নাফাখুমের সুখ-দুঃখ আলাপন: ভ্রমণপিপাসুদের ঠিকানা-১

বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার সর্বদক্ষিণের ইউনিয়নের নাম হলো রেমাক্রি ইউনিয়ন পরিষদ। পাহাড় চূড়া, ঝরনাধারার নৈসর্গিক পাহাড়ি ভাঁজে ভাঁজে সব মিলিয়ে দুই কিংবা আড়াই হাজারের মতো ভোটারের বাস। দেশের সর্বপূর্বের থানা থানচির অধীনে এর অবস্থান। থানচি বাজারে যাওয়ার আগেই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে বান্দরবান সদর, লোকে যাকে বলে নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, সাঙ্গু নদীর বহমান জলধারা। পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান হিসেবে নীলাচলের নাম কেন যে এটা হয়েছে, তা আমি বলতে পারব না। তবে এটুকু আঁচ করতে পারি যে নীলাচলের শীর্ষ থেকে বা ঘুরে সোজা তাকালে নীল শাড়ি পরিহিত কোনো এক উর্বষীর নারীর মাটিঘেঁষা আঁচল ধরে হেঁটে গেলে আপনি পৌঁছে যাবেন নীলাচলের শেষ সীমানায়। আপনি দেখতে পাবেন চারদিকে নীল সবুজের চাদরে ঢাকা নৈসর্গিক সবুজের আঁচলে ঘেরা ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ের সমাহার। আঁচলের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভোরবেলা অথবা দুপুরে কিংবা বিকেলে মাথা ঘুরিয়ে চোখ দুটিকে সোজা উচ্চতায় ছড়িয়ে দিলে চোখ, বুক, এর আত্মা জুড়িয়ে দেখতে পাবেন আকাশ কত নীল। সে কারণে বোধ হয় বোদ্ধারা পর্যটকদের জন্য এই নাম করেছেন নীলের আঁচল অন্য কথায় নীলাচল।

আপনি যদি ঢাকা থেকে নাফাখুম যেতে চান তাহলে মানসিক, শারীরিক এবং নান্দনিক ভিত্তি বেশ শক্ত হতে হবে। প্রকৃতিপ্রেম উচ্ছল ঝরনাধারার মতো আপনার আত্মার মধ্যে বহমান থাকা জরুরি। সৌন্দর্য আত্মা আপনার মস্তিষ্ককে বেশ লোলুপ করে গড়ে তুলবে। নাইট কোচে যেতে চাইলে দূরপাল্লার যেকোনো বাসেই আপনি যেতে পারেন, এসি কিংবা নন এসিতে। তবে প্রকৃতিপিপাসুদের জন্য অল্প খরচে দূরপাল্লার বাসে যাওয়াটাই যুক্তিসংগত। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষে সামর্থ্য ও পছন্দের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করাটাই প্রত্যাশিত।

রাত ১০টার কিংবা ১১টার বাসে উঠলে আপনি নেমে যাবেন সকাল ৭টা কিংবা ৮টার মধ্যে বান্দরবান সদর বাসস্ট্যান্ড। দুই পা এগোলে কিংবা দুই পা পেছালেই পাবেন পাবলিক টয়লেট অথবা হিল ভিউ হোটেল, বিভিন্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা উন্নত হোটেল, যেখানে আপনি কিংবা আপনার সহযাত্রীদের সবাই মিলে প্রকৃতির কাজটা সেরে নিতে পারবেন। কিছু দূর অগ্রসর হলে খুঁজে পাবেন বান্দরবান সদর থেকে চান্দের গাড়ি ভাড়া করার নির্ধারিত স্থান। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার জন্য তালিকাভুক্ত গাড়িগুলোকে সিরিয়াল অনুযায়ী ভাড়া পাওয়া যায়। সদর থেকে যদি নাফাখুম যান, তাহলে চান্দের গাড়ি নিতে হবে থানচি বাজার পর্যন্ত আর যদি আপনি বগা লেক যেতে চান, তাহলে আপনার গাড়ি নিতে হবে রুমা বাজার পর্যন্ত। যেখানে আপনি যান না কেন, ১২ থেকে ১৪ জনের চান্দের গাড়ি ভাড়া হবে ৬ হাজার থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা। বান্দরবান সদর থেকে যাত্রা শুরু করার সময় চান্দের গাড়ির ছাদ আকাশটি খোলা রাখাই উত্তম। অতঃপর প্রকৃতির অপরূপ লীলায় মত্ত হওয়ার জানালাগুলো খুলে দেবেন পাখির মতো দুই হাত ছড়িয়ে।

