খণ্ডকালীন চাকরি এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা—পর্ব এক
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর পরিবারের বড় একটা অংশের অনুমতি ছাড়াই কলেজের ভর্তি বাতিল করে বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ শ কিলোমিটার দূরের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তারপর আর্থিক জোগানের বিষয়ে পারিবারিক আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, আমাকে মাসিক পাঁচ শ টাকা করে দেওয়া হবে। সানন্দে রাজি হলাম।
 প্রথম বর্ষের অধিকাংশ সময় কেটে গেল হাটহাজারীর প্রত্যন্ত একটা গ্রাম ‘মীরের খিল’–এ একটা যৌথ পরিবারে লজিং থেকে। প্রায় দুই কিলোমিটার কর্দমাক্ত কাঁচা পথ পায়ে হেঁটে ‘নববাক’ নামক ছাত্রসমিতির বাসে করে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতাম।
এদিকে হলের আবাসিক কক্ষের জন্য আবেদন করলাম। মেধা তালিকায় কক্ষ বরাদ্দ পেলাম। শুরু হলো স্বাধীন জীবন। এ এক অন্য রকম স্বাধীনতা। তবে সেই স্বাধীনতার সুখের ঘোর কেটে ওঠার আগেই উপলব্ধি করলাম, এ এক কঠিন সময় পার করছি আমি। বাড়িতে আব্বার অসুস্থতা, মায়ের উদ্বেগভরা চিঠি। জমি বন্ধক রেখে পাওয়া সামান্য কিছু টাকার আয়ু বেশি দিন টেকসই হলো না। (দাদার প্রতিশ্রুত মাসিক পাঁচ শ টাকা ছুটিতে গেলে মাস হিসাব করে দিতেন)
টিউশনি পেলাম। টিউশনির বাজারে মন্দা। তবুও চালিয়ে গেলাম কিছুদিন।
দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে হঠাৎ একদিন ডিপার্টমেন্টের নোটিশ বোর্ডের এক কোনায় শুকনা চোখ জোড়া আটকে গেল একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে। চাকসু পরিচালকের স্বাক্ষরিত ‘ছাত্রকর্মী’ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কক্ষে গেলাম। আগ্রহ পোষণ করলাম, আমি এই কাজে যোগ দিতে চাই। চেয়ারম্যান বারণ করে বললেন, ‘পড়াশোনার ডিস্টার্ব হবে। তোমার ক্লাস মিস হবে।’ জানালাম, আমার খাবারের টাকার জন্য আমি কাজ করতে চাই। চেয়ারম্যান পাল্টা যুক্তি দেননি।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
নিয়োগপ্রাপ্তির আবেদন ফরম পূরণ করে চাকসু পরিচালকের দপ্তরে জমা দিলাম। পরের সপ্তাহে ডিপার্টমেন্ট মারফত ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পেলাম। মলিন পোশাকে বোর্ডরুমে ঢুকলাম। মনে হলো, প্রশ্নের পরিবর্তে পরিচালক নিজেই আমার উত্তর যেন আমাকেই দিচ্ছেন। এই যেমন, ‘তোমার রেজাল্ট ভালো, ক্লাস মিস হবে, পড়াশোনার ক্ষতি হবে।’ সবকিছু শেয়ার করলাম। সবিনয় জানালাম, আমার দুই বেলা খাবারের টাকা হলেই হবে।
ঘণ্টায় ১৫ টাকায় আমরা ১৫ জন স্টুডেন্ট সমস্ত শর্তে ‘ছাত্রকর্মী’ নিয়োগের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করলাম। দিনে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা ডিউটির সীমারেখা আরোপ করা হলো।
ডিউটি ছিল ক্যাফেটেরিয়ার ক্যাশ কাউন্টার, কিচেন ম্যানেজমেন্ট, স্পোর্টস রুম ম্যানেজমেন্ট, কালচারাল ফ্লোর ম্যানেজমেন্ট, নিউজ পেপার অ্যান্ড প্রেসক্লাব ফ্লোর ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালকের দপ্তর ইত্যাদি। একেক দিন একেক ফ্লোরে ডিউটি করতে হতো।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলার স্টাফস ছিল মূল অপারেশনসে। আমাদের কাজ ছিল তাঁদের ফলোআপ করা। তাঁরা আমাদের স্যার ডাকতেন। একদিন শামীম ভাইকে বললাম, আমাকে স্যার ডাকতে হবে না, ছোট ভাই ডাকলেই আমি খুশি। খুশিতে তিনি বললেন, ‘স্যার, আপনারাই তো একদিন বড় বড় চেয়ারে বসবেন। তখন আমাদের মতো ক্ষুদ্র কর্মচারী কীভাবে আপনাকে ভাই ডাকব?’ চলবে...
- লেখক: এম এ সালেক, সাবেক শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা, কর্মসংস্থান ব্যাংক