ইস্টিশনের গান
চিন্তা করে দেখো না,
কোথায় আসল ঠিকানা।
চিন্তা করে দেখো না,
কবর আসল ঠিকানা।
বুকের মাঝখানে ধক করে কথাগুলো ধাক্কা মারল। বাঁ দিকে একটু দূরেই হাতে দুটি ক্রাচ নিয়ে এক পা ক্ষতিগ্রস্ত ভদ্রলোক গেয়ে চলেছেন—
-কত আদরের মা-বাবা মোদের,
কেমন আছে তারা
কবর মাঝার,
সে কথা আজও অজানা।
আমরাও চলে যাব,
বেলা অবেলায়
বিদায় বেলা তব দিও গো দেখা, ও প্রিয় রাসুল।।
-বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ‘পারাবত’–এর জন্য অপেক্ষায় আছি। আমার মেয়ে জুঁই জোরে হাত চেপে ধরে কান্না কান্না কণ্ঠে বলল, ‘আব্বা, উনারা এত কষ্টের গান কেন গায়?’
-উনি সাহায্য চান।
-উনাকে টাকা দাও, উনার পা–টা ঠিক করে দাও।
রেল এবং রেলস্টেশনে এলে সাহায্যপ্রার্থী কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে চলা অনেক মানুষকে প্রায়ই দেখি। উনাদের আর্তি মনে নাড়া দেয়।
ট্রেনে ওঠার পর জুঁইয়ের মন খারাপ, কমার কোনো লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি না। ট্রেনে উঠেই জানালার পাশে বসার জন্য তার ভাইয়ের সঙ্গে ব্যাপক কম্পিটিশন চলে। সে-ই চ্যাম্পিয়ন। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই।
জুঁই: আব্বা, ফকিরেরপুল কয়টা?
আমি: কেন?
জুঁই: এই যে আমরা গতকাল একটা ফকিরেরপুলে গিয়েছিলাম। আবার আজকে আর এক ফকিরেরপুলে যাচ্ছি।
গতকাল ওদের নিয়ে বিজয়নগরের দিকে গিয়েছিলাম। রাস্তার দুই পাশে ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাইনবোর্ডের নিচের লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে। বিজয়নগরের ফকিরেরপুলে কোনো প্রফেশনাল ফকির বা পুল কোনো কিছুই না দেখে দুই ভাই-বোনই অবাক। এদিক দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফকিরেরপুল তাদের নিরাশ করবে না। শহরের মাঝখানের খালের ওপর প্রধান সড়কের পুলটি ঘোড়াপট্টি এলাকায় হলেও এখানে বেশ কয়জন অন্ধ সাহায্যপ্রার্থী বসে থাকেন।
দিপুকে রুমে ঢুকতে দেখেই রুমমেট শেলি ঠকাস করে ড্রয়ারের তালা লাগিয়ে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে বসল। দিপু আজকেও ব্যাগি প্যান্টটা পরে আছে। এই প্যান্টে কতগুলো পকেট আছে, দিপুও বলতে পারবে না। সে একই সঙ্গে ডাক্তার (হবু) আবার ইঞ্জিনিয়ারও! মেডিকেলে পড়লে কী হবে, তার ঝোঁক ইলেকট্রিক আর ইলেকট্রনিক গুডসের ওপর। তার পকেট ভর্তি স্ক্রু-ড্রাইভার, সুইচ নাইফ, টেস্টারসহ আরও এগাড়া-বেগাড়া অসংখ্য যন্ত্রপাতি। সে যে রুমে যায়, সেখানেই চঞ্চল চোখে দ্রুত জরিপ সেরে কোনো একটা ঘড়ি, টু-ইন-ওয়ান, ফ্যানের দিকে হাত বাড়ায়। ‘দিপু চানাচুর খাবে’ একদৃষ্টিতে সে আমার টেবিলের ওপর টেবিলওয়াচের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি প্রমাদ গুনে বললাম, ‘ঘড়িটি নতুন, পরশুই এটা আমার খালা বিদেশ থেকে উপহার হিসেবে এনে দিয়েছেন, এর দিকে বদ নজরে তাকাবে না।’ সে আসলে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে যন্ত্রপাতি খুলতে পারে, পরে কী হবে, সেটা ঠিক জানে না। তার দুই রুমমেট প্রায়ই উপযাচক হয়ে হোস্টেলের কে কোথায়, কোন রুমে নতুন পুরোনো ইলেকট্রিক গেজেট নিয়ে ঝামেলায় আছে, তথ্য সাপ্লাই করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দিপু আমার রুমে। গতকালই ঢাকা থেকে এসেছি এই নতুন টেবিলঘড়িটি নিয়ে। দিপুর রুমমেট সন্ধ্যায় এই ঘড়িটি দেখে গেছে, সঙ্গে চানাচুরও।
দিপু: কদিন থাকলে?
