ভাষা আন্দোলনের বিশাল এক পটভূমি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত এর পরিসর। এই প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই যিনি এর সঙ্গে ছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশ—প্রতিটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রয়েছে নাড়ির টান। এসবের যেকোনো আলোচনায় প্রথমেই চলে আসে তাঁর নাম। দেশভাগের আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে পূর্ব বাংলার জন্য ভালো কিছু হচ্ছে না। তাই বাংলার মানুষ তাদের অধিকার রক্ষায় সচেতন হয়। তখন বঙ্গবন্ধু, কাজী ইদ্রিস, শহীদুল্লা কায়সার, রাজশাহীর আতাউর রহমানসহ অনেকেই কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলা হোস্টেলে এক বৈঠকের আয়োজন করেন। পূর্ববঙ্গের যুবসমাজের করণীয় ঠিক করা ছিল এ বৈঠকের উদ্দেশ্য।
তখনো পাকিস্তানের জন্ম হতে আরও কিছুদিন বাকি। এমন সময় আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ এক নিবন্ধ লিখলেন। সে নিবন্ধে তিনি উর্দুকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করেন। তত দিনে বাঙালির আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়েছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি দৈনিক আজাদে লিখলেন, প্রস্তাবিত পাকিস্তানের যদি একটি রাষ্ট্রভাষা হয়, তবে গণতন্ত্রসম্মতভাবে শতকরা ৫৬ জনের ভাষা বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। রাষ্ট্রভাষা যদি একাধিক হয়, কেবল তখনই উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
তখন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এমন এক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে বৈঠক হয়েছিল। এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছিল যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার অসাম্প্রদায়িক যুবসম্প্রদায়ের সম্মেলন ডাকতে হবে। তারপর ১৪ আগস্ট স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হয়। নেতৃবৃন্দ ঢাকায় আসেন। তাঁরা ঢাকার ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সাতচল্লিশের ৬ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনের তারিখ ঠিক হয়।
কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার এ সম্মেলনে বাধার সৃষ্টি করে। কোথাও জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খানসাহেব আবুল হাসনাত। তাঁর বাড়িতে সম্মেলন হয়। দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় এটিই ছিল প্রগতিশীল নেতাদের প্রথম সম্মেলন। এ সম্মেলনে তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু ভাষার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সে হিসেবে বলা যায়, পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধুই প্রথম ভাষার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন–আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে, এ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ এভাবেই সেদিন পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে প্রথম ভাষার দাবি উচ্চারিত হয়েছিল।
তারপর এ সম্মেলন থেকে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হলো সেই দাবি। আর ৭ সেপ্টেম্বরের ওই সম্মেলনে জন্ম নিল পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগ। এ সম্মেলনের প্রস্তাব পাঠ করেন সেদিনের ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখা, ভাষা-আন্দোলনের নানান দলিলপত্র, ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিচারণাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে নিশ্চিতভাবে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সরাসরি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য ভূমিকা ছিল। তিনি এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে ১১ মার্চের হরতালে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এর প্রমাণ রয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। সে প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ছিল, He took very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan and made propoganda at Dacca for general strike on 11.3.48 on this issue. On 11.3.48 the subject was arrested fo violating orders under section 144 Cr. P. C. (Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Volume-1 (1948-19750), p. 319
বিশেষ করে ১৯৪৭ ও ’৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সব কর্মকাণ্ডে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন ও নেতৃত্ব দেন।
সাতচল্লিশে রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার ও বঙ্গবন্ধু
