খণ্ডকালীন চাকরি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা—শেষ পর্ব

চাকরিপ্রতীকী ছবি

চবি-টু-বাংলাবাজার বেশ চেনা একটা পথ হয়ে গিয়েছিল সে সময়। সিনিয়র ভাইবেরাদর বলতেন যে অনার্সের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ইয়ার হলো থার্ড ইয়ার। কারণ, এই ইয়ারেই অনার্সের ভাইটাল সাবজেক্টগুলো পড়ানো হয়। কিন্তু আমি আদৌ মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না।

বিষয়টা এমন যে, ‘প্যাটে কয়লা না থাকলে কবিতা বারায় না।’

থার্ড ইয়ারে কেন জানি না আমার অর্থকষ্ট চরমে পৌঁছাল। বাড়ি ফিরলাম। পিতামহ কর্তৃক পিতাকে মৌখিকভাবে প্রদত্ত দুই খণ্ড ধানি ও ভিটা জমি খাইখালাসি রেখে মা কিছু টাকা ম্যানেজ করে হাতে দিলেন। সে সময় মায়ের চোখে দেখেছি ছেলের গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা নিয়ে সে কী আকুল অপেক্ষা। বাবা চলে যাওয়ার পর আমার পৃথিবীতে সবচেয়ে একা মানুষ বোধ করি তিনিই ছিলেন। ঠিক যেমনটা আর্টস ফ্যাকাল্টির পুরাতন পোস্ট অফিসের সেই দেয়ালে লেখা, ‘ডিম বিক্রির জমানো টাকাটা মা নিজে না খেয়ে আমার জন্য পাঠিয়েছেন। অথচ মা নিজেই অসুস্থ। ওষুধ কেনার টাকাটা পর্যন্ত নেই।’

আরও পড়ুন

সম্ভবত সেশন–জট নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগের চরম হৃদয়ছোঁয়া দেয়াললিখন ছিল এটি।

থার্ড ইয়ারের ফলাফল প্রকাশ হলো। চট্টগ্রামের একটা বিখ্যাত ফাউন্ডেশন চবির বিভাগভিত্তিক বৃত্তি প্রদান করেছিল মাত্র এক বছর মেয়াদে। আমাকে তারা ‘ইমার্জিং স্টুডিয়াস’ ক্যাটাগরিতে বৃত্তিটা দেয়। অথচ আমি আজও এই বিশেষণটি ওউন করতে পারিনি।

যাকগে। চতুর্থ বর্ষে উল্লিখিত জোগানের কারণে বাইরের ধান্দা(!) খুব একটা করতে হয়নি। তবে একাডেমিক কারণটাই আমাকে শেষ অব্দি বাংলাবাজারমুখী করে রেখেছিল।

তবে সার্কেল-টু-সার্কেল আড্ডার কমতি ছিল না আমাদের। চাকসু, জারুলতলা, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, শহীদ মিনার, স্টেশন, ১ নম্বর গেট, ২ নম্বর গেট, প্যাগোডা, ল ফ্যাকাল্টি, উস প্রাইমারি স্কুল, উত্তর ক্যাম্পাস, দক্ষিণ ক্যাম্পাস, সেন্ট্রাল ফিল্ড, আলাওল হল গেট, এফ রহমান হল গেট, শাহজালাল-শাহ আমানত-সোহরাওয়ার্দী হল গেট, ট্রান্সপোর্ট, ফ্যাকাল্টি ঝুপড়ি, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম রিসার্চ সেন্টার, কাটা পাহাড়, ফরেস্ট্রি হেলিপ্যাড ঝর্নার পাদদেশ, সায়েন্স ল্যাব, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বিভিন্ন নামীয় কলোনি, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন নামীয় কটেজ এবং পুরাতন শামসুন্নাহার হল গেট থেকে শুরু করে প্রীতিলতা হল গেট ও নতুন শামসুন্নাহার হলের ঝুপড়ি পর্যন্ত এমন কোনো আড্ডার স্পট ছিল না যেখানে আমাদের পা পড়েনি। এককথায় পাহাড়ি এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি কর্নারে আমাদের বিচরণ ছিল অবাধে। আর নিয়মিত সাপ্তাহিক আয়োজনে শাটল ট্রেনে বটতলী স্টেশন, নিউমার্কেট, রিয়াজুদ্দিন বাজার, আন্দরকিল্লা, ষোলশহর, চশমা হিল, জিইসি, হালিশহর, নেভাল একাডেমি, পাহাড়তলী, ভাটিয়ারি, সিআরবি, টাইগার পাস, সানমার ওশান সিটি, অক্সিজেন, সিএমসি, খুলশী, ফয়’স লেক, চিটাগাং কলেজ, হাটহাজারী, জহুর মার্কেট এমনকি পতেঙ্গা সি-বিচও তালিকায় বাদ পড়ত না।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আর ক্লোজ বন্ধুদের সঙ্গে ফেনী থেকে শুরু করে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, নোয়াখালী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় জেলায় ট্যুর করেছি। তা ছাড়া ডিপার্টমেন্টের অ্যানুয়াল স্টাডি ট্যুর বা পিকনিক যা–ই বলি না কেন সব ইভেন্টেই অ্যাক্টিভলি অংশগ্রহণ করেছি।

একবার সেন্ট্রাল ফিল্ড থেকে ১২ ঘণ্টার হিল ট্রেকিংয়ে ট্যুর করেছিলাম। সে এক অবর্ণনীয় আনন্দভ্রমণের উপাখ্যান।

সংগত কারণেই ফোর্থ ইয়ারে গ্রুপ স্টাডি ছাড়া একা পড়ার টেবিলে বসাই হতো না। আমরা প্রতিদিন একটা করি টপিক নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতাম। ‘পলিটিক্যাল করাপশন’ নিয়ে এক বন্ধুর (প্রয়াত) দারুণ দারুণ আইডিয়া পেতাম সে সময়। দেখা গেছে আড্ডায় কিছু বাস্তবভিত্তিক সলিউশন আমরা পেয়ে যেতাম। একজন স্বনামধন্য প্রফেসর (বর্তমানে চবির ভাইস চ্যান্সেলর) আমাদের এ রকম নিত্যনতুন আইডিয়া তৈরির ব্যাপারে উসকানি (!) দিতেন।

বলা বাহুল্য, আমাদের প্রায় সবাই সিনিয়র টিচারদের সমীহ করলেও জুনিয়র টিচারদের খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইত না। কিন্তু আমি একটু ব্যতিক্রমী ছিলাম। যে টপিকগুলো নিয়ে সিনিয়র টিচাররা সময় কম দিতেন, সেগুলোর ব্যাপারে জুনিয়র টিচারদের খুব বিরক্ত করতাম।

নোটপত্র তৈরির পাশাপাশি তখন টুকটাক পত্রিকায় লেখার চেষ্টা করতাম (চিঠিপত্র, স্মৃতিকথা, কবিতা ইত্যাদি)। যদিও মনের আনন্দেই লিখতাম। কিন্তু লেখার বিনিময়ে যদি পয়সা পেতাম তাহলে হয়তো কন্টিনিউ করতাম।

কবিতায় যেমনটা বলে, ‘কবিতা তো খায় না সে, তার বিস্কুট দরকার’।

.....শেষ

আরও পড়ুন