আজিমপুরের আজব বিল্ডিং—চায়না বিল্ডিং

মতি মামা গেলো ঘরে,

রিনি-ঝিনি খেলা করে।

মতি ভাই হ্যাভি মুড নিয়ে ব্যাট ঘুরাতে ঘুরাতে মাঠের পিচে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড বুন আজিমপুর কলোনির ৪২ নাম্বার মাঠে খেলতে নেমে গেছেন। খুব পোজ দিয়ে স্টান্স নিয়ে দাঁড়ালেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের পেসার কিশোরদা দৌড়ে এসে দুধভাত কোয়ালিটির বলটি ছুঁড়ে দিতেই সামনে-পিছনে দুইবার চেষ্টা করে বলটি টাচ করতেই দর্শকেরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। আবার কোরাস শুরু করল—

মতি মামা ঘোড়া চড়ে,

বাঘ ভাল্লুক শিকার করে।।

আজিমপুর কলোনির ৪২ নম্বর মাঠে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। প্রতি শুক্রবার সকাল থেকেই বিভিন্ন মাঠের টিমের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ হতো। আজকে ২৭ নম্বর মাঠের টিমে বিমান, সূর্যতরুণ, মোহামেডান-আবাহনী টিমে খেলা এবং জাতীয় দল ঘুরে আসা বেশ কয়েকজন তারকা প্লেয়ার খেলছেন। সারোয়ার ইমরান ভাই, মনির ভাই, মোহাম্মদ আলী তাঁদের অন্যতম। ২৭ নম্বর মাঠের অন্যান্য প্লেয়াররাও প্রথম বিভাগ ও প্রিমিয়ার লিগে খেলেন। এদিকে আমাদের ৪২ নাম্বার মাঠের ফাইভস্টার স্পোর্টিং ক্লাবে আছেন আবাহনী, জিএমসিসি, ইয়াং পেগাসাস, আজাদ স্পোর্টিংয়ের বেশ কয়েকজন প্লেয়ার। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কিশোরদা, বাবুল ভাই। খেলার মাঝখানে এলবিডব্লু নিয়ে সাময়িক উত্তেজনা দেখা দেওয়ায় একপাশে ইমরান ভাই, কিশোর দা, মনির ভাইয়েরা আম্পায়ারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। দূর থেকে দর্শকেরা উনাদের রিলাক্স মুডে হাস্য-পরিহাস দেখে ক্রিকেট যে ভদ্র লোকের খেলা, সেটা বুঝতে পারছেন। এ আলাপ আলোচনার ফাঁকে ৪২ নাম্বার বিল্ডিং এর জনপ্রিয় মুখ মতি ভাই মাঠে ঢুকে পড়েন। দর্শকরা করতালি দিয়ে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন।

