হঠাৎ কেঁপে ওঠা সকাল
আজকের সকালটা সুন্দরভাবে শুরু হয়েছিল। গত পরশু প্রমথ চৌধুরীর একটা বই কিনেছিলাম, খিচুড়ি দিয়ে নাশতা করে চা খেয়ে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের একটা গল্প পড়ছিলাম। শান্ত, নিরিবিলি একটা সকাল।
ঠিক তখনই হঠাৎ মনে হলো আমার রুমটা যেন ভয়ংকরভাবে কাঁপছে। ওই মুহূর্তে বুঝতেই পারিনি কী হচ্ছে, মাথাই কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল পুরো বাসা ভেঙে পড়ে যাবে। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি মারা গেলাম।
নরসিংদীর মাধবদী যেহেতু উৎপত্তিস্থল ছিল, তাই আমাদের ওপর ঝাঁকুনি পাঁচ গুণ বেশি তীব্রভাবে পড়েছিল। আমি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই অবচেতন মনে প্রথমেই ওড়না খুঁজতে লাগলাম, যেন সেটা ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। ওড়নাটা ঠিক আমার পেছনের সোফাতেই ছিল। কিন্তু চেয়ার থেকে উঠতেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে নিচে পড়ে গেলাম। উঠে দাঁড়ানোই কঠিন হয়ে গিয়েছিল।
ঝাঁকুনি একটু কমতেই আমি বালিশ মাথায় দিয়ে চেপে ধরলাম। রুমের বাইরে তখন কান্নাকাটি, দৌড়াদৌড়ি—সবাই রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমিও বালিশ বুকে ধরে বের হলাম।
মজার বা করুণ যা–ই বলি, প্রথমেই আমার মাথায় এল ওড়না। এমন একটা সমাজে থাকি, যেখানে জীবন-মরণ পরিস্থিতিতেও মনে করিয়ে দেওয়া হয়, ওড়না ছাড়া বাইরে গেলে লজ্জা লাগবে। আর সত্যি বলতে কি, আমিও অবচেতন মনে ওড়নাটাই খুঁজছিলাম।
তারপর আভা আপুকে কল দিলাম, ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করতে। আপুর বাচ্চারা ভয়ে কান্না করছিল, আপু নাকি রান্নাঘরে ছিলেন, ওড়না খুলে রান্না করছিলেন। তিনিও ওড়নার জন্য সঙ্গে সঙ্গে বের হতে পারেননি।
পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখলাম আজকে ওড়নাকে নিয়েই এত সমালোচনা, এত আলোচনা। তখন ভাবলাম, হ্যাঁ, আমিও প্রথমেই ওড়নাই খুঁজেছিলাম। ভূমিকম্প তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সমাজের সেই চিন্তাধারা শেষ হয়নি।
আমাদের উচিত, আগে মানুষের জীবন বাঁচানোর কথা বলা, কীভাবে ভূমিকম্প মোকাবিলা করতে হয়, কীভাবে নিরাপদ নগর গড়া যায়। কিন্তু আমরা ওড়না নিয়ে ডিবেটেই আটকে থাকি। যার মন চাইবে সে ওড়না পরে বের হবে, যার মন চাইবে না সে পরবে না, এটা ব্যক্তিস্বাধীনতা। যারা আমাদের মতো যারা ওড়না খুঁজছি এটা নিয়েও মজা করছে, তাদের মানসিকতাকেও নিন্দা জানাই। সমাজের উচিত মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখা, শুধু ‘মেয়ে’ হিসেবে নয়।
আজকের ঘটনার পর আবারও মনে হলো, প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটাই না অসহায়। মৃত্যু কখন, কীভাবে আসে—তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেঁচে আছি, এটার জন্যই সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ।
লেখক: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]