যে দিন গেছে
‘শালিক শালিক টো টো ভাই
আমার কোনো দুঃখ নাই।’
কোনো এক অজানা শঙ্কায় আম্মা একটি শালিক পাখি দেখে এই ছড়া বলে ইতিউতি তাকাচ্ছেন। আমরা বুঝতে পারছি, উনি আশপাশে কলাগাছ খুঁজছেন। কলাগাছ দেখলে এক শালিকের কুফা কাটাকাটি! আমিও ভয়ে দুটি শালিকের জোড় খুঁজছি। দুই শালিক দেখা নাকি ভালো লক্ষণ! পড়া না পারলেও শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম! আজিমপুর লেডিস ক্লাব শিশু বিদ্যালয়ের গেটের কাছে বিরাট কদমগাছটির নিচে জোড়া শালিক দেখে আম্মার মুখের দুশ্চিন্তার রেখা উবে যায়। আমরা স্কুলের বিশেষ কৌণিক গম্বুজ আকৃতির ছাদের নিচে লাল বিল্ডিং দেখে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে যাই। স্কুল মানে আনন্দ!
‘রুবী আপা, ইমন কি আপনার ক্লাসে এসেছে?—সাবিহা খালা। ‘রুবী আপা’—আম্মা ও ‘সাবিহা খালা’—সাবিহা বেগম যথাক্রমে ওয়ান ও বেবি ক্লাসের ক্লাসটিচার। হন্তদন্ত হয়ে আসা সাবিহা খালার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে আম্মা বললেন, ‘আজকেও পালিয়েছে?’ একই ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠের কোনায় ঢেঁকি খেলারত ইমনকে পাওয়া গেল, সঙ্গে বাবু।
আজিমপুর কলোনির এক পাশে আজিমপুর লেডিস ক্লাব শিশু বিদ্যালয়। এ স্কুলের পশ্চিম বাউন্ডারির পেছনে আজিমপুর কবরস্থানের জংলা জায়গা। দিনের বেলাতেই ভুতুড়ে নির্জন পরিবেশ। ১৯৫৬ সালে আজিমপুর কলোনির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গৃহিণীদের রিক্রিয়েশনের জন্য এই লেডিস ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এ ক্লাবের সভ্যরা বুটিক-নাচ-গান-বাজনা-চিত্রকলা শেখানোর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির শিশু ও নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। একই সঙ্গে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা ইনস্টিটিউট ও শিশু একাডেমির সম্মিলিত সহযোগিতায় খুব দ্রুত এই লেডিস ক্লাবের নাম পুরো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
আব্বার সহকর্মী বিশিষ্ট সমাজসেবী জোবেদা খানমের মাধ্যমে আম্মা বদরুন নাহার বেগম এ স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। আমরা দুই ভাই একই বছর স্কুলে ভর্তি হওয়ায় একসঙ্গেই আমাদের মা-ছেলেদের পদচারণ শুরু হয়। শুরুতে শপথ, জাতীয় সংগীত ও প্রাথমিক কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে শিশুদের মননে জাতীয়তাবোধ এবং আদর্শ ও নৈতিকতার বীজ বপন করা হয়। মিষ্টি স্বভাবের গানের শিক্ষক ফাতেমা বেগমের (ফাতেমা খালা) আন্তরিকভাবে শিশুদের গান শেখানোর চেষ্টা এখনো মনে পড়ে।
সবচেয়ে ছোট ক্লাস নার্সারির শিক্ষক মরিয়ম বেগম (মেরী খালা) প্রায়ই স্কুলের তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের দু-তিনটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন। অবসরের পরও বার্ধক্যের শেষ সীমা পর্যন্ত প্রায়ই উত্তরা থেকে জ্যাম ঠেলে স্কুলে এসে বাচ্চাদের আদর করে যেতেন; সঙ্গে থাকত ব্যাগভর্তি চকলেট, বিদেশি বিস্কুট।
ক্লাস টুর আনোয়ারা বেগম (আনু খালা) আর প্লে গ্রুপের লাইলি বেগমের (লাইলি খালা) চটপটে, হাসিমুখ দেখে বাচ্চারা আশ্বস্ত হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বিষয়ে মাস্টার্স করা সাবিহা খালা বড় বড় চাকরির অফার ফিরিয়ে এই ছোট্ট স্কুলটিতে সময় দেওয়াকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষিকা জমিদারজায়া বিজয়া রায়চৌধুরী ছিলেন ফরসা, ছিপছিপে একজন শিক্ষক।
ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে বেশ সমীহ করত। পড়া বোঝানোর পর আদায় করতে দরকার লাগলে হাতে দু-একটা স্কেলের বাড়ি মারতেন। স্কুলের সব শিক্ষক সবাই সবার নাম বললেও প্রধান শিক্ষিকাকে ‘দিদি’ বলেই সম্বোধন করতেন। আমরা দুই ভাই ভাবতাম, তাঁর ডাকনাম দিদি, তাই উনি ‘দিদি আপা’!
বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বস্তাদৌড়, বিস্কুটদৌড়, চামচদৌড়, মিউজিক্যাল চেয়ার প্রতিযোগিতায় স্টাফ বাদশাহর মামা, মোহন মিয়া, ওয়াহিদ মিয়াদের উৎসাহ শিশুদের তুলনায় কোনো অংশেই কম ছিল না। বছরের প্রথমে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে তিন দিনব্যাপী মীনা বাজার অনুষ্ঠানে ক্লাবের সভ্য ও শিক্ষার্থীরা তাদের হাতের মিনাকারি করা জিনিস, নকল গয়না, বিভিন্ন ধরনের নাশতা ও হস্তশিল্পসামগ্রী নিয়ে বসেন।
আমার ও ইমনের মধ্যে ধৈর্যের টাগ অব ওয়ার চলছে—‘মাহমুদাবু’ খালার বাসায় বিস্কুট-চানাচুরের প্লেট সাবাড় করার পর অবশিষ্ট বিস্কুটটা কে নেবে সেটা নিয়ে। ভয়ে আম্মার দিকে তাকাচ্ছি না, চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেবেন! এর মধ্যে দু-তিনবার গলাখাঁকারি দিয়ে আম্মা আমাদের ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত প্রেরণ করেছেন।
মাহমুদা বেগম, আম্মার খালাতো বোন। কলেজের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপনা ছেড়ে ডেপুটি সেক্রেটারি হয়েছেন। আমাদের পাশের ভবনে উনার বাসা। প্রায় বিকেলেই খালা বিদেশি ভাষা শিক্ষার ক্লাস করেন।
স্পেনিশ, জার্মান, জাপানি, মাঞ্চুরিয়ান ভাষা শেখার পর অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে শিখছেন ফ্রেঞ্চ ভাষা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন্দন ভাই পাঁচ থেকে ছয় মাস পরপর কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় মাথায় বা হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে থাকেন। এবার নাকে ও মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা নন্দন ভাইকে দেখে মিসরের মমির মতো লাগছে। এর মাঝেই কোঁ কোঁ করতে করতে আম্মার কাছে নালিশ দিলেন, ‘খালা, এই দুইটা রাস্তায় আমাকে তুই–তোকারি করে দৌড় দেয়।’
প্রায়ই টিলো-এক্সপ্রেস খেলতে গিয়ে উনাদের বাসায় পালিয়ে থাকি। বসে বসে টিভিতে কার্টুন দেখার ফাঁকে নাফিজা আপাকে অনুরোধ করি বারান্দা দিয়ে দেখতে—খেলার চোর এখন কোনো দিকে ঘোরাফেরা করছে! গত দিন বিকেলে টিলো-এক্সপ্রেস খেলার সময় দুধ খেতে দেওয়ায় আম্মার কাছে অনুযোগ করেছি। আম্মা আমাদের প্রেস্টিজ পাংচার করে মাহমুদা খালার কাছে বলে দেন, ‘মাহমুদাবু, আপনারা মেহমানদের দুধ খেতে দেন কেন?’ খালা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন।
কিছুদিন আগে পিচ্চি সাইজের আস্ত কাঁঠাল ভেঙে শাহানা আপা আমাদের খেতে ডাকেন। আমরা আপন মনে কাঁঠাল থেকে কোষ বের করে খাওয়ার সময় ওনারা চার ভাইবোন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসছিলেন। এটা দেখে তাড়াতাড়ি খাওয়া ফেলে লজ্জায় দৌড়ে মাঠে চলে আসি। ভালো-মন্দ কিছু রান্না হলে টেলিফোনের পাশাপাশি নন্দন ভাই বারান্দা দিয়ে, ‘ওই সুমইন্যা-ওই ইমইন্যা তাড়াতাড়ি আয়’ বলে প্রায়ই আমাদের নিমন্ত্রণ করেন।
আম্মা ‘মাহমুদাবু’ ডাকেন; আমরা কথা গুলিয়ে ‘মাহমুদাবু খালা’ ডাকি। এটা শুনে উনি খুব মজা পান। কিন্তু আমরা ধরতে পারি না কেন হাসেন?
‘জাহেদাবু’ খালা আমাদের আরেকজন ‘বু’ খালা! উনি মাহমুদা খালার বড় বোন কবি ও সমাজসেবী জাহেদা খানম। ধানমন্ডিতে উনাদের লাল দ্বিতল বাসা। মাঝেমধ্যে সারা দিনের জন্য এখানে বেড়াতে আসি। জাহেদা খালার দুই মেয়ে বেবি আপা-হ্যাপী আপা ‘নারীপক্ষ’, ‘একশনএইড’ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন বলে নিঃসঙ্গ খালা আমাদের দেখলেই খুব আনন্দিত হন। প্রায় প্রতি মাসেই ‘জাহেদাবু’ খালা ঢাকায় থাকা উনার আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ান। উনাদের সাজানো–গোছানো বাসায় দুষ্টামি করার মতো বড় ভাইবোন না পেলেও বিদেশি চকলেটের অফুরন্ত স্টক আমাদের প্রায়ই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো আকর্ষণ করত।
‘বু খালা’-‘দিদি আপারা’ আজ আর কেউ নেই। ‘সুমইন্যা-ইমইন্যা’ বলে আন্তরিকতা নিয়ে ডাকার মতো স্বজনেরা আজ প্রায় সবাই হারিয়ে গেছেন।
যেদিন গেছে,
সেদিন কি আর
ফিরিয়ে আনা যায়।।
লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]