আমি: তিন দিন। তুমি কদিন যাও না?
দিপু: দুই মাস, ফাইনাল প্রফ শেষ করে যেতে যেতে পাঁচ মাস হয়ে যাবে।
পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস দিপু।
আমি: তো ট্রাফিক কন্ট্রোল
শুরু করছো?
দিপু: হা: হা: এখন বড় হইছি
না! কদিন পর ডাক্তার হমু না?
সেকেন্ড প্রফের আগে পড়াশোনার একঘেয়েমি কাটাতে দশ-বারো দিন পরপর বিকেলে শহরে যেত। মেডিকেলের বাসে জাহাজ কোম্পানির মোড়ের নৃপেনের দোকানে নামত। গরম–গরম রসগোল্লা খেয়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডে হাত-পা নেড়ে অফচান্সে গাড়ি-ঘোড়া কন্ট্রোল করত!
ফাইনাল পরীক্ষা চলে এসেছে। সন্ধ্যায় ওয়ার্ড প্লেসমেন্টের জন্য হাসপাতালে ক্লাসে গিয়েছিলাম, সঙ্গে রিডিং পার্টনার উত্তমদা। খুব ব্রিলিয়ান্ট উত্তমদা রিটেন পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত, ‘বাড়ি, গোডাউনে যে মজুত আছে, পাস নম্বর তো উঠবেনানি।’ ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার কলকাতা মেডিকেল কলেজের ফেলো বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার কেশবলাল সাহার ছেলে উত্তমদা। উনি যখন রিটেন পরীক্ষায় পাস নম্বর নিয়ে চিন্তিত, তখন আমাদের মতো ডাল ব্রেনের ছাত্রদের আর কী করার আছে। উনার ফটোগ্রাফিক মেমোরি। একটা পড়া বইয়ের পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে গড়গড় করে না দেখে পুরোটাই বলতে পারেন। অসাধারণ ধীমান। ওনার সঙ্গে পড়াশোনা করতে বসলে খুবই অসহায় লাগে। একবার পড়ার পর, ‘ও ছোড ভাই হইছে?’ শুনলে অকূলপাথারে পড়ে যাই। আমাকে আরবে পড়াশোনার সুযোগ দিয়ে বিভিন্ন রুমে উঁকিঝুঁকি মেরে পরীক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আইডিয়া নিয়ে আসেন। পাস নম্বর ৬০। সবাই রিটেন, ভাইভা আর ক্লিনিক্যাল প্রতিটিতেই পাস করতে পারবে না, তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বন্ধু পাস করলে তো মানসম্মান নিয়ে প্রশ্ন! এ জন্য মুক্তা হোস্টেলে উত্তমদার রুমের সামনে আলাদা একটি টেবিল-চেয়ারসহ পেতে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পার্শ্ববর্তী পিন্নু হোস্টেলের শামীম ভাই আর লরিন হুজুরের পড়াশোনার ওপর মানসিক চাপ তৈরির চেষ্টা চলছে। ক্লাসে লরিন হুজুর খুব হতাশ হয়ে বলতেন, ‘তোরা সারা দিন-রাত পড়াশোনা করিস কীভাবে? তোদের ঘুম পায় না? এত এনার্জি কোথায় পাস?’
জুঁইয়ের ঝাঁকুনিতে ছাত্রজীবন থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম, ‘আব্বা, ওনাদের চোখ এমন কেন? দেখতে পান না? ওনাদের গান অন্য রকম কেন?’
-লক্ষ করে দেখেনগো ভাই চক্ষু দুটি নাই।
এই পৃথিবীর ভালো-মন্দ
আমি দেখি নাই।
আমি: বাবু, উনারা চোখে দেখতে পান না; খুব অসহায়।
জুঁই: উনারা কি ভিক্ষা করছেন? উনারা ভিক্ষুক?
-কারবা মনে হবে মায়া
কে করিবে দান,
যদি দিলে লাগে দয়া
আল্লাহর ওয়াস্তে করো দান।
-অন্যের সহায়তা ছাড়া তাঁদের জীবন চলা দায়-বলে বিনয়ী মিনতি।
-গরিব দেখো অন্ধের মতো
এই দুনিয়ায় নাই-ই, আমি অন্ধ, কপাল মন্দ
সবারে জানাই। আল্লাহ তাআলা খাইবার দিছেন
দশজনের কামাই।
জুঁইয়ের মন খারাপ ভাব কাটছেই না। এই দুজন অন্ধ মানুষ নিজেদের চোখে না দেখার আর্তি সবাইকে জানাচ্ছেন। সবার মনকে দয়ার্দ্র করে ফেলেছেন। প্রথমেই নিজের অসহায় নিঃস্ব অবস্থাটা জানিয়ে আল্লাহ-রাসুলের কাছে দাতার জন্য দোয়া এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন।
-বিসমিল্লাহির রহমানুর রহিম
করছেন টাকা দান,
এই দানের প্রতিদান
আল্লাহ করবেন দান
হাশরের ময়দান।
হায়াতো বাড়াইয়া দিয়ো
রিজিক করো দান।
জুঁই: চোখে অপারেশন করে ভালো করা যাবে। না? উনারা সবার জন্য ভালো চান কেন?
আমি: ওনারা ভালো, এ জন্য আল্লাহর কাছে সবার ভালো চান।
ভৈরব স্টেশনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্যের জোর-জবরদস্তি দেখে দুই বাচ্চাই ভয় পেয়েছে, ‘উনারাও চাইল আর এরাও চাইল; এ তো অন্য রকম কেন?’ তার মন ভালো করার জন্য বললাম, ‘দেখো, অন্ধ সাহায্যপ্রার্থীরা আত্মসম্মান নিয়ে চলেন; কারও কাছে সরাসরি ভিক্ষা চান না। বিনিময়ে সুন্দর গান, অন্যের ভালো চাওয়া, কোনো আয়াত বলেন। অনেক সময় উপদেশমূলক কথা গানের মাধ্যমে জানান।’
- নামাজ-রোজা ছাইড়ো না
বাবা-মারে ভুইলো না।।
‘চিপস চলবে-পেপসি চলবে’ বলে কিছুই চালাতে পারছি না আজ। অন্য সময় ট্রেনে ওঠার আগে এক দফা চিপস-কোল্ডড্রিংকস শেষ করে রাস্তায় আরেক দফা দান মারে।
জুঁইয়ের মন খারাপ, আস্তে আস্তে আমাকেও সংক্রমিত করে। ভৈরবের মেঘনা ব্রিজের ওপর থেকে আশুগঞ্জের সোনারামপুর চর পাড় করে দূরে আকাশের মেঘের মধ্যে ডা. আহমেদ তৌফিক এলাহী দিপু আর ডা. উত্তম সাহার মুখগুলো দেখার চেষ্টা করি। দু–দুজন হাসিখুশি তুখোড়–তরুণ ডাক্তার আকাশের কোনো ঠিকানায় হারিয়ে গেল?
*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর