নাফাখুমের সুখ-দুঃখ আলাপন: ভ্রমণপিপাসুদের ঠিকানা–২

ছবি: লেখক

রেমাক্রি বাজারে নামার পর চারদিকে তাকালে যে খোলা জায়গা, মাঠ, নদী দেখবেন সবই আপনার। অসাধারণ ভালো লাগার মতো প্রকৃতির মধ্যে ফলে আছে পাকা পেঁপে, বন্য ফুল আরও নানা ধরনের ফল। ফুলের রং দেখলেই আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। আর রাতে যদি সবাই মিলে বারবিকিউ করতে চান, তাহলে আগেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, রেমাক্রি বাজারে বারবিকিউ করার মতো জিনিস পাওয়া যায় না।

রেমাক্রি আসার জন্য থানচি বাজার থেকে রওনা দিলে বাজার থেকে মুরগি, বারবিকিউ করার জন্য প্রয়োজনীয় মসলা আপনাকে কিনে নিতে হবে। লাকড়িও কিনে নিয়ে যেতে হবে, যার দাম পড়বে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। রেমাক্রির সব রিসোর্টে বারবিকিউ করার ব্যবস্থা আছে। রিসোর্টে, খোলা জায়গায় অথবা নদীর ধারে বারবিকিউ উপভোগ করতে পারেন। আপনি চাইলে সেখানে ফানুস বা আতশবাজি ফোটাতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে আপনাকে হয় ঢাকা থেকে এগুলো নিয়ে যেতে হবে, অথবা থানচি বাজার থেকে কিনতে হবে। তবে বাংলাদেশ সরকার আতশবাজি না ফোটানোর জন্যই নিরুৎসাহিত করে। প্রকৃতির কাছে গিয়ে স্থানীয় জল, ফল—সবই আপনার মতো করে উপভোগ করতে পারবেন। রাতে রেমাক্রিতে অবস্থানের পর যদি আপনার পরিকল্পনায় থাকে নাফাখুম যাবেন, তাহলে মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আপনাকে প্রথমেই চার ঘণ্টা ট্রেকিং করতে হবে, এবং সেখানকার পোশাক-পরিচ্ছেদ ও পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য। কখনো পানি বা পাহাড় পার হতে হবে। এ জন্য আগেই বলেছি আপনার জুতা জোড়া হতে হবে স্লিপার আর প্লাস্টিকের, যাতে ভিজলেও সমস্যা না হয়। এ ধরনের জুতা আপনি থানচি বাজার অথবা ঢাকা থেকেও কিনে নিয়ে যেতে পারেন। ঢাকাতেও ১০০ বা ২০০ টাকায় চমৎকার স্লিপার অথবা প্লাস্টিকের জুতা পাওয়া যায়।

সকালে রেমাক্রি বাজারে নাস্তা সেরে যদি ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে আপনি নাফাখুম যাওয়ার জন্য রওনা দেন, তাহলে দুপুর ১২টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাবেন। নাফাখুম যাওয়ার পথে যে রাস্তা, পাথর, নদীর পানি, তা আপনাকে মুগ্ধ করবে সব সময়। পথিমধ্যে দুই-তিনবার দাঁড়ানোর জন্য টংয়ের দোকান রয়েছে। সেই দোকানগুলোতে চা, কলা, স্থানীয় ফল ও পানির সুব্যবস্থা রয়েছে। ওখানে বড় বড় পাথর আছে, চাইলে সেখানেও আপনি নামাজ পড়তে পারেন। অজুর জন্য কোনো আলাদা পানির প্রয়োজন পড়বে না। নাফাখুমের লেক থেকেই পানির ধারা আসতে থাকে। আপনি চাইলে সেই পানি ব্যবহার করে অজু করে নিতে পারেন। তবে আপনি যদি বিকেল বা সন্ধ্যায় রওনা দেন, তাহলে নিরাপত্তার কারণে টর্চলাইট, নেইল কাটার, চাকু সঙ্গে রাখা ভালো। নাফাখুম যাওয়ার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় সরু রাস্তাগুলোতে সাবধানে পা ফেলতে হবে। আমার নিজস্ব মতামত, হাঁটার সময় পানির ভেতর দিয়ে যাওয়াটাই নিরাপদ।

