পুঁজিবাদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা এক ‘অনাথ নরসুন্দর’
শ্রীপুর গ্রামের সবজিচাষি লিটন খান। পাহাড়ি লাল মাটি হওয়ায় এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ সবজি চাষাবাদ করে সংসার চালায়। যার জমি আছে সে গেরস্ত আর যার জমি নেই সে কামলা। প্রায় ২ একর জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে লিটন খানের লাউয়ের মাচা। এবার লাউয়ের আবাদ বাম্পার হওয়ায় কৃষক দাম পাননি বলে মাচাতেই ঝুলে ঝুলে পচে যাচ্ছে লাউ, মাটি থেকে খাবার নিয়ে তেড়ে উঠছে সবুজ লাউ ডগাগুলো, তবুও একটা লাউ না বলে ছিঁড়ে নিয়ে খাবার সাহস নেই কারোরই লিটন খানের মাচা থেকে। লাউ মাচার পরেই জঙ্গল আর বাঁশবন, বাঁশঝাড়ের পথ ধরে একটু এগোলেই একটা ভাঙাচোরা বাড়ির মতো কিছু একটা, বাড়ির নাম নাপিত বাড়ি। গ্রামের সবাই যাকে বুলবুল নাপিত বলেই চেনে। পাখিদের শব্দে মুখর সারা বাড়ি, বাড়ির ওপর দাঁড়াতেই হঠাৎ এক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে, শিশুটির কান্নায় পাখিরাও যেন বিস্মিত তাকিয়ে বাড়িটির দিকে, খাবারের দুধের জন্য কাঁদছে ১ বছরের শিশু রাব্বি, বুলবলের ছেলে রাব্বি। কোলে ছোট্ট শিশুকে নিয়ে ছাপরা থেকে বেরিয়ে এল বুলবুল।
২৫ বছরের যুবক বুলবুল হোসেন নরসুন্দর বা নাপিত।
বুলবুলের বয়স যখন ৪ বছর তখন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যায় তার মা মালেকা বেগম। ৫ ভাইয়ের সংসারে বুলবুল সবার ছোট। মালেকা বেগমের মৃত্যুর পর বাবা মনসুর আলী আবার বিয়ে করেন।
সৎমায়ের সংসারে অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে বুলবুলের অন্যান্য ভাইয়েরা যার যার মতো চলে যায় অন্যত্র।শুধু একা পড়ে থাকে বুলবুল, পরে বেশি দিন সৎমায়ের সংসারে আর জায়গা হলো না বুলবুলের। দিন দিন বুলবুলের ওপর অমানবিক নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলল। ছোট্ট বুলবুল অভিমান নিয়ে তাই একদিন পালিয়ে যায়। প্রথমে চায়ের দোকানে কিছুদিন কাজ করার পর ঢাকার একটা সেলুনে কাজ শিখতে থাকে। তার বয়স যখন ১২ বছর, হঠাৎ বাবার মৃত্যুর সংবাদ আসে তার কানে। মার মৃত্যুর পর একবারের জন্য শিশুসন্তান বুলবুরের কোনো খোঁজ নেয়নি পিতা মনসুর আলী। তবুও বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শেষবারের মতো তার জন্মদাতা বাবাকে শেষ দেখা দেখার জন্য একবার বাড়ি যায় সে। বুলবুল বুঝে যায় এই বিশাল পৃথিবীর বুকে সে আজ একেবারেই একা হয়ে গেল, তার আপন বলতে আর কেউ রইল না দুনিয়ায়। বেঁচে থাকা অবস্থায় যতটুকুই মায়ের স্নেহ পেয়েছে বুলবুল ততটুকুই মায়ের শেষ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে সে, এখনো মায়ের কথা মনে করে নিবিড়ে কাঁদে বুলবুল।
ঢাকার সেলুনে বেশ কিছুদিন কাজ করার পর সেখানেই পরিচয় হয় একটি পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করা একজন নারীশ্রমিক রাজিয়া আক্তারের সঙ্গে। পরিচয়টা একসময় প্রেম থেকে প্রণয়ে গড়ায়। মোটামুটি অল্প বয়সেই দুজন দুজনকে বিয়ে করে বসে। রাজিয়ার চাকরি আর নরসুন্দর বুলবুলের আয়ের টাকায় বেশ ভালোই চলছিল ছোট্ট সংসার। এদিকে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী রাজিয়া আক্তার। প্রথম সন্তানকে ঘিরে জমতে থাকে তাদের অনেক স্বপ্ন, জল্পনাকল্পনা। বুলবুলের ঘর আলো করে আসে তাদের প্রথম সন্তান। কিন্তু সেই আলোর প্রজ্বালন খুব বেশি আলোকিত করতে পারেনি পরিবারটিকে। এক দমকা হওয়ার মতোই বুলবুল-রাজিয়াদের সব স্বপ্ন- কল্পনা যেন নিমেষেই লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
সন্তান জন্মানোর পর এক বছরের মাথায় আবার যখন রাজিয়া সন্তানসম্ভবা হলো তখন শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশ কয়েক দিন কারখানায় যেতে না পারায় পোশাক কারখানার কর্মকর্তারা নির্দয়ের মতো রাজিয়াকে বের করে দেয় চাকরি থেকে। যে কারখানায় রাজিয়া তার শরীরের রক্ত পানি করে ৮ বছর নিরলস শ্রম দিয়েছে, সেই রাজিয়াকেই আজ চাকরিচ্যুত করা হলো সামান্য কিছুদিন না আসার কারণে। তবুও কোনো প্রতিবাদ না করে কোলের ছোট্ট শিশু লামিয়াকে নিয়ে তার ফান্ডের জমানো পাওনা টাকা চাইতে গেলে তা–ও পায়নি বলে জানায় রাজিয়া। এদিকে স্ত্রীর চাকরি হারানোর পর স্ত্রী, শিশুসন্তানের দুধের কৌটা, ঘরভাড়াসহ সংসারের খরচের চাকা বইতে একেবারেই আর পারছিল না নরসুন্দর বুলবুল হোসেন। শেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে ঠগিদের শহর থেকে ফিরে এল শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাক্তা ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে। এ ছাড়া আর কোনো থাকার জায়গা ছিল না বুলবুলের।
কোনোমতে এনজিও থেকে লোন করে স্থানীয় ব্রীজপার এলাকায় একটি চুল কাটার সেলুন দেন বুলবুল, শাশুড়ির দেওয়া এক টুকরো জমিতে একটি ছাপরা ঘর তুলে কোনোমতে বসবাস শুরু করে বুলবুল দম্পতি। এখন বুলবুল-রাজিয়া ৩ সন্তানের জনক–জননী। বড় মেয়ে নামীমা আক্তার, মেজ মেয়ে রাবীবা আক্তার এবং ১ বছরের ছোট ছেলে রাব্বি হাসান। গত এক বছরের করোনার মহামারিকালে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে নরসুন্দর বুলবলের পরিবার। কেননা, জীবন–জীবিকার একমাত্র অবলম্বন এ সেলুনের ওপর ভরসা করেই চড়া সুদে লোন নিয়েছেন। সেলুনে আর আগের মতো মানুষ চুল কাটাতে বা সেভ করাতে আসে না। সারা দিনে খুব হলেও ১০০ কি ১৫০ টাকা আয় করে চাল–ডাল কিনে বাড়ি ফিরতে হয় তার। প্রতি মাসে এনজিওর কিস্তি, সংসারের খরচ মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তার পরিবারকে। এদিকে সম্প্রতি বুলবুলের থাকার জন্য ছাপরা ঘরটা ঝড়ের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। একরকম খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাকে। একটু দমকা হাওয়া আর ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস পেলেই সন্তানদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে উঠতে হয়ে রাজিয়াকে।
উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে বুলবুলের বাড়ি গিয়ে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়। মরা বাঁশের খুঁটির ওপর কয়েক ফালা টিন দিয়ে একটা ছাউনির মতো করে তার নিচে স্ত্রীসহ ৩ সন্তান নিয়ে বসে আছে, ঘরের কোনো লেসমাত্র নেই। কয়েক দিন ধরে ছোট ছেলেটার জ্বর। টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছে না সন্তানের। শেষ কবে নিজের এই শিশুসন্তানকে একটু দুধ কিনে খাইয়েছিল, তা আর মনে করতে পারে না বুলবুল। সংসারের এ টানাপোড়েন নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় সময় ঝগড়া–বিবাদ লেগেই থাকে। এত বছর ধরে এই জঙ্গলে পড়ে আছে। আজও কোনো জনপ্রতিনিধি তাকে কোনো প্রকার সাহায্য–সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেনি।
নিজের দুর্বিষহ জীবনের কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ওঠেন নরসুন্দর বুলবুল। বলে, ‘আমার জীবনটাই কাটছে খুব কষ্টে কষ্টে, মেলা ছোটবেলা মায়েরে হারাইছি, বিনা চিকিৎসায় মায় আমার মইরা গেছে, মায়ের মুখটা অহন খালি মনে পড়ে, মায় থাকলে আমার কষ্টটা বুঝত। এই দুনিয়ায় মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই। কম বয়সে বিয়া করছি-সুখ কোনো দিন পাই নাই। পিনদনের লুঙ্গিটা আরেকজনের কাছ থেইকা চায়া আনছি। ছোটবেলা মা হারানের পর খাইয়া না খাইয়া মাইনস্যের কাম করছি, এক তুলা জমি নাই আমার, একটা ছাপরার নিচে কোনোমতে থাকতাম, তা–ও তুফানে উড়াইয়া নিছে গা। সেলুনে কামকাজ নাই, মাস শেষে সমিতির ঋণের কিস্তি, করোনার লাইগা দোকানে আর কাস্টমার আহে না আগের লাহান। ছোট ছোট পোলাপান লইয়া আমি অহন থাকমু কই? ঈদে পোলাপানরা নতুন জামাকাপড় চাইতাছে। কিনা দিতে পারতাছি না, বাপ হইয়া এই কষ্ট কই রাহি ভাই। গেরামের মেম্বার–চেয়ারম্যানগর কাছ থেইকা আইজও একটা সুতা পাইলাম না আমি। সরকার হুনছি গরিবগর লাইগা ঘর বানাইয়া দেয় আমি এই ছোড ছোড পোলাপাইনের লাইগা ঘর চাই সরকারের কাছে, ঘর চাই নাইলে কোনো বড়লোক মানুষ যদি আমারে সাহায্য করে, আমি হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচতে পারতাম বউ–পোলাপান লইয়া।’
বুলবুলের স্ত্রী রাজিয়া আক্তার বলেন, ‘আমি ছিলাম পোশাক কারখানার শ্রমিক। আমি জানি একজন ওয়ার্কার কত কষ্ট কইরা তার মজুরি নেয়, তা–ও আবার ঈদের সময় বেতন–ভাতা লইয়া কত না টালবাহানা। আমি ৮ বছর গাজীপুরের এক পোশাক কারখানায় কাম করছি, বিনা দোষে আমি চাকরি হারাইছি, আমার ফান্ডের টেকা চাইতে গেলেও তা পাই নাই। বড়লোকগর লগে ঝগড়া কইরা তো আর আমরা পারমু না, তাই কষ্টে চাকরি ছাইড়া চইলা আইছি। নিজের লাইগা কোনো চিন্তা হয় না, তয় এই দুধের শিশুগুলাইন লইয়া কেমনে কাটব আমগর দিন।’
১ বছরের করোনাকালীন লকডাউনের পৃথিবীতে সবচেয়ে বিপাকে আছে আসলে শ্রমজীবী মানুষেরা। বিশেষ করে দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক, দোকানদার, ফুটপাতের ছোট ব্যবসায়ীসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা। শ্রমজীবী মানুষের নায্য অধিকার আদায়ের জন্য আত্মত্যাগের এ মহান মে দিবসে সারা পৃথিবীতে সমান মর্যাদায় পালিত হয়। এবারের মে দিবসে বাংলাদেশের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মালিক শ্রমিক নির্বিশেষে মুজিব বর্ষ গড়ব দেশ’। সরকার সংকট মোকাবিলায় শ্রমিকদের বেতনের জন্য ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারের অর্থ যাতে সুষম বণ্টন হয় শ্রমিকদের মাঝে।
*লেখক: ইমতিয়াজ আহমেদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক