কে এই ওসমান বে? কেন আজও এত জনপ্রিয়: দশম পর্ব

রোমান অঞ্চলে ওসমানের অতর্কিত আক্রমণে প্রিন্সেস মারিয়া ও মঙ্গল গভর্নর চারবান্দার বিয়ে ভেঙে যায়। তবে ইলখানাতের মঙ্গল সম্রাট ওলিজায়তু কূটচাল করতে থাকেন। এমন সময় রোমান সম্রাট আন্দ্রেনিকোস নিজের কন্যা প্রিন্সেস ডেসপিনার সঙ্গে মঙ্গল সম্রাট ওলিজায়তুর বিবাহের প্রস্তাব দেন। ওলিজায়তুও এ প্রস্তাবে সায় দেন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ে সেরে ফেলেন। ওলিজায়তু বিয়ের পর রোমান সম্রাটকে আশ্বস্ত করেন, তিনি রোমান সাম্রাজ্যে ওসমানের আগ্রাসন বন্ধ করবেন এবং ওসমানীয় রাষ্ট্র ধ্বংস করবেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৩০৮ সনের দিকে ওলিজায়তু প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের একটি বহর ওসমানের অধীন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। যদিও মঙ্গল বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই ছিল ভাড়া করা।

অপর দিকে ওসমানের সে সময় নিজের অঞ্চলে বড়জোর ১০ হাজার সৈন্য ছিল। স্বাভাবিকভাবেই ওসমান সতর্কতা গ্রহণ করার আগেই ওসমানের অধীনে থাকা একটি শহরে মঙ্গলরা হামলা করেন এবং অনেক মানুষকে হত্যা করেন। পরবর্তী সময়ে ওসমান কয়েক দিনের মধ্যেই নিজের ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে বেশ আকর্ষণীয় যুদ্ধকৌশলে তিন গুণ শত্রুসৈন্যের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিজের অঞ্চলকে রক্ষা করেন। এ সময় ওসমান বেশ কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধ পরিচালনা করে কম সৈন্য নিয়েও তিন গুণ শক্তিশালী মঙ্গল বাহিনীকে দুর্বল করতে থাকেন। পাশাপাশি ওসমান তৎক্ষণাৎ অভিযান পরিচালনা করে মঙ্গলদের কাছে হারানো সেই শহর ফিরিয়ে নেন এবং পরাজিত মঙ্গলদেরকে তাঁর অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেন। বাবা আরতুগ্রুলের মতো মঙ্গলদেরকে এভাবে কচুকাটা করার ইতিহাস ওসমান নিজেই আবার রচনা করেন। ধারণা করা হয়, মঙ্গলদের এই আগ্রাসনই শেষ আগ্রাসন ছিল পশ্চিম আনাতোলিয়ায়।

ওসমানের এমন বিজয়ে তাঁর খ্যাতি আনাতোলিয়াতে আবারও ছড়িয়ে পড়ে। বাবা আরতুগ্রুলের মতো তিনিও আনাতোলিয়ায় ‘মঙ্গলদের যম’ হিসেবে অভিহিত হন। ওসমানের এই জয় অন্যান্য তুর্কি রাষ্ট্রগুলোকে ওসমানের সাহসিকতা সম্পর্কে বুঝিয়ে দেয়। মঙ্গলদের কখনো দাসত্ব না করা ওসমান এভাবেই আনাতোলিয়ায় নিজের খ্যাতি বাড়াতে থাকেন। এই পরাজয়ে রোমান সম্রাট এবং ইলখানাত মঙ্গল সম্রাট ওলিজায়তু ওসমানের অঞ্চলে পুনরায় অভিযান করা থেকে বিরত থাকেন। মঙ্গল সম্রাট ওলিজায়তুকে তোয়াক্কা না করে মঙ্গলদের বিতাড়িত করায় ওসমানের শক্তি ও সাহসিকতার প্রশংসা করতে থাকেন আনাতোলিয়ার তুর্কি জনগণ। এর ফলে পশ্চিম আনাতোলিয়ায় ১৩০৮ সনের পর আর কখনো মঙ্গলরা অভিযান পরিচালনা করেননি। বিশেষ করে ওসমানের অধীনে থাকা অঞ্চল মঙ্গলরা এড়িয়ে চলতে থাকেন।