সাতচল্লিশে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। বিভিন্ন মিটিং–মিছিলে অংশ নেন। এ বছরের ৫ ডিসেম্বর খাজা নাজিম উদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হয়। সে সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল হয়। সে মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৪ জন ভাষাবীর ও রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য দাবি নিয়ে ২১ দফা ইশতেহার তৈরি করেন। এ ইশতেহারের দ্বিতীয় দফা ছিল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে।। ইশতেহারটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। নাম ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার—ঐতিহাসিক দলিল’। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই পুস্তিকা একটি দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার তৈরিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল। তিনি ছিলেন এর অন্যতম স্বাক্ষরদাতাও।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুস্তিকাটি যাঁদের নামে প্রচারিত হয়েছিল, তাঁরা সবাই অতীতে ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। উল্লেখ্য, এঁদেরই একজন ছিলেন ফরিদপুরের (বর্তমানে গোপালগঞ্জ) শেখ মুজিবুর রহমান; পরবর্তীকালে যিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’
১৫০ মোগলটুলী ছিল সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র, যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলনকেন্দ্র। এখান থেকে তাঁরা বাংলা ভাষাসহ পাকিস্তানের অন্য বৈষম্যমূলক দিকগুলো জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের কর্মীবাহিনী নিয়মিত এখানে মিলিত হন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিভিন্ন পরিকল্পনা এখান থেকেই নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদসহ সবাই ছিলেন এ কেন্দ্রের প্রাণশক্তি। ১৫০ মোগলটুলী ছিল বিরোধী রাজনীতির অন্যতম আলোচনাকেন্দ্র। কলকাতা থেকে বঙ্গবন্ধু, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিনের মতো নেতারা প্রথমে ১৫০ মোগলটুলীতে আসতেন ও আলোচনা করতেন। এভাবেই চলে গেল সাতচল্লিশ সালের সময়টা।
ভাষা আন্দোলনের প্রচার ও বঙ্গবন্ধু
১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক হলো। এ বৈঠকে রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি আলোচনায় এল। মুসলিম লীগের নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললেন। সে সভায় পূর্ব বাংলারও অনেক মুসলিম লীগ সদস্য ছিলেন। অবাক করার বিষয় হলো, তাঁরাও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দিলেন। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আইন সভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ওই সভায় ছিলেন। সেদিনের সভায় একমাত্র ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই বলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কারণ, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। এ জন্য লিয়াকত আলী খান তাঁকে প্রকাশ্যে ধিক্কার দেন। তিনি ও রাজা গজনফর আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি খাজা নাজিম উদ্দিন ও তমিজ উদ্দিন খান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেন। নাজিম উদ্দিন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চায়। শুরু হলো বাংলাকে বাদ দেওয়ার কঠিন ষড়যন্ত্র।
তখন তমুদ্দুন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। অধ্যাপক আবুল কাশেম ছিলেন এ সংগঠনের নেতা। এদিকে বঙ্গবন্ধু সে সময় মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা। তমুদ্দুন মজলিশ ও মুসলিম ছাত্রলীগ এক হয়। তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার তীব্র প্রতিবাদ করে এবং একটি সর্বদলীয় সভা করে। এ সভা থেকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। কামরুদ্দিন, শামছুল হকসহ অনেকে এ সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়। এ পরিষদ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ করার উদ্যোগ নেয়। তাই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষার দাবি’ দিবস ঘোষণা কর হয়। এদিকে জেলা ও মহকুমায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের শাখা করা হয়েছে। ভাষার দাবি নিয়ে সবাই বিভিন্ন জেলায় গেলেন।
বঙ্গবন্ধু গেলেন ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে। তিনি এসব জেলায় সভা করেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। যেকোনো মূল্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। এ লক্ষ্যে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার কথা বলেন। তিনি খুলনার দৌলতপুরে একটি কলেজে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তৃতা দিতে যান। সেখানে মুসলিম লীগের সমর্থক ছাত্ররা সভা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন। খুব গোলমাল হয়। অনেকে রক্তাক্ত হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সভা বানচাল করতে পারেননি।
আবদুস সবুর খান, বরিশালের মহিউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কলেজ প্রাঙ্গণে সভা করেন। তারপর ঢাকায় ফিরে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। ছাত্ররা তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিলেন। জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড, মেডিকেল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আন্দোলনে যোগ দিল। এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ গুন্ডা নামিয়ে দিল। তারা অপপ্রচার চালাল যে এটা পাকিস্তান ধ্বংসের আন্দোলন। পুরান ঢাকায় ছাত্রদের সঙ্গে মারপিট হলো।
চলবে...