বঙ্গবন্ধু: বাংলার জোছনা ও রোদ্দুর-২৩

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানছবি সংগৃহীত

১৯৫৪ সালের ৮ মার্চের প্রাদেশিক নির্বাচনে জনপ্রিয় দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। বড় দল। দলের অনেক কাজ। কিন্তু সবাই কাজ করে না। কেউ কেউ ষড়যন্ত্রও করে। গ্রামাঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে—‘চাল-ডাল আমার, মেজবানি তোমার’। আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধুর অবস্থা যেন তা-ই। দলটা সবার। কিন্তু প্রায় সব কাজ তাঁকেই করতে হয়। দেশব্যাপী সভা করা। কাউন্সিল সভার আয়োজন। নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ। সবার মধ্যে সমন্বয়। সবই যেন বঙ্গবন্ধুর কাজ।

এদিকে বঙ্গবন্ধু এখনো নমিনেশন পেপার জমা দেননি। সময় মাত্র এক দিন। তাড়াতাড়ি গোপালগঞ্জ আসেন। গোপালগঞ্জ এসে ভীষণ মন খারাপ হলো। তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থী ওয়াহেদুজ্জামান ঠান্ডা মিয়া। অনেক টাকাপয়সা কামিয়েছেন। লঞ্চ, স্পিডবোট, সাইকেল, মাইক্রোফোন—সব নিয়ে নেমে পড়েছেন। সেই যুগে এত কিছু থাকা অনেক কঠিন। বঙ্গবন্ধুর তেমন কিছুই নেই। তিনি প্রায় শূন্য হাতে মাঠে নামলেন। কিন্তু নেমেই বুঝতে পারলেন, মুসলিম লীগের প্রার্থী তাঁর কাছে বিপুল ভোটে হেরে যাবেন। বঙ্গবন্ধু যেখানেই যান, সেখানেই মানুষের ঢল। অনেকে অর্থকড়ি দিয়েও সহযোগিতা করতে চান।

বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় মুসলিম লীগের প্রার্থী হতাশায় ডুবে গেলেন। তাঁর পক্ষে কোনোভাবে জেতা সম্ভব নয়। তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। বড় আলেম, পীর, মাওলানাদের তাঁর পক্ষে নামিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর ইউনিয়নে শামসুল হক নামের এক নামকরা মাওলানা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বেশ সম্মানও করেন। বঙ্গবন্ধু মনে করেছিলেন, অন্তত মাওলানা শামসুল হক তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না।

ওমা! মাওলানা শামসুল হক শুধু বললেনই না, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলেন। বললেন, বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না। ধর্ম শেষ হয়ে যাবে। তাঁর সঙ্গ যুক্ত হলেন শর্ষিনা, বরগুনা, শিবপুরের পীর ও রহমতপুরের শাহ সাহেব।

নিয়ম ভেঙে সরকারি কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলেন। তাঁর লোকদের জেল-জুলুম দিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসব খবর পেয়ে গোপালগঞ্জে এসে দুটি সভা করলেন। কিছুদিন আগে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘মুসলিম লীগ নয়টির বেশি আসন পেলে তিনি আশ্চর্য হবেন। নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী ওয়াহেদুজ্জামান ১০ হাজর ভোটে পরাজিত হলেন।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ফাইল ছবি

কিছু ঘটনা মিলে গেলে মানুষ বলে কাকতাল। আবার কোনোটাকে বলে সত্যি। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী ওই যে বলেছিলেন, ‘মুসলিম লীগ নয়টির বেশি আসন পেলে তিনি আশ্চর্য হবেন। এটা সত্যি না কাকতাল, সেটা হয়তো অন্য আলোচনা। তবে মুসলিম লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৯টি আসনই পেয়েছিল।’ পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনও পরাজিত হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচনের খরচ হিসেবে জনগণ পাঁচ হাজার টাকাও দিয়েছেন! বঙ্গবন্ধু সারা জীবন বিশ্বাস করতেন, মানুষকে ভালোবাসলে মানুষ তা ফিরিয়ে দেয়। জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো মানুষকে ভালোবাসা।

