আষাঢ়ে গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

স্কুলের টিনের চালে ঝমঝম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। বৃষ্টিতে আজ অঙ্ক ক্লাস ফেঁসে গেছে। স্যার যখন ক্লাস নিতে আসবেন আসবেন ভাব, তখনই আকাশ কালো হয়ে সব অন্ধকারে ছেয়ে গেল। স্যার তাঁর ৮২ মণ ওজনের বেতের লাঠিটা নিয়ে আসার জন্য সবে মাত্র তৈরি হচ্ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল কঠিন কঠিন অঙ্ক দিয়ে সবার পিঠে ৮২ মণ ওজনের বেত দিয়ে কাঁঠাল পাকাবেন। সে বোধহয় আর হয়ে উঠল না। স্যারের তাই মন খারাপ। প্রতিদিন বেতের ব্যবহার না করতে পারলে তাঁর বাতের ব্যথা বেড়ে উঠে।

এদিকে ঝন্টুর মন ভয়াবহ রকম ভালো। আজ আর ক্লাস হবে না, ভাবতেই মনটা কেমন কেমন করে। কিন্তু এই বৃষ্টিতে বেরও হওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর ঝন্টুর ব্যাগ নেই। বই–খাতা তো ভিজে যাবে। ঝন্টু তার বন্ধু মন্টুর দিকে তাকায়। দোস্ত কী করা যায়? মন্টু একটা জবা ফুল মার্কা হাসি দেয়। আমার কাছে একটা পলিথিন আছে। বইগুলো পলিথিনে বাইন্ধা ল। ঝন্টু খুশি হয়। পলিথিনে বই বেঁধে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি যাবে সে। যেই ভাবা, সেই কাজ। বৃষ্টির মধ্যেই সে বের হয়ে পড়ে। মূল সড়ক পার হয়ে একটা খেতের আল ধরে হাঁটতে থাকে। আকাশ যেন আজ তার ঝাঁপি খোলে দিয়েছে। চারদিক কেমন নির্জন, নীরব, নিস্তব্ধ। চারদিকে শুধু ছন্দময় বৃষ্টি। পাটের পাতার ওপর বৃষ্টির ফোঁটারা অবিরাম ঝরছে। ঝন্টুর কেমন ভয় ভয় করে। একটা বিশাল বিল। সে বিলের মাঝখান দিয়ে সে একাকী হেঁটে যাচ্ছে। আকাশে থোক থোক মেঘ। চারদিকে অন্ধকার। এমনও দিনে, এমনও বরষের বর্ষণে ভিজে ভিজে একাকি আনমনে মন কোথায় যেন ছুটে চলে। পাটখেতের এদিকটায় আরও বেশি নির্জন। পাটগুলোও লম্বা লম্বা। কেমন যেন গা ছমছম করে।

ঝন্টুর কয়েক হাত পাশে পাটগুলো হঠাৎ নড়ে উঠে। একটা মেছো বাঘ কোথা থেকে যেন উদয় হয়। ক্ষণিকের আতঙ্কে ঝন্টু বিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই ঝন্টু কোথায় যাস? মানে কী, মেছো বাঘটা কথা বলছে! কী, কী রে কথা বলিস না কেন? দেব নাকি ঘাড় মটকে। ঝন্টু আর ভাবতে পারে না। হঠাৎ সে পাটখেতের মাঝ দিয়ে দৌড় দেয়। মনে হচ্ছে মেছো বাঘটা তাকে ধরে ফেলবে। সে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছে। একসময় সে দ্রিম শব্দ করে পড়ে যায়। কাদা আর জলে একদম মাখামাখি অবস্থা। সে তাকিয়ে দেখে পাটখেত নেই। একটা বিশাল খোলা মাঠে সে এসে পড়েছে। মাঠের পরে বাড়ি। আচ্ছা ঝন্টু কি পথ ভুলে গেছে? এ রকম মাঠ তো এখানে থাকার কথা নয়। আর এসব বাড়িঘরই–বা এল কোথা থেকে। এ পথ তো তার চেনা। তবে কী সে অন্য পথে এসেছে? সে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকায়। মেছো বাঘটা আছে কি না, দেখার জন্য।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

কিন্তু একি মেছো বাঘ কোথায়, একটি বালিকা তাকে দেখে খিল খিল করে হাসছে। এই তুমি এই বৃষ্টিতে কোথা থেকে এলে। কোথা থেকে এলাম মানে? আমার স্কুল থেকে? এখন বাড়ি যাচ্ছি। স্কুল, বাড়ি। কীসব বলছ? তোমার গ্রামের নাম? সোহাগপুর। সোহাগপুর! কি জানি এমন গ্রামের কথা তো শুনিনি। এটা কোন গ্রাম? এটা পলাশপুর। পলাশপুর! এ গ্রামের নাম তো আমি শুনিনি। আচ্ছা তুমি এখানে কী করছ? আমি বৃষ্টিতে কই মাছ ধরছি। কই মাছ! হুম দেখ মাঠে কত্তো কই মাছ। কেমন কিলবিল করছে। আমি একা পারছি না। তুমি আমায় সাহায্য করবে? ঝন্টু সত্যি দেখে বৃষ্টিতে অনেক কই মাছ নেমে এসেছে। তারা কানের ওপর ভর দিয়ে হাঁটছে। মেয়েটির পাশে একটা বড় ঝাঁপি। ঝাঁপিটা দেখতে দেখতে ভরে গেছে। আচ্ছা তোমার নাম কী? আমার নাম বৃষ্টি। মেয়েটির ছোট্ট জবাব। তোমাদের গ্রাম তো সোহাগপুর কিন্তু এটা কোন জেলা? এটা নাটোর। ঝন্টুর যেন ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তাঁর বাড়ি মাদারীপুরের এক ছোট্ট গ্রাম পলাশপুর। মেয়েটি কি তবে মিথ্যে বলছে? বৃষ্টি তুমি মিথ্যে বলছ কেন? আমি কেন মিথ্যে বলব। চল আমারদের বাসায় চল। এই বৃষ্টিতে তুমি আবার পথ হারাবে তারপর আবোলতাবোল বকবে। ঝন্টু আনমনে বলে চল।

বৃষ্টির মা–বাবা খুব ভালো মানুষ। ঝন্টুকে অনেক আদর করে খেতে দিয়েছে। কই মাছ ভাজা, মুরগির মাংস আর মসুর ডাল। খেয়ে ঢেকুর তুলছে ঝন্টু। তা বাবা তোমার বাড়ি মাদারীপুর। সেখান থেকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তুমি এখানে এসে পড়েছ? এটা তো বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। দেখেন আমি সত্যি বলছি। মিথ্যা বলে আমার কী লাভ? বৃষ্টির বাবাকে কিছুটা চিন্তিত মনে হয়। সে মাথা চুলকায়। আচ্ছা তুমি এখন ঘুমাও। বৃষ্টিতে ভিজে ক্লান্ত হয়ে গেছ। কোনো একটা ঝামেলা হইসে। ঝামেলাটা আমি ধরতে পারছি না। ঝন্টুরও সব কিছু এলোমেলো লাগছে। কোথায় মাদারীপুর আর কোথায় নাটোর? কী হচ্ছে এসব?

