্য টুকরি দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এই গলদা ঢাকার নিউমার্কেটের মাছের বাজারে অনেক দাম; তাও কয় দিনের বরফ দেওয়া কে জানে? বিক্রেতাকে জানালাম, ‘কাল ভোরে রওনা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত বারোটা–সাড়ে বারোটা বাজবে, গলদা টেকানো যাবে?’ ‘কী কইন স্যার? ককশিটের বাক্সে বরফ দিয়া প্যাকেট কইরা দিলে দুই দিনেও কুছতা হইতো না।’ জাহাঙ্গীর সাহেব আমাকে লোভ দেখান, শীত নামলেই অষ্টগ্রামের তাজা পনির টুকরি করে ব্যাপারীরা বিক্রি করতে আসেন। পার্শ্ববর্তী অষ্টগ্রাম পনিরের জন্য বিখ্যাত।

হাসপাতালে রোগী দেখতে গিয়ে আমার অবজারভেশন অপু ভাইকে জানালাম। এখানের পুরুষ মানুষেরা প্রায় সবাই সুস্বাস্থ্যবান ও লম্বা চওড়া। কিন্তু গরিব-ধনী সবার ঠোঁটের কোণে ঘা। ব্যাখ্যা কী? তাদের নিয়মিত খাবার তালিকায় ভাত-মাছ প্রধান উপাদান। বছরের প্রায় ছয় মাস পানিতে দ্বীপের মতো উঁচিয়ে থাকে গ্রামগুলো। বছরে একটাই ফসল ধান; গোলা ভরে যায়। যে ধানের খড় আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নরসিংদীতে দেখেছি বাড়িতে এনে সংরক্ষণ করে, বিক্রি করে; সেই খড় এখানের মানুষজন মাইলের পর মাইল জমিতে ফেলে আসে। ফসল কাটার মৌসুমে খেতের ওপর টংঘর তৈরি করে থাকে, সেখানেই ধান সংগ্রহ করে নৌকায় করে বাড়িতে নিয়ে আসে। সবজির অপ্রাপ্তিতে নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিনের অভাবে ঠোঁটের কোনায় ঘা।

বর্ষায় তাদের লেইজার টাইম-বিনোদনের সময়। প্রায় সবাই তখন মাছ ধরে, বিয়েশাদি, পূজা-পার্বণ, মুসলমানি, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৌকাবাইচ এগুলো করে তারা সময় কাটায়। কিছুটা ধনী মানুষেরা মাছের ঘের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জলমহালের ইজারা নিয়ে ঘেরকেন্দ্রিক মারামারিতে হাসপাতালে জখমের রোগীরা আসেন। অস্ত্র—সাড়ে তিন ফুট থেকে সাড়ে চার ফুট লম্বা রামদা, বল্লম।

*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর