যে গল্পগুলো বইয়ে লেখা থাকে না

মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। যুদ্ধের সময়ে ঢাকার দোহারে মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১ছবি : আনোয়ার হোসেন

রিসার্চ মেথডোলজির ক্লাস। সেদিন স্যার স্লাইড খুললেন না, নোটও নিলেন না। বললেন, আজ থিওরি না, আজ সত্যি গল্প শুনবে।

ক্লাসরুমটা হঠাৎ অদ্ভুত নীরব হয়ে গিয়েছিল। আমরা ৬০ জন, সবাই অপেক্ষায়। তখনো বুঝিনি, এই নীরবতার ভেতর দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের এমন মুখোমুখি হব, যেটা বইয়ে পাওয়া যায় না।

স্যার প্রথম গল্পটা বললেন এক বৃদ্ধার।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদন্ডী গ্রামের একেবারে প্রান্তে থাকতেন তিনি। নাম কেউ জানে না, সবাই বলত ‘বু’। একা থাকতেন। স্বামী নেই, সন্তান নেই। জীবিকা বলতে কয়েকটা হাঁস। প্রতিদিন হাঁসের ডিম বিক্রি করে নিজের খাবার জোগাড় করতেন।

১৯৭১-এর এক রাতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় চেয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। পাকিস্তানের সেনাদের টহল, চারদিকে ভয়। খালাম্মা একমুহূর্তও ভাবেননি। দরজা খুলে দিয়েছিলেন।

কিন্তু সমস্যা শুরু হলো খাওয়ার। বাজারে গেলে সন্দেহ করবে—এত খাবার কেন? তাহলে ধরা পড়ে যাবে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছেন।

বু সেদিন রাতে নিজের উঠানে ঢুকেছিলেন। একে একে হাঁসগুলো ধরেছিলেন। যে হাঁসগুলো ছিল তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন, সেই হাঁসগুলোই জবাই করে যোদ্ধাদের খাইয়েছিলেন। পরদিন আবার। তারপর আরেক দিন। যত দিন যোদ্ধারা ছিলেন, তত দিন।

স্যার একটু থামলেন। আমরা নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।

যুদ্ধ শেষে অনেক দিন পর সেই মুক্তিযোদ্ধারা আবার ওই বাড়িতে এসেছিলেন। ‘বু’কে ধন্যবাদ দিতে। উঠানে ঢুকে কাউকে পেলেন না। প্রতিবেশীরা বললেন,

বু তো আর নেই।

কবে?

অনেক দিন। হাঁসগুলো শেষ হওয়ার পর আর খাবার জোটেনি। না খেয়েই মারা গেছে।

স্যারের গলা ভারী হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসরুমে কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না।

তারপর দ্বিতীয় গল্প।

আরও পড়ুন

পুনর্ভবার পানি সেদিন অস্বাভাবিক রকম কালো ছিল। যেন নদী নিজেই জানত—এই পার হওয়া সহজ হবে না। কয়েকটা পরিবার একসঙ্গে নদী পার হচ্ছিল, কলার ভেলায় ভর করে। বেলাগুলো দুলছিল, দড়ির টান কাঁপছিল, আর প্রতিটি ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর জমে থাকা ভয়টা আরও ভারী হয়ে উঠছিল।

পেছনে শত্রু। সামনে অজানা। মাঝখানে নদী—আর নদীর ওপর কয়েকটা অসহায় জীবন।

কারও মুখে কথা নেই। কেউ প্রার্থনা করছে, কেউ চোখ বন্ধ করে আছে। হঠাৎ ভেলার মাঝখানে থাকা শিশুটার কান্না ফেটে পড়ল। জোরে, থামাহীন। এমন কান্না, যেটা শুধু মা-বাবার বুকই নয়, চারপাশের বাতাসও কাঁপিয়ে তোলে।

কেউ বলল, —‘ওকে চুপ করাও, প্লিজ!’

কেউ বলল, —‘ওরা শুনে ফেললে আমরা সবাই শেষ!’

কিন্তু শিশুকে চুপ করানো যায় না। ভয় তার গলার ভেতর ঢুকে গেছে।

তখনই তরুণী মেয়েটা শিশুটার দিকে তাকাল। তার চোখে আতঙ্ক ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল এক রকম স্থির সিদ্ধান্ত। সে জানত, এই কান্না থামাতে না পারলে কেউই বাঁচবে না। সে জানত, তার নিজের জীবন আর এই মুহূর্তে তার নয়।

সে ধীরে ধীরে ভেলা থেকে নামল পানিতে। কারও কিছু বলার সময় ছিল না। কেউ বুঝে ওঠার আগেই সে স্রোতের ভেতর ঢুকে পড়ল। পুনর্ভবার পানি তাকে টানল—নিঃশব্দে, নির্দয়ভাবে। সে সাঁতার জানত না।

একমুহূর্তের জন্য তার মাথা জলের ওপর ভেসে উঠেছিল। চোখ দুটো কোথাও একটা তাকিয়ে ছিল—হয়তো আকাশের দিকে, হয়তো কোনো দূরের তীরে, যেখানে সে আর কোনো দিন পৌঁছাতে পারবে না।

এরপর আর কিছু দেখা যায়নি।

শিশুটার কান্না থেমে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন

নদী আবার শুধু নদী হয়ে বয়ে চলছিল।

ভেলাটা ধীরে ধীরে অন্য পারে গিয়ে ঠেকল। কেউ বাঁচল। কেউ ফিরল। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। কারণ, কিছু গল্প কথা দিয়ে বলা যায় না।

শিশুটার কান্না থেমেছিল। মেয়েটা আর উঠতে পারেনি।

স্যার বলছিলেন আরও গল্প। কোথাও বাবা ছেলেকে বাঁচাতে নিজে গুলি খেয়েছে। কোথাও মা নিজের সন্তানের লাশ চাপা দিয়েছে নিঃশব্দে, যেন অন্যরা পালাতে পারে। প্রতিটা গল্প ছিল নিঃশব্দ আত্মাহুতি।

আমাদের ক্লাসের ষাটজনের চোখেই পানি জমে ছিল। কেউ কাঁদছিল না, কিন্তু গলায় কান্না আটকে রাখার কষ্টটা সবার মুখে লেখা ছিল।

এই স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। যারা আজ বিজয়কে কুক্ষিগত করে, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার বা অসম্মান করে তারা ইতিহাসের ও, এই দেশের জন্যও কলঙ্ক।

ক্লাস শেষ হয়েছিল। আমরা উঠে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কথা বলছিল না। মনে হচ্ছিল, ‘বু’র উঠানে হাঁসের পালক এখনো পড়ে আছে, নদীর জলে এখনো সেই মেয়েটার নিঃশ্বাস আটকে আছে।

বিজয় দিবসে যখন পতাকা উড়ে, তখন এই গল্পগুলো মনে পড়ে।

লেখা: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন