নাগরিক সংবাদে প্রকাশের পরই আর্থিক সহায়তা পেলেন সেই নরসুন্দর

বুধবার সকালে বুলবুল হোসেনের পরিবারকে সহায়তার অর্থ তুলে দেওয়া হয়
ছবি: লেখক

মানুষ মানুষের জন্যে,
জীবন জীবনের জন্যে...
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?
নিশ্চয়ই পারে...
আর তাই তো মানুষের কল্যাণে বারবার এগিয়ে আসে মানবতায় সমাজের সাহসী মানবিক মানুষেরা। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর অনলাইনে নাগরিক সংবাদের পাতায় ‘পুঁজিবাদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা এক অনাথ নরসুন্দর’ শিরোনামে একটি ফিচার প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। ফিচারটি প্রকাশ পাওয়ার পরপরই অসহায় হতদরিদ্র এবং চরম মানবেতর জীবন যাপন করা নরসুন্দর বুলবুল হোসেন ও রাজিয়া আক্তার দম্পতি পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

আজ বুধবার সকালে আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ওই ব্যক্তির আর্থিক সহায়তার ৫ হাজার টাকা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাক্তা ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে গিয়ে পরিবারটির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। টাকা হাতে পেয়ে নরসুন্দরের অনাহারি পরিবারের সদস্যের মুখে হাসি ফুটে উঠে মুহূর্তেই।

এ সময় বুলবুল হোসেন সহায়তার টাকা হাতে পেয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। বুলবুল জানাযন, ‘সারা জীবন মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যর শিকার হইয়া বড় হয়েছি। জাতে আমি নাপিত ছিলাম না, কিন্তু এই পেশায় আমার আসতে হয়েছে পেটের দায়ে; তাতে আমার দুঃখ নাই, কাজ করে খাই, চুরি তো করি না। স্বপ্নেও কোনো দিন ভাবি নাই কেউ আমার জীবনের কথাগুলো এভাবে পত্রিকায় তুইলা ধরব। কেউ আমারে সহযোগিতা করব, আমি প্রথম আলো পত্রিকারে ধন্যবাদ জানাই। আর আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে দোয়া করি যে মানুষটা আমার পরিবারের ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাদের লাইগা পাঁচ হাজার টাকা দিছে, আল্লাহ তার মঙ্গল করুক। তার মনের নিয়ত পূরণ করুক আল্লাহ। আমি এ টাকা দিয়ে আমার পরিবার নিয়ে ভালোভাবে ঈদ করতে পারমু এবার।’

বুধবার সকালে বুলবুল হোসেনের পরিবারকে সহায়তার অর্থ তুলে দেওয়া হয়
ছবি: লেখক

বুলবুলের স্ত্রী রাজিয়া আক্তার জানান, ‘এই টাকা পাইয়া আমার পরিবারের কী পরিমাণ উপকার হইল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারমু না। ঈদে ছোট ছোট পোলাপানগরে নতুন কাপড় দিমু, কিছু টাকা বাঁচাইয়া একটা ছাগল কিনমু।’

‘প্রথম আলোর অনলাইনে নরসুন্দর বুলবুলের জীবন গল্পটা পড়ে আমার খুব খারাপ লেগেছে, অসহায়–এতিম নরসুন্দর ছেলেটির জন্য আমার সাধ্যমতো কিছু করতে চেয়েছি। বাচ্চার দুধ কিনে দিতে না পারার যন্ত্রণা একমাত্র যিনি পিতা, তিনিই বোঝেন আর কেউ না। তাই আমি যৎসামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করেছি, যাতে সে পরিবার নিয়ে এবারের ঈদটা অন্তত আনন্দে কাটাতে পারে। আর বাকিটা আল্লাহ ভরসা, উপরওয়ালাই ভালো জানেন।’ বুলবুলের বিষয়ে এমন সহজ–সরল স্বীকারোক্তিই প্রকাশ করেন পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তা করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই জনৈক ব্যক্তি।

উল্লেখ্য, নরসুন্দর বুলবুল হোসেন এনজিও থেকে লোন করে স্থানীয় শ্রীপুর ব্রীজপার এলাকায় একটি চুল কাটার সেলুন দেন, শাশুড়ির দেওয়া এক টুকরা জমিতে একটি ছাপরা ঘর তুলে কোনোমতে বসবাস শুরু করে বুলবুল দম্পতি। এখন বুলবুল-রাজিয়া ৩ সন্তানের জনক–জননী। বড় মেয়ে নামীমা আক্তার, মেজো মেয়ে রাবীবা আক্তার এবং ১ বছরের ছোট ছেলে রাব্বি হাসান। গত এক বছরের করোনার মহামারিকালে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে নরসুন্দর বুলবুলের পরিবার। কেননা, জীবন–জীবিকার একমাত্র অবলম্বন এ সেলুনের ওপর ভরসা করেই চড়া সুদে লোন নিয়েছেন। সেলুনে আর আগের মতো মানুষ চুল কাটাতে বা সেভ করাতে আসেন না।

সারা দিনে খুব হলেও ১০০ কি ১৫০ টাকা আয় করে চাল–ডাল কিনে বাড়ি ফিরতে হয় তাঁর। প্রতি মাসে এনজিওর কিস্তি, সংসারের খরচ মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁর পরিবারকে। এদিকে সম্প্রতি বুলবুলের থাকার জন্য ছাপরা ঘরটা ঝড়ের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। একরকম খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। একটু দমকা হাওয়া আর ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস পেলেই সন্তানদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে উঠতে হয়ে রাজিয়াকে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছে, বুলবুল হোসেনের মতো এমন অসহায় হতদরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি তাঁর জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল কিংবা ঘর তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

*লেখক: ইমতিয়াজ আহমেদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

আরও পড়ুন