বঙ্গবন্ধু: বাংলার জোছনা ও রোদ্দুর-১৯
১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচির সংবিধান সভা থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বাদ দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এর প্রতিবাদে তমদ্দুন মজলিশের নেতা অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব, বঙ্গবন্ধু, ছাত্রলীগসহ সবাই এক আলোচনায় বসেন। তাঁরা ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করেন। ভাষা দিবসকে সফল করার জন্য বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলায় যান। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে ১১ মার্চ ভাষা দিবসকে সফল করার জন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এদিন হরতালের ডাক দেওয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় হরতালের পক্ষে পোস্টার লাগানো হয়। ভোর থেকে শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্ররা ভীষণভাবে মার খায়। একদল মার খেয়ে চলে যায়, আরেক দল আসে। এভাবে অনেকক্ষণ চলল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত মিয়া, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদসহ অনেকে গুরুতর আহত হন।
বঙ্গবন্ধু কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে যান। সেখানে দেখেন, শামসুল হককে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে তাড়া করছেন। একপর্যায়ে তিনিও গ্রেপ্তার হন। পুলিশের গাড়িতে ওঠার পর দেখেন শামসুল হক, অলি আহাদকে আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেক ছাত্রকে ৩০ থেকে ৪০ মাইল দূরে জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্রকে জেলে পাঠান হলো।
ভাষা আন্দোলনের পুস্তিকা প্রকাশ, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন, ভাষা আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন জেলায় সফর, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতালের কর্মসূচি প্রণয়ন, হরতাল বাস্তবায়নে ১০ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে পরিকল্পনা গ্রহণ, ১১ মার্চ পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব, পুলিশি হামলার শিকার ও ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ দিবস ১১ মার্চের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু।
১৫ মার্চ মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু খাজা নাজিমউদ্দিনের স্বাক্ষর করা আট দফা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর আবার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে সভাপতিত্ব, মিছিল নিয়ে পরিষদ ভবন ঘেরাও, ১৭ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের সভায় বক্তৃতা, জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ—এসব ঘটনাই বলে দেয় রাষ্ট্রভাষার প্রতি তাঁর কী অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা ছিল। পূর্ব বাংলায় এটাই ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল। আর এ হরতালের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু।
ঐতিহাসিক আমতলায় রাষ্ট্রভাষার দাবি ও বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্ব
১৬ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলায় সাধারণ ছাত্রদের সভা ছিল। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। সবাই সমর্থন করল। ঢাকা মেডিকেলের বিখ্যাত আমতলায় বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে কোনো সভার সভাপতিত্ব করেন। সবার শেষে বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমাদের ওপর নির্মম জুলুম করেছে। আর খাজা নাজিমউদ্দিন এর তদন্ত করবেন। আবার তিনি নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই তদন্ত মানি না।’ এ ছাড়া ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে নাজিমউদ্দিনের যে আপস-মীমাংসা হয়েছে, সেগুলো সভায় অনুমোদন করা হলো। বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্ররা তদন্তের প্রস্তাব না মানার বিষয়টি আইনসভায় খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পৌঁছে দিতে গেলেন। তখন আইনসভার এরিয়াতে আবার পুলিশের সঙ্গে বেধে গেল গন্ডগোল। লাঠিপেটা করল পুলিশ। কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ল। বঙ্গবন্ধুর চোখে লাগল কাঁদানে গ্যাস। চোখ জ্বলছে। পানি পড়ছে চোখ থেকে। কয়েজন পলাশী ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে পানি দিলেন।
সন্ধ্যার পর ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভা। বঙ্গবন্ধু সে সভায় আবার বক্তৃতা করলেন। কয়েক দিন আন্দোলন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হলো। কারণ, দেশভাগের পর এই প্রথম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসবেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না; ফরিদপুর, যশোরে কয়েক শ ছাত্র বন্দী হলো। রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুরসহ অনেক জায়গায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। এ আন্দোলনকে বানচাল করতে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অনেক চেষ্টা করেছিল। পারেনি। আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্ররা। পরে জনসাধারণও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বদ্ধপরিকর ছিল। ভাষার আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্ররা। কিন্তু এটা শুধু ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; অনেক সাধারণ মানুষও রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পথে নেমেছিল। সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নেয়। তারা বলেছিল, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা এসেছে। এসব ছাত্র পায়জামা পরে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, যে ৭৫ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনও হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে বেশির ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। যেকোনো বিবেচনায় বাংলাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রভাষা। তারপরও বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের নাগরিকেরা তাদের নিজস্ব ভাষা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু ও বেলুচি ভাষায় কথা বলে। মুসলিম লীগ সরকারের আরেকটা যুক্তি হলো উর্দু ইসলামিক ভাষা। এটা ছিল একটা চরম প্রতারণা। উর্দু কোনো ইসলামিক ভাষা নয়। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের কোনো অঞ্চলের ভাষা উর্দু নয়। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। [চলবে...]