ছবি: লেখক

সে ক্ষেত্রে পানির ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় শেওলা পড়া পাথরগুলো এড়িয়ে যেতে হবে, যাতে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় না থাকে। কিছু জায়গায় সরু রাস্তা, সেখানে আপনাকে আপনার টিম লিডারের কথা শুনতে হবে। যেমনটি নন–ফরমাল ন্যাচার স্কুলের পক্ষ থেকে আমি করেছি। সরু, পিচ্ছিল রাস্তা পার হওয়ার সময় Safety First, keep your body in the left side ইত্যাদি নির্দেশনা শুনতে হবে। ওই সরু রাস্তাগুলোতে একজন আরেকজনের হাত ধরে পার হওয়ার প্রয়োজন হবে এবং পানির মধ্যেও একজন আরেকজনের হাত ধরে পার হওয়ার প্রয়োজন হবে। কোনোভাবেই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এমনকি পানির মধ্যে অথবা সরু রাস্তায় চার-পাঁচজন একসঙ্গে হাত ধরে হাঁটাটা বেশি নিরাপদ। যাতে একজন পড়ে গেলে অন্যজন ধরতে পারে। এভাবে পানি, পাথর, মাঠের ভেতর দিয়ে পার হতে হতে ডানে-বামে যদি তাকান, দেখতে পাবেন প্রকৃতির অলংকার। পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে যেসব সবুজগাছ রয়েছে, তার মধ্যে কিছু বাঁশ। এ বাঁশের কিছু পাতা আছে, যেগুলোকে আপনার মনে হবে দুবাইয়ের চকচক করা স্বর্ণের মতো। প্রকৃতি যেন নিজেই তাকে সাজায়। আর অলংকারগুলো কোনো অংশেই কোটি টাকার স্বর্ণের থেকে কম নয়। বিশেষ করে নারী সহযাত্রীরা অত্যন্ত মুগ্ধ হন। আমি দেখেছি অনেকে এটা গলায় পরতেও চান। সেটি পরার চেয়ে অন্তর দিয়ে যদি তুলে আনা যায়, তাহলে সব থেকে ভালো। ক্যামেরা বা ভিডিও করে সব সময় সবকিছু তুলে আনা যায় না। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ট্রেকিংয়ের সময় স্থানীয় লোকজনের, স্থানীয় প্রকৃতির ছবি তোলা নিষেধ। সব জায়গায় ছবি তোলা যাবে না। এ জন্য আপনাকে গাইডের পরামর্শ নিতে হবে। এভাবে তিন থেকে চারবার বিশ্রাম নেওয়ার পর ধীরে ধীরে জঙ্গল, পাহাড়, ছোট ছোট ঝরনা, নদী, টিলা, যেখানে কোথায় উঁচু আবার কোথায় নিচু—এসব পেরিয়ে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে ধীরে ধীরে আপনি পৌঁছে যাবেন নাফাখুমের পথে।

আরও পড়ুন

‘নাফাখুম’ শব্দটি ব্যাখা করার প্রয়োজনীয়তা এখন অনুভব করছি। ‘নাফা’ শব্দের অর্থ মাছ। এটি বার্মিজ শব্দ। ‘খুম’ শব্দের অর্থ গর্ত। আপনি নাফাখুম যাওয়ার সময় লক্ষ করবেন, পাথরের মধ্য দিয়ে পানি যাওয়ার সময় গায়ে ঘুরপাক খেয়ে পাথরের মাঝে ছোট ছোট গর্ত হয়, এগুলোকে ‘খুম’ বলে। এ গর্তের মধ্যে অসংখ্য মাছের বসবাস। যাওয়ার সময় আপনারা অসংখ্য মাছ আর গর্ত দেখতে পাবেন। অর্থাৎ ‘নাফা’ শব্দের অর্থ মাছ আর ‘খুম’ শব্দের অর্থ গর্ত। তাহলে শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় ‘গর্তের মাছ’ অথবা ‘মাছের গর্ত’। নাফাখুম ঝরনার পানি যেখানে পড়ে, সেখানে অনেক মাছ পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন সেই মাছ ধরে। চাইলে মাছের বারবিকিউ করে খেতে পারেন। এ মাছগুলো অত্যন্ত সুস্বাদু এবং দাম অনেক কম। আমরা মাছগুলো পাগলের মতো উপভোগ করেছি। মাছগুলোর দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা। ছোট হলে ২০ টাকা। আর বড় ৫০ টাকা। স্থানীয় দিদিরা এটি আপনাকে প্রস্তুত করে দেবেন।