ঝন্টুর ঘুম আসছে না। সে একটা অস্থিরতার মধ্যে আছে। কোথা থেকে এসে কোথায় এল? টিনের চালে এখনো টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু ঝন্টু জেগে আছে। তার কাছে পুরো বিষয়টি এখনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বারান্দায় বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি তুমি এখনো ঘুমাওনি? নাহ্‌, ঘুম আসছে না। আচ্ছা তোমার বাড়ি কি সত্যিই মাদারীপুর? হ্যাঁ। তাহলে তুমি নাটোরে কীভাবে এলে? আমারও সেটাই প্রশ্ন? কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। অথচ তুমি–আমি দুজনেই বাস্তবে কথা বলছি, কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা পর বাস্তব জগতের বাসিন্দা। আচ্ছা তোমাদের মাদারীপুর কোথায়? ঢাকার পাশে, তবে নদী পার হতে হয়। বিশাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। বৃষ্টির চোখে চিন্তার ছাপ। সব কিছু কেমন যেন খাপছাড়া খাপছাড়া লাগছে। তুমি কিসে পড়? ক্লাস নাইনে। তুমি? আমি এইটে। তবে মজার ব্যাপার কী জানো, আমি অঙ্কে খুব ভালো। অঙ্ক আমার এত প্রিয় যে নবম–দশম শ্রেণির সব অঙ্কও আমি করে ফেলেছি। বল কী? আমি তো অঙ্কে কাঁচা। অঙ্ক স্যারকে দেখলেই আমার সর্ট সার্কিট লুজ হয়ে যায়। ভেতরের কলকবজা কাজ করে না। বৃষ্টি হাসছে। তার হাসির সঙ্গে যেন বাইরের বৃষ্টি আরও বাড়ছে। আচ্ছা আমি আজ তোমাকে অঙ্ক শিখাব। অঙ্কের কিছু বেসিক নিয়ম আছে, যা শিখলে অঙ্ক নিয়ে তোমার আর কোনো ভীতি থাকবে না। অঙ্ক হচ্ছে একটা ধাঁধার মতো। ধর, তোমার বন্ধুরা মিলে ধাঁধা ধাঁধা খেলো না মাঝেমধ্যে, অনেকটা তেমন। তো তোমার সামনে একটা ধাঁধা এলে তুমি কী কর, সেটা নিয়ে তুমি অনেক চিন্তা করো, তারপর বিভিন্নভাবে তা সমাধানের চেষ্টা করো। তুমি যদি ধাঁধা সমাধান করে মজা পেতে থাকো, তখন যত কঠিন ধাঁধাই হোক, তোমার আর ভয় কাজ করবে না বরং একটা কৌতূহল কাজ করবে। এ কৌতূহল তোমাকে ধাঁধা সমাধানে সাহায্য করবে। ঝন্টু মজা পাচ্ছে বৃষ্টির কথা শুনে। সে কোনো দিন এমনভাবে ভাবেনি। অঙ্ক তো আসলে ধাঁধাই। ধাঁধা যেমন সমাধান করতে হয়, অঙ্কও তেমনি সমাধান করতে হয়।

আরেকটা বিষয় তোমাকে বলি, তুমি অন্য বিষয় যত ভালোই পারো, অঙ্কে ভালো না হলে তুমি ভালো ছাত্র হতে পারবে না। তাই অঙ্ককে ভয় না পেয়ে ভালোবাসতে শিখো, এর পেছনে সময় দাও, দেখবে অঙ্ক তেমন কঠিন নয়। কিন্তু ভয়ে যদি তুমি অঙ্ক না করো, তবে শিখবে কী করে? জানো, আমাদের একজন অঙ্ক স্যার আছেন, ইয়া বড় একটা বেত নিয়ে তিনি ক্লাসে আসেন। স্যারের বেত দেখলেই আমি অঙ্ক ভুলে যাই। স্যারের ক্লাসে এমন কোনো দিন নেই যে আমি মার খাইনি। কী যে করি। আমি মনে হয় মার খেতে খেতে আমার জীবন শেষ করব। নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা। নিজে অঙ্ক করো না আর দোষ স্যারের বেতের। স্যারের কী দায় পড়েছে, শুধু শুধু তোমাকে মারবে? আচ্ছা আসো আমি তোমাকে অঙ্ক শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি এখন থেকে অঙ্কের জাহাজ হয়ে যাবে। সারা রাত ওরা অঙ্ক করে। বৃষ্টি অঙ্কের বেসিক কিছু বিষয় ঝন্টুকে বুঝিয়ে দেয়। ঝন্টু খুব সহজেই বিষয়গুলো বুঝে নেয়। আচ্ছা আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি এখন যাই, তুমি ঘুমাও। সকালে কথা হবে। বৃষ্টি চলে যায়। ঝন্টুর বাথরুমে যাওয়া দরকার। বাথরুমটা বাড়ির বাইরে। একা একা কেমন ভয় করছে। কিন্তু কিছু করার নেই। প্রকৃতির ডাক এলে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। গ্রামের বাথরুমের পাশে একটা বাঁশঝাড় থাকে। বৃষ্টিদের এখানেও তা–ই। সে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু একি! বাথরুমের পাশেই সেই মেছো বাঘ। কিরে তুই এখানে কি করস? বৃষ্টি শেষ। তোর ক্লাস আবার শুরু হইসে। দৌড়া। ঝন্টু মেছোবাঘ দেখেই আবার ভয় পেয়ে যায়। চোখমুখ বুজে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ায়। সে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে যত দৌড়াচ্ছে, বৃষ্টিদের ঘর তত দূরে সরে যাচ্ছে! আস্তে সব কিছু অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় সে। ঘোর কেটে যেতে সে নিজেকে স্কুলের গেটে আবিষ্কার করে। মন্টু ডাকছে। এই ঝন্টু যাইস না ফিরে আয়। ক্লাস হইব। ঝন্টু দেখে বৃষ্টি নেই। আকাশে ঝকঝকে রোদ।