পরবর্তী সময়ে ১৩০৮ সালেরই মাঝামাঝি সেলজুক রুমের সুলতান মাসুদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন মঙ্গলরা। কেন হঠাৎ সুলতান মাসুদের এমন মৃত্যুদণ্ড, তার বিশেষ কারণ না জানা গেলেও ধারণা করা হয় যে সুলতান মাসুদের সময়ে সেলজুকদের তেমন কোনো ক্ষমতাও ছিল না এবং আনাতোলিয়ার তুর্কিরা বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছিলেন মঙ্গলদের বিরুদ্ধে। মূলত তুর্কিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ না রাখতে পারাতেই সুলতান মাসুদের এ পরিণতি হয়েছিল। সুলতান মাসুদের কোনো পুত্রসন্তান বা উত্তরসূরি না থাকায় সেলজুক রুম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ইলখানাতের মঙ্গলরা কোনিয়াকে নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নিয়ে ফেলেন। তবে সুলতান মাসুদের মৃত্যুর পর আনাতোলিয়ায় তুর্কিদের সুলতান কে হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। আনাতোলিয়ায় কয়েকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গড়ে ওঠাতে এ অঞ্চলে তুর্কিদের প্রতিনিধি কে হবেন, তা নিয়ে দ্বিধা-সংশয় দেখা দেয়। জার্মিয়ান জোটের নেতা ইয়াকুপ বে, জান্দার রাষ্ট্রের জান্দার বে, কারামান রাষ্ট্রের মাহমুদ বে গণের নাম অনেকেই বলছিলেন।

তবে তাঁদের সবাইকে পাশ কাটিয়ে সদ্য পতন হওয়া সেলজুক রুম সাম্রাজ্যের কিছু কর্মকর্তা, কমান্ডার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ওসমান বের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরাই ওসমানকে আনাতোলিয়ার তুর্কিদের সুলতান হওয়ার প্রস্তাব দেন। এ সময় সেলজুক রুমের অধীনে থাকা কয়েকজন আলেমও ওসমানকে সমর্থন দেন। ওসমানও সাদরে সুলতান হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং আনাতোলিয়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে নিজের সুলতান হওয়ার কথা সমগ্র আনাতোলিয়ায় ছড়িয়ে দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওসমান নিজের রাষ্ট্রকে আনাতোলিয়ার প্রথম স্বাধীন ‘ওসমানীয় রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দেন। বহুকাল ধরে সেলজুক রুমের আনুগত্য করে এলেও ওসমানের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করা ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। ওসমান নিজের নামে খুতবা পড়াতে থাকেন তাঁর অঞ্চলের মসজিদগুলোতে। ওসমান নিজের রাষ্ট্রের জনগণের জন্য নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন করেন। এ মুদ্রাই ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসের প্রথম মুদ্রা ছিল। এ মুদ্রায় ওসমান তাঁর বাবা আরতুগ্রুলের নাম দিয়েছিলেন। এভাবেই ওসমান নিজের বাবার দেখা স্বাধীন তুর্কি রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন করতে থাকেন।

তা ছাড়া ওসমানের সুলতান ঘোষণার পর সদ্য পতন হওয়া সেলজুক রুমের প্রায় এক হাজার সৈন্য ও কয়েক হাজার জনগণ ওসমানের অধীন অঞ্চল চলে আসেন। ওসমানের রাষ্ট্রে জনগণ যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই তিনি সেনাবাহিনীর আকার বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি নিজের পুত্র, ভাতিজা ও বয়স্ক বেগণসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভিন্ন দুর্গ, শহর ও জমির গভর্নরের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। রাজধানী ইয়েনিসেহিরে ওসমান নিজের প্রাসাদে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করতে আলাদা বৈঠকখানা প্রস্তুত করেন। তৎকালীন আনাতোলিয়ায় ওসমানের রাষ্ট্রই প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কারণ, জার্মিয়ান রাষ্ট্রের নেতা ইয়াকুপ বে ও তাঁর জোটের শরিকরা মঙ্গলদের আনুগত্য করেছিলেন। পাশাপাশি জান্দার রাষ্ট্রের জান্দার বেও মঙ্গলদের আনুগত্য করতেন। কারামানের মাহমুদ বে মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যের আনুগত্য করতেন। তাই ওসমান কোনো বড় শক্তিধর সাম্রাজ্যের আনুগত্য না করায় ওসমানের রাষ্ট্রকেই আনাতোলিয়ার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা হয়েছিল। চলবে.... 

  • লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়