নাফাখুম যাওয়ার পর যেটি আপনার মাথায় রাখতে হবে সেটি হলো, সেখানে অল্প কিছু আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং সেই আবাসনটি একেবারেই আদিবাসীদের জন্য উপযোগী। যদিও এখন পর্যটক যাওয়ার কারণে ওখানকার আধিবাসীদের ঘরগুলোতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কারও দুটি ঘর আবার কারও তিনটি ঘর রয়েছে। এখানে থাকার খরচ খুবই কম। অনেক বড় মাচাং ঘর। পুরো দলকে একটি ঘরেই থাকতে হবে এবং থাকার ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা। খাবার ভাড়া ফাইভ স্টারের খাবারের মতো। যেমন আমরা যেখানে ছিলাম মিন্টু মিয়ার খাবারের দোকান। বাড়ির ভেতরেই সে খাবারের দাম টানিয়ে রাখবে। মানুষগুলো অত্যন্ত সৎ ও ভালো। তাঁরা আশা করেন, আমরা যারা যাই, তাঁরা যাতে তাঁদের সঙ্গে সদালাপী হই। আমরা যাতে তাঁদের সঙ্গে শ্রদ্ধা নিয়ে কথা বলি। তাঁরা খুবই আন্তরিক। সুযোগ হলে তাঁদের আন্তরিকতা গ্রহণ করা উচিত। তাঁরা বাসার ভেতরেই রান্না করেন। আপনি দুই ধরনের খাবার অর্ডার করতে পারেন।

প্রথমত তাঁদের স্থানীয় খাবার, যেমন নাপ্পি দিয়ে তাঁরা সব খাবার রান্না করেন। নাপ্পি হলো একধরনের শুঁটকি। এ শুঁটকি দিয়ে তৈরি পাহাড়ি সবজি। যাঁরা শুঁটকি পছন্দ করেন, তাঁরা খেতে পারেন। তবে আমার অনেক সহযাত্রী খেতে না পারলেও আমি পাগলের মতো খেয়েছি। স্থানীয় খাবারের দাম কম। এ ছাড়া আপনি অর্ডার করতে পারেন মুরগির মাংস, ডিম, ডাল, সবজি। তবে তাদের স্থানীয় চাল খেতে হবে। এর কোনো বিকল্প সেখানে নেই। সেই চাল অত্যন্ত সুস্বাদু, আঠালো এবং সুবাসিত। এ চালগুলো সেদ্ধ করা নয়। আমাদের এলাকায় একে বলে ‘আতপ’ চাল। একটি গুরত্বপূর্ণ তথ্য হলো নাফাখুমে আপনি কোনো হাই কমোডের ব্যবস্থা পাবেন না।

প্রকৃতিক কার্যটি সম্পন্ন করতে হবে প্রাকৃতিক পরিবেশে। সামান্য টিন দিয়ে ঘেরা বা চাটাই দিয়ে ঘেরা বাথরুমে অভ্যস্ত হতে হবে এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে সেই প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। আপনারা রুমে ব্যাগ রেখে নিচে এসে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে পারবেন। আবাসন থেকে আপনারা যে আওয়াজ শুনতে পাবেন সেটি হলো, নাফাখুম ঝরনার শব্দ। নাফাখুম ঝরনার শব্দে আপনি দিনরাত মাতোয়ারা থাকতে পারেন। আপনারা চাইলে দুই কিংবা এক রাত সেখানে থাকতে পারেন। এরপর আপনি নিচে নামলে ঝুলন্ত একটি ব্রিজ দেখতে পাবেন। যেটি বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের একটি অংশ হিসেবে ২০১৯ সালে তৈরি করা হয়েছে। এই ব্রিজে দাঁড়িয়ে নাফাখুমের ঝরনা উপভোগ করা যায়। এপাড়–ওপাড় দুই পাড়েই বসতে পারেন, খেতে পারেন। তবে সাবধান, গোসলে যখন নামবেন, তখন খেয়াল রাখবেন কোনোভাবেই আপনার পা যাতে বড় বড় পাথরের উপর থেকে পিছলে নিচে পড়ে না যায়। নিচে পড়ে গেলে মাথা থেকে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা যথেষ্ট এবং প্রতিবছর দুই-চারজন পর্যটক সেখানে মারা যান। আপনাদের নজর রাখতে হবে, সঙ্গীর হাত ধরে নামতে হবে। আমি বলব, নিচে না নামাই ভালো। যাঁরা অত্যন্ত দক্ষ, সাহসী, সাঁতারু, তাঁরা নামতে পারেন। সঙ্গে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নিতে হবে, রেমাক্রি বাজার থেকে শুরু করে নাফাখুম পর্যন্ত যেকোনো জায়গা থেকে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নিতে পারেন। ঢাকা থেকেও নেওয়া যায়। শেষ

লেখক: অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম, আই ই আর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নন–ফরমাল ন্যাচার স্কুল, বার্ড ফাউন্ডেশন।