বঙ্গবন্ধু: বাংলার জোছনা ও রোদ্দুর-২৭
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’–এ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালি জাতি এক অন্য উচ্চতায় চলে গেল। এটি প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্থান পায়। এর মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। এ ভাষণ নিয়ে এখন বিশ্বের দেশে দেশে গবেষণা হবে। আলোচনা হবে। এটি এখন আর বাংলাদেশের একার নয়। এটা সারা পৃথিবীর অত্যাচারিত–নিপীড়িত মানুষের গল্প। প্রেরণার চিরন্তন উৎস।
বাঙালি জাতি তার হাজার বছরের ইতিহাসে ৭ মার্চের মতো এক অবিস্মরণীয় ভাষণ পেয়েছে। কালজয়ী এ ভাষণ বিশ্বের অধিকারহারা মানুষকে অনন্তকাল প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন বাংলাদেশ৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি দিশাহীন জাতির জন্য এক দিকনির্দেশনা। এটি ছিল একটি অলিখিত ভাষণ। সারা জীবন তিনি যা বিশ্বাস করতেন, ভাষণে সে কথাই বলেছিলেন।
১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন মাত্র দুই মিনিটের ২৭২ শব্দের দুনিয়াকাঁপানো এক ভাষণ দেন। একে মনে করা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বিদগ্ধজনেরা দারুণভাবে পর্যালোচনা করেছেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। তাঁরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সেরা বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আব্রাহাম লিংকনের ভাষণকে ছাড়িয়ে গেছে। তার ওপর আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটি ছিল লিখিত। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল অলিখিত। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে তাঁকে এ ভাষণ দিতে হয়েছিল। এমন একটি ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অহংকার না হলে আর কী হবে?
যে ভাষণে পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের কথা
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি অমর কবিতা। এ ভাষণ যত মানুষ মুখস্থ বলতে পারেন, পৃথিবীর আর কোনো ভাষণের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে কি না, জানা নেই। ভাষণটি কবিতার মতো বলেই এটা সম্ভব। এ ভাষণের প্রতিটি শব্দ যেন মানুষকে সম্মোহিত করে। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের কথা বলেছেন। আশার কথা বলেছেন। বঞ্চিত মানুষের মনের কথা বলেছেন। পৃথিবীর আর কোনো নেতা ১০ লাখ মানুষের সামনে এমন ভাষণ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। মানুষের অন্তরে এ ভাষণ বেঁচে থাকবে চিরকাল। ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুসহ বাংলাদেশের জন্য এটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশেরই নেতা ছিলেন না, তিনি বিশ্বের নির্যাতিত–নিপীড়িত মানুষের নেতা।
২০১৫ সালে কানাডার একজন অধ্যাপক, লেখক ও ইতিহাসবিদ বিশ্বজুড়ে সেরা ভাষণ নিয়ে একটি বই সংকলন করেন। বইটির নাম ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্ট্রি’। এ বইয়ে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ। ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইনডিপেনডেন্স’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিও এখানে রয়েছে। এ বইয়ের প্রথম ভাষণটি হলো ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের আর শেষ ভাষণটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের। ইউনেসকোর স্বীকৃতির ফলে সারা বিশ্বের মানুষ এখন এটা জানবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এটা জানতে থাকবে যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন মহামানব, যিনি কঠিন পরিস্থিতিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিতে পেরেছিলেন।
কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো একবার বঙ্গবন্ধুর সাহস, ধৈর্য ও আদর্শকে তুলনা করেছিলেন হিমালয়ের সঙ্গে। জীবন বাজি রেখে যেমন হিমালয়কে জয় করতে হয়, তেমনি বঙ্গবন্ধুও গহিন অরণ্য ভেদ করে, সহস্র বাধা উপেক্ষা করে হিংস্র হায়েনাদের হাত থেকে বাংলাদেশকে ছিনিয়ে এনেছেন।
বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের কঠিন সত্যগুলো জানতেন। তিনি জানতেন, বিশ্বের বহু দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন কীভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে চিহ্নিত হয়েছে। ভাষণে তিনি বাংলার ইতিহাসের কথা বললেন। পাশাপাশি বললেন দীর্ঘ বছর বাঙালিকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কথা। হত্যা-নিপীড়ন-জুলুমের কথা। তারপরও তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে বারবার শান্তিপূর্ণ আলোচনার চেষ্টা করেছেন। এসব প্রসঙ্গ তুলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি এই বার্তাই দিলেন যে বাঙালিরা শান্তির পক্ষে।
ইউনেসকো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ পরিচালনা করে। এটি হলো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের একটি তালিকা। ইউনেসকোর উপদেষ্টা কমিটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে দুই বছর পর্যালোচনা করে। তারপর স্বীকৃতি দেয়।
৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইউনেসকো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করাই এর উদ্দেশ্য। ইউনেসকোর স্বীকৃতি শুধু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকেই সম্মান এনে দেয়নি, পুরো দেশ ও জাতিকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।
চলবে...