একদিনের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য এক বৃদ্ধ নারী প্রায় কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে গেলেন। বৃদ্ধ নারী তাঁর হাত ধরে বললেন, ‘বাবা, আমার বাড়িতে একটু বসতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়িতে গিয়ে বসলেন। তিনি এক বাটি দুধ খেতে দিলেন। আর তাঁর জমানো শেষ সম্বল যে কয়টা পয়সা ছিল, সব বঙ্গবন্ধুকে দিলেন। বললেন, ‘বাবা, আমার তো কিছু নেই। এটা রাখো, তোমার কাজে লাগবে।’ বঙ্গবন্ধুর বিস্মিত হলেন এ ভালোবাসায়। তিনি আরও কিছু টাকা তাঁকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি এটা রাখো। তোমার দোয়ার মূল্য টাকায় শোধ হবে না।’ বঙ্গবন্ধু সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—মানুষকে তিনি কোনো দিন ধোঁকা দিতে পারবেন না।

চিরতরে প্রত্যাখ্যান

সাতচল্লিশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর প্রায় ২০০ বছরের গ্লানি থেকে মুক্তি পায় এ অঞ্চলের মানুষ। দেশভাগ ও স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় এই প্রথম একটি শহুরে মধ্যবিত্ত মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে। তৈরি হতে থাকে রাজনীতি–সচেতনতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা। এই জনপদের মানুষ অনুভব করে, ভোট তাদের অমূল্য সম্পদ। এই ভোট নির্ণয় করে দেবে শুভ ও অশুভের পার্থক্য।

মুসলিম লীগ দলটির প্রীতি এ অঞ্চলের মানুষের শ্রদ্ধা–ভালোবাসাসহ একধরনের মুগ্ধতা ছিল। কারণ, একটি আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য সাবই নিরন্তর সংগ্রাম করেছে। অথচ দেশভাগের পর ধীরে ধীরে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়।

কারণ, দলটির কোনো রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না। তারা একটি বিশেষ বুর্জোয়াশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত। আর পূর্ব বাংলার মানুষদের সব সময় ধোঁকা দিত। বাঙালিরা ছিল ধর্মপ্রাণ। এর সুযোগ নিয়ে মুসলিম লীগ ধর্মের নামে স্লোগান দিত। তারা বলত যে তারা পাকিস্তান কায়েম করেছে। তারা পাকিস্তানের মাতা। তাদের ভোট না দিলে পাকিস্তান ধ্বংস হবে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রদ্রোহী। হিন্দুদের দল। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা এক করতে চায়। এসব মিথ্যা প্রচার চালাত।

অথচ এই অঞ্চলে আওয়ামী লীগ একটি অনন্য অসাম্প্রদায়িক দল। এর অনেক সদস্য আবার সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাই আওয়ামী লীগের কাছে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, বাঙালি, অবাঙালি—সবাই সমান।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫) যখন তরুণ
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চ পূর্ব বাংলায় অনুষ্ঠিত হবে বহু আকাঙ্ক্ষিত যুক্তফ্রন্ট (প্রাদেশিক) নির্বাচন। নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন বাকি। এরই মধ্য মুসলিম লীগ আবার নতুন চক্রান্ত শুরু করল। তারা চন্দ্রঘোনা কাগজের কলে গুজব ছড়াল যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে অবাঙালিদের পূর্ব বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেবে। এ জন্য চন্দ্রঘোনা কাগজের কলে কর্মরত বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে এক ভয়ংকর গন্ডগোল হয়। এ জনপদের মানুষ তাদের সব ষড়যন্ত্র ধরে ফেলে। প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেওয়ার জন্য এক হয়।

তাই এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল ২১৫টি আসন। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ একাই পায় ১৪০টি। যুক্তফ্রন্টের শরিক দল সবাই মিলে পায় ৭৫টি। ৮টি আসন পেয়েছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। শেষ পর্যন্ত তারাও যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হলো। তাই যুক্তফ্রন্টের মোট আসন হলো ২২৩টি। আর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন পেয়েছিল। অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল ৭২টি।

১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুতে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সে নির্বাচনে বাঙালিরা প্রমাণ করে দিয়েছিল যে তারা ভুল করে না। ওই নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ১২১টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল। আরেকবার প্রমাণ দিল যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে।

মুসলিম লীগ সরকারের এমন শোচনীয় পরাজয়ে পাকিস্তানের শাসক, আমলা, ব্যবসায়ী—সবাই ভয় পেয়ে গেল। তবু আশা ছাড়ল না। এদিকে আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার জনগণ কীভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, প্রতিবছর কী পরিমাণ সম্পদ পাচার হচ্ছে, শিক্ষা, চাকরি, বাণিজ্য—এসব ক্ষেত্রে বৈষম্যের খতিয়ান সাধারণ জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। মানুষ এমনিতেই তাদের দুঃশাসন সম্পর্কে জানে। তার ওপর এসব তথ্য জনগণকে আরও ক্ষুব্ধ করে।

