বঙ্গবন্ধু: বাংলার জোছনা ও রোদ্দুর-২৯
দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব বাংলা পরিণত হয় একটি অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে। দীর্ঘ ২৩ বছর চলতে থাকে এভাবে। অবশেষে সত্তরের নির্বাচন। নিরঙ্কুশ বিজয় বঙ্গবন্ধুর। তিনি রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। পাকিস্তান সরকার কোনোভাবেই এ বিজয় মেনে নিতে পারে না। প্রতিদিন অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এমনই একটি পরিস্থিতিতে তিনি ৭ মার্চের ভাষণের কথা ঘোষণা করেন। ৭ মার্চ তিনি স্মরণকালের এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। এটি ছিল এমন একটি ভাষণ, যা বাংলার কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়।
ছোটবেলা থেকেই কিছু মানুষের অনন্য গুণাবলী দেখা যায়। ১৯৩৯ সাল। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলের শিক্ষার্থী। সে সময় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী। দুজনে একদিন গোপালগঞ্জ এক সভায় আসেন। সভা শেষে সোহরাওয়ার্দী মিশনারি স্কুল দেখতে এলেন। দেখা শেষে গাড়িতে উঠবেন। এমন সময় বঙ্গবন্ধু সহপাঠীদের নিয়ে পথ আটকালেন। তিনি স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়া ও ছাত্রদের হোস্টেলের কথা বললেন। সোহরাওয়ার্দী তাঁর ঐচ্ছিক তহবিল থেকে ১২০০ টাকা মঞ্জুর করে দিলেন। এভাবেই একদিন বঙ্গবন্ধুর ছাত্ররাজনীতির সূচনা হয়েছিল। তাঁর অসীম সাহস দেখে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর কয়েক দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন শোষণ, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কাউকে ছাড় দেননি। মৃত্যু পর্যন্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য।
এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেও হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানব। উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদের একজন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। এ ভাষণ এখন আর বাংলার মানুষের একার নয়; এটা পৃথিবীর নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। দেশ ও পৃথিবীর মানুষের কাছে এ ভাষণ এক বিস্ময়। দেশের বিশিষ্ট জনেরা এ ভাষণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রকাশ করেছেন দারুণ সব অভিব্যক্তি।
তোফায়েল আহমেদ
বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর, বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণ ছিল অলিখিত। তিনি সারা জীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ওই ভাষণ দিয়েছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। (সূত্র: ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ-ডয়চে ভেলে)
কবি নির্মলেন্দু গুণ
নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, ‘শুধু আমি নই, পশ্চিমা বিশ্বও বঙ্গবন্ধুকে পোয়েট অব পলিটিকস বলেছে।’ কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে। আর কবি হিসেবে অভিহিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে ‘কবি’ বলেছেন। এ কবিতার প্রায় শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘কখন আসবে কবি’। একেবারে শেষে পঙ্ক্তিতে লিখেছেন, ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন...। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কবি নির্মলেন্দু গুণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘একটি অমর কবিতার সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। এর মধ্যে রয়েছে কাব্য এবং কাব্যিক ঢং। (সূত্র: সাত মার্চের ভাষণ: এক অমর কাব্য-ডি ডব্লিউ-মেড ফর মাইন্ডস-ডয়চে ভেলে)
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে একবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়রে শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নয়, বরং ইউনেসকোই এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত হয়েছে। কারণ, এখন তাদের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি আছে। এমনটা তারা বলতে পারবে।’ (সূত্র: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: কালজয়ী মহাকাব্য-ডেইলি বাংলাদেশ)
আহমদ ছফা
আহমদ ছফা লিখেছিলেন, “বস্তুত: বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়,বলাকা নয়,সোনারতরী নয়, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবানা’।’
সূত্র: শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (পৃষ্ঠা ২০)
কবি মোহাম্মদ সামাদ
একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় কবিতা পরিষদের শিরোনাম ছিল কবি মুহাম্মদ সামাদের কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ স্বীকৃতি দেওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেল। এটা শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি নয়, দেশের জন্যও এক বড় স্বীকৃতি। এখন এটাকে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, তিনি বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন। ২০১৫ সালে কানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল। তখন একাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও এবার পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’ (সূত্র: ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ-ডয়চে ভেলে)
মুনতাসীর মামুন
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ইউনেসকোর এই স্বীকৃতির ফলে সারা বিশ্বের মানুষ এখন এটা জানবেন। ভবিষ্যতের পর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এটা জানবেন যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন মহামানব, তিনি কঠিন পরিস্থিতিতে এই ভাষণে ভারসাম্য রক্ষা করেছিলেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু না বলে জনগণকে শান্ত রাখতে পেরেছিলেন। বিশ্বে আর কোনো রাজনীতিবিদ এটা পেরেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এটা এখন নিজস্ব গতিতে সবার কাছে পৌঁছে যাবে। এখন এটা ওয়েবসাইটে সব কটি অনুবাদ তুলে দিতে হবে।’ (সূত্র: ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ-ডয়চে ভেলে)। চলবে...