বঙ্গবন্ধু: বাংলার জোছনা ও রোদ্দুর–২৮

কাজী নজরুল ইসলামকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সাল

১৯৭১ সাল। ৭ মার্চের বিকেল। ২টা ৪৫ মিনিট। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন। শেষ করেন তিনটা তিন মিনিটে। তখন কি কেউ ভেবেছিল ১৮ মিনিটের এ ভাষণের মধ্য দিয়ে আসবে একটি দেশের স্বাধীনতা? পৃথিবীর দুর্লভ ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকো সংরক্ষণ করবে এ ভাষণ! অনূদিত হবে কত ভাষায়! এর ঐশ্বর্য আলোচিত হবে দেশ-বিদেশে! এ ভাষণের দৃপ্ত আহ্বানে লাখো অস্ত্রহীন মানুষ সেদিন যুদ্ধে নেমেছিল।

অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। দীর্ঘ বছর বঙ্গবন্ধু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন শোষণ, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আজীবন থেকেছেন আপসহীন। রাজনৈতিক জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে আন্দোলনে। মৃত্যু পর্যন্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের একজন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিন স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সেদিন ফাগুনের আকাশ। একটু এদিক-সেদিক হলেই সহস্র মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। লাখ লাখ সম্মোহিত মানুষ তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি সূচনা করলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম?’

বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস…।’ গভীর মমতায় বঙ্গবন্ধু যেন তাঁর শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে সাত কোটি মানুষকে দাবায় রাখতে পারবা না…। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’

বঙ্গবন্ধু পুরোপুরি বুঝেছিলেন যে একটি জাতি স্বাধীন হলেই সে মুক্ত হয় না। স্বাধীনতা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক। আর মুক্তি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন, পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তার নাগরিকেরা মুক্তির স্বাদ পায়নি। ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়।’ আবার বক্তৃতার শেষে বলেছেন ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, যুদ্ধ করেই জয় ছিনিয়ে আনতে হবে। তাই তাঁর ভাষণে যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে—সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ফারুক চৌধুরী

১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ আপনার দুর্বলতা কোথায়? ‘আমি আমার জনগণকে অনেক বেশি ভালোবাসি।’ যে মানুষ এমন করে বলতে পারেন, তিনি যুগে যুগে জন্মান না। আর জন্মান না বলেই নিউজউইক সাময়িকী তাঁকে উপাধি দেয় ‘রাজনীতির কবি’। বিবিসি জরিপে তিনি হন ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’।

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণ হলো স্বাধীনতার মূল দলিল।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিত ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে যত দিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, তত দিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিকামী মানুষের মনে বেঁচে থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।

বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করতে গেলেই কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর কথা মনে পড়বে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সাহস, ধৈর্য ও আদর্শকে তুলনা করেছিলেন হিমালয়ের সঙ্গে। জীবন বাজি রেখে হিমালয়কে জয় করতে হয়। তেমনি বঙ্গবন্ধুও গহিন অরণ্য ভেদ করে, সহস্র বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, হিংস্র হায়েনাদের হাত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। সে জন্য বঙ্গবন্ধু যৌবনের শুরু থেকেই নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের নেতা, সেদিন ফিদেল কাস্ত্রো বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি হিমালয় না দেখে বঙ্গবন্ধুকে দেখলেই হিমালয়কে দেখা হয়ে যায় বলেছেন। বঙ্গবন্ধু হলেন বিশ্বনন্দিত অবিসংবাদিত নেতা। হিমালয়ের মতো বিশাল এই মানুষকে ছোটবেলায় মা–বাবা আদর করে ডাকতেন খোকা বলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা, অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শন ম্যাকব্রাইড ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। সাম্য নিশ্চিতকরণ ও সম্পদের বৈষম্য দূর করা। এর মধ্যেই নিহিত স্বাধীনতার আসল সার্থকতা। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।
চলবে...

আরও পড়ুন