আরও পড়ুন

আজিমপুর কলোনির বড় বড় মাঠগুলোতে আশেপাশের বিল্ডিংয়ের ছেলেরা খেলত। তাঁদের অনেকেই প্রথম বিভাগ, প্রিমিয়ার লীগে খেলতেন। পার্টিহাউজ মাঠে ইয়াং পেগাসাস, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের প্লেয়াররা অনেক সকালে প্র্যাকটিস করতেন। ইয়াং পেগাসাস দলের প্রায় সবাই ছিল আজিমপুর কলোনির। পুরো কলোনীতে ছিলো একটা শিক্ষা-বান্ধব, ক্রীড়া-বান্ধব, সাংস্কৃতিক-বান্ধব পরিবেশ। ১২ নাম্বার মাঠের আনিস, ফরহাদ ভাইসহ অসংখ্য প্লেয়ার এখান থেকে উঠে এসেছেন; জাতীয় দলে সেবা দিয়েছেন। এখানে স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত পড়া ছাত্ররা নির্মাণ স্কুল টুর্নামেন্টে হাতেখড়ি দিয়ে পরবর্তীতে সিনিয়রদের সহযোগিতায় সেকেন্ড ডিভিশন হয়ে ফার্স্ট ডিভিশন ও প্রিমিয়ার লীগে ক্রিকেট খেলতো। চায়না বিল্ডিঙের গলি থেকে আসতেন জি এম নওশের প্রিন্স ভাইসহ আরও অনেকে। এরা সবাই তাদের শিক্ষাজীবনে ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, উদয়ন স্কুল, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পরস্পরের সহপাঠী; পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা ভার্সিটি, বুয়েট, ডিএমসিতে পড়াশোনার সুবাদে যেকোন সমস্যায় পরস্পরের প্রতি হিংস্র মনোভাব না দেখিয়ে বরং বন্ধুসুলভ সহনশীলতায় অপরকে ছাড় দেয়ার শিক্ষা পেয়েছেন।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেলে আবার ক্রিকেট গ্রুপের পরিবর্তে ফুটবল গ্রুপের আওতায় থাকতো মাঠগুলো। আমরা ২৭ নাম্বার, ১০ নাম্বার, কমিউনিটি সেন্টার মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টগুলো দেখতে যেতাম। এই টুর্নামেন্টগুলোর আকর্ষণ ছিল রং-বেরঙের জার্সি পরিহিত প্লেয়াররা। এখান থেকেও উঠে এসেছেন দেশ বরেণ্য অনেক প্লেয়ার। এখানে রহমতগঞ্জ, ফরাসগঞ্জ, লালবাগ, শেখ সাহেব বাজার থেকে অনেক টিম খেলতে আসত। ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন ও জাতীয় দলের প্লেয়ারদের দৃষ্টিনন্দন খেলা আমরা সরাসরি উপভোগ করতাম। মোহামেডান ও জাতীয় দলের গোলরক্ষক পনির ভাইয়ের কঠোর পরিশ্রম আমাদেরকে অনুপ্রেরণা দিত। লা ভাই বিভিন্ন মাঠে খেলারত স্কুলছাত্রদের বাজপাখি চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন; পরে তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বেছে তাঁর কোচিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতেন। কমিউনিটি সেন্টার ও ছাপরা মসজিদসংলগ্ন এলাকায় টেবিল টেনিস প্লেয়ারদের আনাগোনা ছিল। অন্যতম আকর্ষণ ছিল জাতীয় পর্যায়ে খেলা কিসলু ভাইয়ের পারফরম্যান্স।

আরও পড়ুন

ফুটবল, ক্রিকেট, টেবিল টেনিসের বাইরে ব্যাডমিন্টন ও হকি খেলাও প্রচুর হতো। কিন্তু, ওই সময়ের ট্রেন্ড ছিল মহল্লার মারামারিতে ছেলেপেলেদের হকিস্টিক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। প্রায় টিমেই সবার খেলার জন্য হকিস্টিক থাকতো না। বিভিন্ন হুল্লোড়ে স্টিকগুলো প্রায়ই ভেঙে যেতো। আমাদের দুর্বার ক্রীড়া চক্রের (শত্রুপক্ষের ভাষ্য—দুর্বল ক্রীড়া চক্র) হকিস্টিকগুলোর প্রায় সবগুলোই সিনিয়ররা মহড়া দিতে গিয়ে ভেঙে ফেলায় একসময় আমরা লম্বা লাকড়িকে হকিস্টিকের মতো ব্যবহার করে খেলতাম।

ফুটবল-ক্রিকেটের ফাঁকে-ফাঁকে মার্বেল, ডাংগুলি, লাট্টু (লাটিম), বোম্বাস্টিং, সাতচাড়া আর ঘুড্ডি (ঘুড়ি) ওড়ানোটাও চলত। মার্বেল খেলায় কচি-কাঁচাদের অশংগ্রহণ থাকলেও এর মাখন খেতো মিডিয়াম সাইজের ভাইয়েরা (ক্লাশ নাইন-টেন)। বিভিন্ন বাগানে মাটিতে গর্ত করে গায়ে–কাপড়ে মাটি লাগিয়ে মার্বেল খেলার মজাটাই আলাদা! চুগ্গি (খুব ছোট), ডাগ্গি (খুব বড়), টেমা (পুরোপুরি গোল নয়), কামরাঙ্গা (রঙিন) ইত্যাদি নামের বিভিন্ন শেপের মার্বেল দিয়ে খেলায় হঠাৎ করে মাসুদ ভাই-শিমুল ভাইয়েরা চিলের মতো হানা দিতো। জানে-পরানে মার্বেল ফেলে সবাই ঝেড়ে দৌড়। দু-একজনকে হাতেনাতে ধরতে পারলে কান ধরিয়ে দুই-তিনবার উঠ-বস করিয়ে কিছু মার্বেল ড্রেনে ফেলে দিয়ে বাকিগুলো সিজ করত। কোনো একদিন শিমুল ভাইদের অ্যাকুরিয়ামে আমাদের মার্বেল দেখে খালাম্মার কাছে বিচার দেয়ায় সবগুলো ফেরত পেয়েছিলাম।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

লাটিম খেলাটা বেশ দক্ষতার সঙ্গে খেলতে হতো। খেলোয়াড়দের আশেপাশে বেশ কয়েকজন দর্শকও জুটে যেতো। লালবাগ, চকবাজার থেকে ভালো ভালো বড় সাইজের লাটিম এনে শিমুল ভাইয়েরা তাক লাগিয়ে দিতেন। বোম্বাস্টিং খেলাটা টেনিস বল দিয়ে ফ্রি-স্টাইল খেলা। যে যাকে বল দিয়ে মারতে পারে! শরতের সাদা মেঘওয়ালা আকাশটা ভরে যেতো পঙ্খিরাজ, চাঁদিয়াল, ডায়মন্ড ইত্যাদি নামের লাল-নীল-সাদা-সবুজ-বেগুনি ঘুড়িতে। মাঞ্জা দেওয়ার জন্য লালবাগ, নবাবগঞ্জ বাজার পর্যন্ত যেতে হতো। যে যত বড় সাইজের নাটাই ব্যবহার করতো, সে ততো বড় কুতুব! প্রতিটি বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে দুই-একজন করে ঘুড়ি উড়াতো। যখন কাটাকাটিতে ছাপ্পা (ভোকাট্টা) হয়ে যেতো বিরাট একদঙ্গল ছেলে-পুলে হাতে বাঁশের আঁকশি নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে ছুটতো। বিরাট আনন্দ!

সন্ধ্যায় রেশন শপের পাশ থেকে ভেসে আসতো গিটারের সঙ্গে—

‘দ্বীপ জ্বলা রাত

জানি আসবে আবার,

কেটে যাবে জীবনের

সকল আঁধার।’

কিংবা

‘...আবার এলো যে সন্ধ্যা

শুধু দুজনে

চলো না ঘুরে আসি অজানাতে।’

গানের সুর।

আরও পড়ুন

হ্যাপী ভাইয়ের (হ্যাপি আখান্দ্‌) ওই গানে পড়ার টেবিলে আমরা উদাস হয়ে যেতাম। বিকাল বা সন্ধ্যায় তিনতলার দুলাল ভাইয়ের কাছে হ্যাপী ভাই, লাকী ভাই (লাকী আখান্দ্‌) আসতেন। ১০ নাম্বার, ১২ নাম্বার মাঠের আশপাশে কাওসার আহমেদ চৌধুরী বন্ধুদের নিয়ে হাঁটতেন। সব সময় উনার মাথায় একটা টুইড ক্যাপ; মোটা ফ্রেমের চশমার সঙ্গে মুচকি হাসি, অন্যদের থেকে আলাদা মনে হতো। মনে হতো শার্লক হোমসের বন্ধু ডা. ওয়াটসন।

আমরা দুই ভাই দিনের এক থেকে দেড় ঘণ্টা আমাদের বিল্ডিঙের দুই তলার সিঁড়িতে ক্রিকেট খেলতাম। ইমন ব্যাটিংয়ে খুব ভালো ছিলো। আউট করা যেত না। বোলিং-ব্যাটিংয়ের সঙ্গে দুজনেই সমানে ধারাবিবরণী দিতাম; ‘ইমরান খানের আউট স্যুইংয়ে কুপোকাত ব্যাটসম্যান’, এর পাল্টা জবাব, ‘গাভাস্কার দেখেশুনে ব্যাকফুটে অবস্থান নিয়ে সজোরে ছক্কা হাঁকালেন।’ মাঝেমধ্যে বল পাশের বাসার রাখি আপাদের দরজায় আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে খালাম্মার বাজখাই কণ্ঠস্বর ‘এই কেরে বল খেলে’—শুনে ব্যাট-বল ফেলে আমরা একজন ওপরতলা, অন্যজন নিচতলার সিঁড়িতে চলে যেতাম। খালাম্মা মাঝেমধ্যে দরজা খুলে আমাদের বল-ব্যাট সিজ করতেন পাঁচ-দশ মিনিট পর রাখি আপা দরজা খুলে আস্তে করে আমাদের বল-ব্যাট ফেরত দিতেন। খেলার মধ্যে অনেক সময় নিচতলা থেকে ভেসে আসত, ‘ভাইয়া, একটু খেলা থামাও, আমি আসছি।’ সামিনা নবি অথবা ফাহমিদা নবি আপা, রাখি আপার বান্ধবী। দুজনকে একইরকম মনে হতো। কখনো কখনো চায়না বিল্ডিঙের গলি, ছাপরা মসজিদের আশেপাশে দেখতাম ঝাঁকড়া চুলের ভাস্কর রাশা, সকাল-সন্ধ্যার মাখনা ভাই কিংবা গায়ক আজম খানকে। কবরস্থানসংলগ্ন নিউপল্টন গলি দিয়ে উন্মাদের আহসান হাবিব ভাইকে দেখলে মনটা আনন্দে ভরে যেত। এক নাম্বার বিল্ডিংয়ে সকাল-সন্ধ্যার রচয়িতা বেগম মমতাজ হোসেন আর হুমায়ূন আহমেদের এসব দিনরাত্রি নাটক জনপ্রিয় হওয়ার পর এর পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব পোস্টাল কলোনিসংলগ্ন যে বিল্ডিঙে থাকতেন সেটাও দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। পলাশীর আশেপাশে মাঝেমধ্যে হেঁটে যেতে দেখতাম কবি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহাকে। উনাদের কালচে এবং সোনালি লম্বা চুল খুব আকর্ষণীয় ছিল। মাঝেমধ্যে মনে হতো এগুলো সত্যিকারের চুল নাকি নকল!

সন্ধ্যায় আব্বা-আম্মার সঙ্গে হোম ইকোনমিক্স কলেজসংলগ্ন কলোনির উত্তর পাশের খালার বাসা থেকে ফেরত আসার সময় বেবি আইসক্রিম মোড় পেরোতেই কানে ভেসে আসত—

‘একটা চাবি মাইরা

দিছে ছাইড়া

জনম ভইরা চলতে আছে,

মন একটা দেহ ঘড়ি-ই-ই-ই।।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

একটু এগোতেই আজিমপুর গার্লস স্কুল, আজিমপুর মেটারনিটি। আরও প্রবল হয়ে কানে বাজে গানের শব্দ। সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা মার্কেটের স্টুডিও হিলটনের পাশে তেঁতুল গাছের নিচে আব্দুর রহমান বয়াতী সঙ্গীসাথিদের নিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে একটার পর একটা গান গেয়ে যাচ্ছেন। ডুগি-হারমোনিয়াম-করতালের সুরে আচ্ছন্ন উনাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ানো একদল মানুষ। আম্মা মাঝেমধ্যে রিকশা থামিয়ে গান শুনতে চাইলেও আব্বা রাজি ছিলেন না। সবাই আমাদের কত আপন ছিলেন।

কমিউনিটি সেন্টারের পশ্চিম দিকে ছিলো একটি বিশাল পুকুর। সন্ধ্যার পর এলাকাটি খুবই নির্জন হয়ে যেত। পুকুরের পশ্চিমে আজিমপুর কবরস্থান, উত্তরে আজিমপুর লেডিস ক্লাব, অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়, তারও উত্তরে পার্টিহাউজ মাঠ। নির্জনতা পুরো এলাকাকে সন্ধ্যার পর রহস্যময় করে তুলত। এত সিকিউরড এলাকা হওয়ার পরও কিছু কিছু অঘটন ঘটে যেতো এই পুকুরকে ঘিরে। পরবর্তীতে এই পুকুর ভরাট করে জজেস কোয়ার্টার তৈরি হয়। কমিউনিটি সেন্টার মাঠে ছেলেরা খেলা শেষ করে ইচ্ছে করেই ফুটবলটিকে কিক করে পুকুরে ফেলত। এ যেন বাংলা রচনার সেই ‘গরুকে নদীতে ফেলা!’ ভাবটা এমন বলটা হঠাৎ করেই পড়ে গেছে। বল উঠাতে তো কাউকে নামতেই হয়! যেহেতু ভয়ংকর এলাকা। এ জন্য একজন নামলে তো হয় না! তাই, দলেবলে পুরো ব্যাটেলিয়ানই নেমে পড়ত; হুটোপুটি করে বাসায় ফিরত।

