তরুণ প্রজন্ম মননশীল চর্চা থেকে কেন পিছিয়ে যাচ্ছে?

জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উপলক্ষে রাবি বন্ধুসভার বই পড়া কর্মসূচি। সবাই মধ্যে বই পড়া ছড়িয়ে পড়া উচিতছবি: বন্ধুসভা

২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালের দিককার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, তখনকার ছাত্রছাত্রীরা আলোচনায় বেশি প্রাণবন্ত ছিল, চিন্তার জায়গাটা বেশি প্রসারিত ছিল, তাদের ভেতরে বইপড়ার একটা স্বাভাবিক অভ্যাসও ছিল। আজকের প্রজন্মে সেই স্মার্টনেস, সেই কৌতূহল আর তেমন নেই। প্রযুক্তি তাদের হাতে এসেছে, কিন্তু চিন্তার আলো যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

অনুসরণীয় ব্যক্তির সংকট এখন চলছে। প্রতিটি প্রজন্ম অনুসরণীয় মানুষকে সামনে পেলে স্বপ্ন গড়ে তোলে। আজকের বাংলাদেশে এমন রোল মডেল কোথায়? রাজনীতিতে নেই দূরদর্শী নেতা, শিক্ষাঙ্গনে নেই মহৎ শিক্ষক, সমাজে নেই আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠা চিন্তাবিদ। ফলে তরুণেরা পথ হারিয়ে ফেলে, তারা মনে করে, ‘আমাদের কারও অনুসরণ করার নেই।’ এই শূন্যতা সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

তরুণেরা বই কম পড়ে এখন। বইপড়া ছাড়া চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অগণিত তথ্য, ছবি, ভিডিও, বিজ্ঞাপন—প্রতিদিনই তাদের চোখে পৌঁছে। প্রতিটি নোটিফিকেশন, প্রতিটি সেকেন্ডে বদলানো তথ্য তাদের মনকে স্থির থাকতে দেয় না। মানুষ এখন থেমে কিছু ভাবতে বা পর্যবেক্ষণ করতে চায় না। প্রকৃতি, মানুষ, শহর—কিছুই তারা পর্যবেক্ষণ করে না, শুধু চোখ বুলিয়ে যায়। ফলে চিন্তার গভীরতা কমে যাচ্ছে।

শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোও মননশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়, পদার্থবিদ্যার ছাত্র পরীক্ষার জন্য সূত্র মুখস্থ করে, সংস্কৃত বিভাগেও শিক্ষার্থী মূল পাঠ না বুঝে শ্লোক মুখস্থ করে। মুখস্থবিদ্যা দিয়ে পরীক্ষায় ভালো করা যায়, কিন্তু চিন্তার প্রসার ঘটে না। কারিকুলাম এবং মূল্যায়নের ব্যবস্থাই তাদেরকে এমন পথে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে আত্ম–উন্নয়ন এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি, মানবিক জ্ঞান বিকাশের সুযোগও কমে যাচ্ছে।

গবেষণার ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি মলিন। অনার্স পর্যায়ে থিসিস বা প্রকল্পের নিয়ম নেই, কোনো শিক্ষকের অধীনে কাজ করার বাধ্যবাধকতা নেই। তাই শিক্ষার্থীরা রিসার্চে মোটিভেট হয় না। ফান্ড বা গবেষণার সুযোগও সীমিত। শিক্ষকেরা মোটিভেট করেন না, উদ্দীপনা তৈরি হয় না। ফলে তরুণদের মধ্যে গবেষণার আগ্রহ হারাচ্ছে এবং জ্ঞানচর্চার বিকল্প পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

পাওয়ার পলিটিকস এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কারণে শিক্ষিত তরুণদের মননশীলতা আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। অনেকে শুধু নিজের স্বার্থের জন্য রাজনীতি করে; মানুষের কল্যাণের কথা ভাবে না। অথচ রাজনীতি আসলে মানুষের কল্যাণের জন্য থাকা উচিত। ছাত্রছাত্রীরা যদি শুধুই ক্ষমতা অর্জনের লড়াইয়ে যুক্ত থাকে, তাহলে তারা কোনোভাবেই আর্যদের রাজনীতি ও সাম্যের রাজনীতির চর্চা করতে পারবে না, যা সত্যিকার চিন্তাশীল রাজনীতির ভিত্তি।

চাকরিপ্রধান শিক্ষাও তরুণদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে ক্ষীণ করে দিচ্ছে। দেশের শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশ শুধু চাকরির প্রস্তুতির দিকে মন দেয়। চাকরির সিলেবাসের প্রায় ৮০ শতাংশ মুখস্থ, ফলে চাইলেও তারা সত্যিকারের বিশ্লেষণাত্মক চর্চা করতে পারছে না। জীবনের লক্ষ্য হয়ে গেছে পরীক্ষায় ভালো ফল করা, নতুন চিন্তা বা নিজেকে বিকশিত করার জায়গা সেখানে নেই।

ভ্রমণ ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কও শিক্ষার মাধ্যম হয়ে থাকেনি। আগে মানুষ ভ্রমণে যেত প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হওয়ার, মানুষের জীবনধারা বোঝার এবং নতুন সংস্কৃতি শেখার জন্য। এখন তরুণেরা শুধু ছবি তুলে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে আপলোড করার জন্য ঘোরে। প্রকৃতিকে অনুভব করার আনন্দ হারিয়ে গেছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এসেছে মানুষের সহায়তার জন্য, কিন্তু তা এখন অনেককে অলস করে তুলছে। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বই খোলার বদলে তরুণেরা এআইয়ের কাছে ভরসা করছে। এতে মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক শ্রম কমে যাচ্ছে, চিন্তার ব্যায়াম আর হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

এখন এক ভয়ংকর বাস্তবতা হলো দেশের মিডিয়ার অবস্থা। অনেক সংবাদমাধ্যম তথ্যের পরিবর্তে ফালতু বিষয় ব্যবহার করছে। সংবাদে বিশ্লেষণ কম, শোরগোল এবং চমকই বেশি। মানুষ নিজের চোখে দেখার বা তথ্য যাচাই করার পরিবর্তে যা মিডিয়া দেখাচ্ছে, তা–ই বিশ্বাস করছে। নিজের স্বতন্ত্র চিন্তা তৈরি হচ্ছে না, কেবল অন্যের তৈরি বাস্তবতায় ভরসা করছে। এই মানসিকতা তরুণদের মধ্যে সমালোচনামূলক চেতনা এবং বিশ্লেষণাত্মক মননের ক্ষয় ঘটাচ্ছে।

আমাদের সমাজও তরুণদের চিন্তার জন্য নিরাপদ স্থান দিতে পারছে না। গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ, সহমর্মিতা—এসব জায়গা দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় দমননীতি ভয়াবহ, আর জনগণের ভেতরও ফ্যাসিবাদী মানসিকতা বেড়ে গেছে। তরুণেরা এই দুইয়ের মধ্যে আটকা পড়ছে। তারা একদিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপের শিকার, অন্যদিকে নাগরিক সমাজের বিচ্ছিন্নতা ও ঘৃণার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়—তরুণেরা কি আসলে রাষ্ট্র দ্বারা শাসিত, নাকি ফেসবুকের অ্যালগরিদম এবং নাগরিক ফ্যাসিবাদের যৌথ হাতে পরিচালিত? এই প্রশ্নের উত্তর যত দেরিতে পাওয়া যাবে, আমাদের ভবিষ্যৎ তত ভয়ংকর হবে।

আরও পড়ুন

মাদক এবং অপরিণত বয়সে জটিল সম্পর্কের প্রভাবও বড়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেখা যায়, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী—বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের—মাদকাসক্তির ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। মাদক তাদের চিন্তাশীলতা ধ্বংস করছে। অপরিণত বয়সে জটিল সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে পড়া তাদের মননশীলতা আরও সীমিত করছে।

আমাদের তাই এখনই ভাবতে হবে, তরুণ প্রজন্মকে কেমন ভবিষ্যৎ দিতে চাই? আর তরুণেরা নিজেরা কি নিজেদের মধ্যে আবার আলো জ্বালাতে পারবে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পেলে সামনে যে অন্ধকার, তা থেকে মুক্তি মেলা কঠিন।

* লেখক: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন