প্রহসনের বিচার ও বিশ্বের গণমাধ্যম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট বিশ্ব শান্তি কাউন্সিলের সচিবালয় পাকিস্তান সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির অনুরোধ করে। পাকিস্তান সরকার মানবিকতার সব পথ বন্ধ ও বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত নেতাকে ইয়াহিয়া সরকার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এর মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান নিজেকেই বিশ্বের কাছে একজন সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরশাসক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। শেখ মুজিবকে যদি গোপন বিচারের নামে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে এক ভয়াবহ দুর্যোগের সৃষ্টি হবে। বিশ্ব শান্তি কাউন্সিল অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে ইয়াহিয়া খানের সরকারের কাছে আহ্বান জানায়।

৭ সেপ্টেম্বর রাতে কাঠমান্ডুতে নেপালের ইস্ট বেঙ্গল রিফিউজিস অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি একটি সভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঋষিকেশ সাহা। ওই সভা থেকে বঙ্গবন্ধুকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। অক্টোবরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি বাংলাদেশের সমগ্র বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে যে চিঠি লেখেন, তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার ও বিচারের প্রসঙ্গে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

২৭ অক্টোবর অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ড. বরুনো ক্রেইস্কি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে আটকের তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ইউরোপের কোনো গণতান্ত্রিক দল এসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবে সহ্য করবে না।

জেনেভার আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পিত বিচারের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। কমিশনের মহাসচিব ম্যাকডরমট স্বাক্ষরিত এক তারবার্তায় জানানো হয়, ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে গোপন কিছু থাকতে পারে না।

১৮ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের নিন্দা জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নির্বাচিত অন্য প্রতিনিধিদের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তির জন্য কনফারেন্স থেকে অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া আরব লিগ প্রতিনিধিসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এ বিচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের এক সরকারি মুখপাত্র জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকাজ শেষ হয়েছে। তবে রায় লেখা হয়নি। হয়তো এই মাসের শেষ নাগাদ রায় জানা যাবে। ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা। সেনানায়ক ইয়াহিয়া খানের কি শক্তি আছে তাঁকে বেঁধে রাখার? পাকিস্তানের কারাগারে সামরিক আদালতে এ ধরনের বিচার–প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ ও ষড়যন্ত্রমূলক। দেশ-বিদেশের প্রায় সব মহলই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। বিশ্বসভার এ বোধ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি শাসকদের রোষানল থেকে মুক্তির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু মুক্ত থাকুন আর জেলে থাকুন, তিনি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, জনগণের আশা-ভরসার প্রতীক, এটা ছিল বাস্তব সত্য এবং সবার কাছে সেটা মূর্ত হয়ে ওঠে। সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখতে ও মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। যুদ্ধ যদি কোনোভাবে ভিন্ন পরিণতি নিত, ইয়াহিয়া যদি কোনোভাবে টিকে যেতেন, তাহলে অবশ৵ই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে পেতাম না।

প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৬ মার্চ ১৯৭১
ছবি: দৈনিক ইত্তেফাক

প্রহসনের বিচার ও বিশ্বের গণমাধ্যম

১০ আগস্ট লন্ডনের একটি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের গোপন বিচারের অকল্পনীয় সিদ্ধান্ত ভারত উপমহাদেশে অধিকতর তিক্ততা, যুদ্ধ ও ধ্বংস ডেকে আনবে।’ এ পত্রিকায় ১১ আগস্ট থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু ও ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের কথাও বলা হয়।

লা নেসিওন
১৫ আগস্ট বুয়েনস এইরেস থেকে প্রকাশিত ‘লা নেসিওন’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। এ বার্তায় তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার নামে গোপন বিচারের কথা বলেন। উথান্ট বলেন, এটা গত নভেম্বরে বয়ে যাওয়া হারিকেন ও পরে কলেরা পূর্ব বাংলা যতটা না ধ্বংস করেছে, তার চেয়ে বেশি ভয়াবহ হবে।

দ্য টাইমস
১২ আগস্ট যুক্তরাজ্যের ‘দ্য টাইমসে’ ‘শেখ মুজিবের ভাগ্য’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের গোপনে বিচারের সিদ্ধান্ত খুবই দুঃখজনক। শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সমস্যা সমাধানের জন্য কথা বলতে পারেন, যেন পাকিস্তানে আরও বড় ধরনের ট্র্যাজেডি না ঘটে। পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব সম্পর্কে এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ছবি: পাভেল রহমান

ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর
বোস্টন থেকে প্রকাশিত হয় ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’। ১৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে আমেরিকার সিনেটর চার্লস এইচ পারসির একটি বক্তব্য ছাপা হয় এতে। পারসি পাকিস্তানি নেতাদের বলেন, তাঁদের দেশ বিশ্ববাসীর নিন্দার শিকার হবে যদি শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

লা ফিগারো
১ সেপ্টেম্বর ফরাসি পত্রিকা ‘লা ফিগারো’কে ইয়াহিয়া বলেন, মুজিব হচ্ছে পাকিস্তানের জনগণের শত্রু। মার্কিন ‘নিউজ উইক’ সাময়িকীতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, জাতি দাবি করলে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে তিনি প্রস্তুত।

ক্যানবেরা টাইমস
১৭ সেপ্টেম্বর ‘ক্যানবেরা টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধ। যে আদালত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করছেন, তাঁরা যদি তাঁকে শাস্তি দেন, তাহলে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রমনা গণভবন, ১৯৭২ সাল।
আলোকচিত্রী: পাভেল রহমান

নিউজ উইক ম্যাগাজিন
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৮ নভেম্বর ‘নিউজ উইক ম্যাগাজিন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি ইচ্ছা করলেই শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পারেন না। তবে জাতি যদি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করে, তিনি তা-ই করবেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওই সাক্ষাতের পর পাকিস্তানের ৪২ জন রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক সংগঠক, আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ছাত্রনেতা, সমাজকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বঙ্গবন্ধুকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য একটি আবেদনপত্র প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠান।

আফ্রিকান ট্রিবিউন
কিনশাশা থেকে প্রকাশিত ‘আফ্রিকান ট্রিবিউন’ পত্রিকার ১৩ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় বলা হয়, এখন যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়, তবেই সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে সহায়ক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এল ইউনিটা
১৮ নভেম্বর ইতালির রোম থেকে প্রকাশিত ‘এল ইউনিটা’র সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে বিশ্বের সব মানুষ ও দেশ, যারা শান্তি ভালোবাসে ও চায়, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আনার জন্য তাদের আবেদন জানানো হয়।

ল্য মোদ
করাচির ‘দ্য ডন’ পত্রিকায় ২০ অক্টোবর প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা যায়, প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘ল্য মোদ’ পত্রিকাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি সাক্ষাৎকার দেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর আলোচনার যে গুজব শোনা যায়, তার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ইয়াহিয়া খান বলেন, বিচারে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তিনি জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ না করার আশ্বাস দিলেই সংলাপ হতে পারে। চলবে...

আরও পড়ুন