টিনের তৈরি দৃষ্টিনন্দন পার্টিহাউজ কলোনির পূর্বে বিশাল একটি পুকুর, দক্ষিণে পার্টিহাউজ মাঠ এবং এর পূর্বে ছোট গোল তৃতীয় পুকুরটি আজিমপুর কলোনির ভেতরে গ্রামীণ পরিবেশ তৈরি করেছিল। ছাপরা মসজিদ থেকে কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত অসংখ্য কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়া, জারুলগাছ গরমের দিনে এলাকাটিকে সম্পূর্ণ রঙিন করে তুলত। প্রায় প্রতিটি বাগানেই ছিলো সজনে, আতাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফলগাছ। কো-অপারেটিভ শপ থেকে শুরু করে আরও উত্তরে বিশাল বিশাল আকাশমনি, কড়ই, কদম ও ছাতার মতো কাঠবাদাম গাছ কলোনিটিকে আশেপাশের লালবাগ-শেখ সাহেব বাজার এলাকার লোকজনের হাঁটাহাঁটি এবং জগিংয়ের অন্যতম স্পট করে দিয়েছিল। সন্ধ্যার পর কমিউনিটি সেন্টার লাগোয়া আজব বিল্ডিংয়ের কোনায় ‘নোয়াখাইল্লা মামুর চটপটি’ খাবার জন্য ইডেন-হোম ইকোনমিক্স কলেজের মেয়েরা ভিড় জমাতো। আজিমপুর গার্লস স্কুলের উত্তর দিকে বুয়েটের পলাশী ব্যারাকের টিনের কোয়ার্টারকে মনে হতো মফস্বল বা গ্রামের একটি বিশাল সেটআপ। প্রচুর গাছ ও বাগান এই এলাকাটিকে খুবই মনোহর করে তুলেছিল।

লিটিল অ্যাঞ্জেলস স্কুলের আশে পাশে পুলিশ কর্মকর্তাদের বাসা, নিউমার্কেট ঘেঁষে উত্তর সীমান্তে ডাক বিভাগের কর্মকর্তা ও কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন জজ সাহেবের বাসা বরাদ্দ ছিলো। আজিমপুরের নব্বইটি বিল্ডিংয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল ‘আজব বিল্ডিং’। কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন এই ডুপ্লেক্স কলোনিটি ছিল ষাট-সত্তর দশকের একটি বিষ্ময়। কনসেপ্টটিই ছিলো আলাদা। আমরা কলোনির অন্যান্য ফ্ল্যাটে যারা থাকতাম, তারা ‘আজব বিল্ডিং’–এর নিচতলা থেকে ‘উঁকিঝুঁকি’ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম, বাসার ভিতর সিঁড়ি দিয়ে কীভাবে দুই তলায় উঠে যাওয়া যায়!

তৎকালীন সময়ে চীনাদের বাড়ির আদলে তৈরি চায়না বিল্ডিংটা ছিল বেশ বড়। একটা টানা বারান্দা হতে একের পর এক ফ্ল্যাট। চায়না বিল্ডিঙের ছাদে আমরা কজন দাবাড়ু বন্ধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা খেলতাম। মাঝেমধ্যে ঐ বিল্ডিংয়ে থাকা আম্মার সহকর্মী লাইলি খালার মেয়ে উর্মি আপা খেলার গতি-প্রকৃতি দেখে যেতেন-বলতেন, ‘তোর হাতি-ঘোড়া সবই তো কেটে ফেললো, কীভাবে জিতবি?’ কী মায়া আর উদ্বিগ্নতা। কোথায় পাবো?

*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।