অঙ্ক স্যার ক্লাসে ঢুকছে। হাতে লম্বা বেত। ঝন্টু হন্তদন্ত হয়ে ক্লাসে ঢোকে। ঝন্টু তোর বই কই? ব..ই। ব..ই তো নাটোরে। বৃষ্টিদের বাসায়। তোর মাথা খারাপ হইসে। ১০ মিনিট হয় নাই স্কুল থেকে বাইর হইছস এর মধ্যেই বই হারায় ফালালি? না মানে। কী মানে মানে করতাছস। এই ঝন্টু তোর বই কই? স্যারের প্রশ্ন। সে বেত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝন্টুকে না পিটালে স্যারের বেতে জং ধরে যায়। ঝন্টু ভয়ে ভয়ে বলে স্যার ভুলে বাসায় রাইখা আসছি। তবে রে..আবার মিথ্যা কথা। স্যার মারেন সমস্যা নাই, তার আগে এ বইয়ের সবচেয়ে কঠিন একটা অঙ্ক আমারে করতে দেন যদি না পারি তবে মারেন–কাটেন, যা করার করেন। স্যার যেন শক খেলেন। বলে কী ছোকরা! পুরো ক্লাস যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ক্লাসের ভালো ছাত্ররা যারা ফেল্টুস, ঝন্টুকে পাত্তা দেয় না, তারা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। নে এ অঙ্কটা কর। মন্টুর বই থেকে একটা অঙ্ক করে দেয়৷ ঝন্টু ঝটপট অঙ্কটা করে ফেলে। স্যার তো অবাক! নে এটা কর। সেটাও ঝন্টু করে। এভাবে অনেকগুলো অঙ্ক স্যার করতে দেয়। ঝন্টু একে একে সব করে দেয়। স্যার বিড়বিড় করে বলে ইটস মিরাকল রিয়েলি মিরাকল। সে এই প্রথমবারের মতো তার বেতের ব্যবহার না করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। সব ছাত্ররা তাকে ঘিরে ধরে। ঝন্টু এত অঙ্ক তুই শিখলি কার কাছে? বৃষ্টি শিখিয়েছে। বৃষ্টি কোন বৃষ্টি? নাটোরের। নাটোরের? তুই নাটোর গেলি কখন? আরে না না আকাশের বৃষ্টি। দেখছিস না বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সত্যি স্যার চলে যাওয়ার পরে পুরো আকাশ কালো করে আবার বৃষ্টি হচ্ছে। অঝোর বৃষ্টি।

* লেখক: সুলতান মাহমুদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরীয়তপুর।