এ ভূখণ্ডের মানুষ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও নৈতিকতা সম্পর্কে জানে। তাই তারা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়ী করে আর চিরতরের প্রত্যাখ্যান করে মুসলিম লীগকে।

তাদেরই ক্ষমতার বাইরে রেখে সরকার গঠন

১৯৫৪ সালের ১২ মার্চ শেষ হলো প্রাদেশিক নির্বাচন। বীরের মতো জয়ী হলেন বঙ্গবন্ধু। মানুষ অপেক্ষা করছে তাঁর সংবর্ধনার জন্য। কখন ঢাকায় আসবেন। ঢাকায় এলেন। শোভাযাত্রাসহ সবাই আওয়ামী লীগের অফিসে নিয়ে গেল। জনতা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল। তারপর আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের এক সভা ডাকা হলো। সভায় রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা খয়রাত হোসেন একটি প্রস্তাব করলেন। তিনি বললেন পুরোনো মুসলিম লীগই ফজলুল হকের নীতিনির্ধারক। এরা ষড়যন্ত্রকারী। তাই ফজলুল হককে নেতা নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করতে হবে। সুযোগ পেলেই ষড়যন্ত্রকারীরা সব ভন্ডুল করে দেবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে বললেন, তিনি মন্ত্রী হতে চান কি না। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমার অনেক কাজ। যারা যোগ্য, তাদের করে দেন।’

ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে যুক্তফ্রন্ট আইনসভার সদস্যদের সভা হলো। এ সভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সবার অনুমতিতে ফজলুল হককে যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচন করা হলো। মুসলিম লীগ সরকার ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বললেন।

আরও পড়ুন

ইতিমধ্যে ফজলুল হকের লোকজন ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। কারণ, এরা তো আর কেউ না, পুরোনো মুসলিম লীগেরই আত্মা। ফজলুল হক নিজেও সর্বশেষ মুসলিম লীগ থেকে অবসর নিয়েছেন। একেবারে শুরুর দিন থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হলো। আওয়ামী লীগ চায় পূর্ণ মন্ত্রিসভা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে। কিন্তু ফজলুল হক চান ছোট মন্ত্রিসভা। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ।

শেষ পর্যন্ত ফজলুল হক আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক, কৃষক শ্রমিক পার্টির নান্না মিয়া ও নিজামে ইসলামের আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে শপথ গ্রহণ করেন। নান্না মিয়াকে মন্ত্রী করায় জনগণ খেপে গেল। কারণ, তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি ফজলুল হকের ভাগনে।

এ জনপদের মানুষের দুঃখের দিন যেন শেষ হয় না। তারা মুসলিম লীগের অন্যায়–অবিচার থেকে মুক্তির জন্য যুক্তফ্রন্টকে নির্বাচিত করল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের এটা কোন ধরনের সরকার? আওয়ামী লীগের জন্যই আজ একদল ধান্দাবাজ লোক ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছেন। হক সাহেব নিজেও বিশাল একটা সম্মানের জায়গা পেয়েছেন। অথচ সেই আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতার বাইরে রেখে সরকার গঠন করা হলো। এটা একটা গভীর চক্রান্ত। পূর্ব বাংলার মানুষ বিষয়টিকে মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।

তাই শপথ গ্রহণের পরই জনতা স্লোগান দিল—স্বজনপ্রীতি চলবে না, কোটারিভুক্ত চলবে না।

মনে হলো মানুষের এত দিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস এক দিনে হারিয়ে গেল। নতুন এই আন্দোলন ও অসন্তোষের জন্য হক সাহেবের লোকজন আবার বঙ্গবন্ধুকেই দোষ দিলেন। বাস্তবতা হলো বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে কিছুই করেননি। পুরা বিষয়টির মধ্যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। আওয়ামী লীগকে না নেওয়ায় এটা একটা জগন্নাথ মন্ত্রিসভা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেটা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিল।

মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সরকার ওত পেতে ছিল। কোনো দুর্বলতা পেলেই হক সাহেবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারা খুব ভালো করে জানত যে আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া ফজলুল হকের সরকার চলতে পারবে না। আর সব দল মিলেও আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা আওয়ামী লীগের সমান না। চলবে...