রুনুজুনু বাতাসের সঙ্গে মিশে যাবেন আর দেখবেন আপনার দেহ, মন, আত্মা আর মস্তিষ্ক নিবিড় বাতাসে ধুয়ে নিষ্পাপ উন্মুক্ত শিশুর ধারায় আপনি বিলীন হয়ে যাবেন। শহরের একটু বাইরে বের হলেই সবুজ পাহাড়ঘেঁষা ঝুলন্ত কিছু রিসোর্ট পাবেন ইচ্ছে হলে সেখানে আপনি দু–এক রাত উপভোগ করতে পারেন। আর নিঃসঙ্গ রাস্তা দিয়ে যদি এগিয়ে যান, তাহলে প্রকৃতির দেওয়া ক্যামেরা-লেন্স ‘দুটি চোখ’ ভরে নিতে পারবেন ডানে কিংবা বাঁয়ের সবুজে ঘেরা পাহাড়ি সৌন্দর্য আর নীল আকাশের গাঢ় নীলে। অল্প দূরে যেতেই পেয়ে যাবেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর আর্মি ক্যাম্প, যেটাকে বলে ওয়াই জংশন। এখান থাকে বাঁ দিকে পাহাড়ের তলদেশে ঘেঁষে চলে যাবেন রুমা বাজার ও বগা লেক। আর ডান দিকে পাহাড়ের চূড়া পেরিয়ে থানচি বাজার নাফাখুমের রাস্তা। মনে রাখবেন, আর্মি ক্যাম্পে আপনি ও আপনার দলের পরিচয়, গাড়ির নম্বরসহ অবশ্যই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।

ওয়াই জংশন থেকে ডান হাতের পাহাড়ের চূড়া ধরে আমরা যদি এগিয়ে যাই, তাহলে পৌঁছে যাব নীলগিরির দিকে। কিন্তু নীলগিরিতে যাওয়ার আগে আমরা পাব মেঘলা। মাঝখানে আমরা যদি চাই তাহলে বান্দরবানের সর্বোচ্চ চূড়া দিয়ে উঠে গাড়িটি যাবে।

ওপরে ওঠা, নিচে নামা চারদিকে যে সৌন্দর্য, সেটা আমরা উপভোগ করতে পারব। মাঝখানে গাড়িটি রেখে যদি আপনি মনে করেন আপনার দলবলসহ ফ্রেশ হতে হবে, তাহলে নীলগিরির ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। নীলগিরির ভেতরে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হবে। আপনার গাড়ির পার্কিং চার্জসহ যাত্রীদের সবারই চার্জ দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সাড়ে তিন শ আর ব্যক্তিগত একজনের জন্য এক শ করে টাকা দিতে হবে। যদি নীলগিরিতে আপনার প্রবেশ করার কোনো উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে প্রবেশ না করাই ভালো। তবে নীলগিরির মধ্যে প্রবেশ করলে অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পারবেন। ওপরের আকাশের দিকে তাকালে একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী নীল আকাশ দেখতে পারবেন। সে কারণে হয়তো এর নাম হয়েছে নীলগিরি। কোনো খরচ ছাড়াই আপনি মেঘলা ঘুরে যেতে পারেন। মেঘলাতে উঠলে দেখতে পারবেন মেঘের বাড়ি। সম্ভবত মেঘের বাড়ি ও মেঘলা নামের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আসামের মেঘালয়ের সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে রবিঠাকুরের শেষের কবিতার জন্ম হয়েছিল। মেঘালয়ে দাঁড়ালে যে রকম মেঘ দেখা যায়, ঠিক তেমনি মেঘলাতে দাঁড়ালেও আপনি দেখতে পারবেন অসাধারণ মেঘের খেলা। বিকেল থেকে যদি আপনি মেঘের খেলাটা দেখতে শুরু করেন, তাহলে সন্ধ্যা পর্যন্ত নতুন একটি দৃশ্যের মুখোমুখি হবেন। সামনে দেখতে পাবেন কুয়াশাচ্ছন্ন, যদিও মনে হবে কুয়াশা, আসলে এগুলো মেঘরাজি। মেঘরাজির ওপারে সূর্যটি যখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে, তখন মনে হবে ওপারে যেন বিরাট সমুদ্র এবং সূর্যটি ডুবে যাচ্ছে। পশ্চিম দিকে আপনি যদি চুপটি মেরে বসে থাকেন মেঘলার যেখানে বাংলাদেশ সরকারের অনেক উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে একেবারে পাহাড়ের চূড়া ঘেঁষে একটু দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের জন্য বসার বা দাঁড়ানোর জায়গা সেখানে রয়েছে। আপনি ইচ্ছা করলে সেখানে বসে আপনার সহযাত্রীরা মিলে সূর্যের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলা করতে পারেন এবং সেখানে কোনো পয়সা দিতে হবে না। কিন্তু নীলগিরিতে আপনাকে পয়সা গুনতে হবে। তবে আনন্দের বিষয় হলো, নীলগিরির মধ্যে প্রবেশ না করলেও নীলগিরির গোড়ায় আপনি পাবেন পাহাড়ি অঞ্চলের পেঁপে, জাম্বুরা, আনারসসহ নানা রকমের ফল বিক্রি করছেন আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনেরা। তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে গলাটা ভিজিয়ে নিতে পারেন ডাবের পানিতে।

অতঃপর আপনাদের রওনা দিতে হবে থানচি বাজারের দিকে। বলা বাহুল্য, থানচি বাজার পর্যন্ত যেতে আপনি যে নীরব প্রকৃতির মধ্য দিয়ে যাবেন, সেখানেও আপনি চান্দের গাড়িতে দাঁড়িয়ে দুই হাত উঁচু করে বাতাসের সঙ্গে যেমনি খেলা করতে পারেন, তেমনি খেলতে পারেন ডানে–বাঁয়ের প্রকৃতির সঙ্গে। এভাবে খেলতে খেলতে আপনি থানচি বাজারে পৌঁছে যাবেন। থানচি বাজারে যাওয়ার পর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যেটি সবার জন্য খুবই অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে যে নাফাখুমে যাওয়ার আগে জাতীয় পরিচয়পত্রের দুটি কপি সঙ্গে নিতে হবে। পরিচয়পত্রের একটি কপি সঙ্গে নিতে হবে নিরাপত্তার কারণে। সব থেকে ভালো হয় আপনি যদি আগেই আপনার গাইড ঠিক করে নেন, তা না হলে থানচি বাজার থেকে আপনার গাইড ঠিক করা অপরিহার্য। এই গাইডের সহায়তা নিয়ে বাঁ পাশের দিকে পাহাড়ের ওপরে উঠলে আপনি থানচি থানা পাবেন। সব সহযাত্রী এবং থানচি থেকে নির্বাচিত যে গাইডের উপস্থিতিতে থানচি থানা কর্তৃপক্ষ আপনাদের ছবি তুলে রাখবে। একই সঙ্গে আইডি কার্ড জমা রাখবেন নিরাপত্তার কারণে। সব থেকে ভালো হয় আপনার এবং আপনার সহযাত্রীদের সব তথ্য যেমন আপনার নাম, টেলিফোন নম্বর, এনআইডি নম্বর এগুলো হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারের মাধ্যমে আগেই গাইডকে দিয়ে রাখেন, তাহলে গাইড এসব তথ্য নিয়ে থানায় দিয়ে রাখলে আপনি যেদিন থানায় যাবেন, ওই দিন দ্রুততম সময়ে আপনি ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যাবেন। অথবা আপনি যদি সেখানে উপস্থিত হয়েও করতে চান, সেটাও করতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে খুব যে বেশি ঝামেলা, তা–ও কিন্তু নয়। থানা কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এ কাজটি সম্পন্ন করেন। থানার কাজটি সম্পন্ন করার পরে আপনাদের নিচে নেমে বাজারের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে থানচি বাজারের শেষ প্রান্তে রেমাক্রি যাওয়ার ঘাটে। ঘাটের উজানেই প্রথমে আছে বিজিবি ক্যাম্প।

বিজিবি ক্যাম্পে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো যদি আপনি বেলা তিনটার পরে যান, তাহলে রেমাক্রির উদ্দেশে কোনো নৌকা পাবেন না। অবশ্যই আপনাকে বেলা তিনটার মধ্যে থানচি বাজারে পৌঁছাতে হবে, যদি সময়ের তাড়া থাকে তাহলে বিজিবি নিরাপত্তা ক্যাম্পে অনেক সুন্দর একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে, সেখানে আপনি অত্যন্ত যৌক্তিক মূল্যে আপনার দুপুরের খাবারটি সেরে নিতে পারেন অথবা খাবারটি প্যাকেট করে নৌকাতে উঠতে পারেন। নৌকা ভাড়ার জন্য সরকারি হার সেখানে ধার্য করা আছে। প্রতিটি নৌকার জন্য তিন হাজার টাকা এবং প্রতিটি নৌকায় সর্বোচ্চ চারজন দর্শনার্থী বসতে পারবেন। তবে গাইড ছাড়া যাওয়া যাবে না। বিজিবি ক্যাম্পে আরেকবার আপনাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। আপনার নামের পাশাপাশি, আপনাদের সহযাত্রীর নাম এবং গাইডের নামসহ রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, তারপর আপনারা আপনাদের দুপুরের খাবারটি নিয়ে একে একে নৌকার দিকে চলে যেতে পারেন, তাহলে আপনাদের সময়টা বেঁচে যাবে।

এই যে আপনি থানচি বাজার থেকে নিচে নামলেন, এরপরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা প্রদানকারী সংস্থার সীমানা সেখানে শেষ। এখন আপনি প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করলেন সঙ্গে শুধু থাকবে আপনার গাইড। অনুরোধ করব গাইডের নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য, কারণ তাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে লাইসেন্স রয়েছে এবং তাঁরা কাজটি করতে করতে অত্যন্ত দক্ষ ও পরিপক্ব হয়ে উঠেছেন। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী চললে কোনো অসুবিধা হবে না আশা করি।
থানচি বাজার থেকে রেমাক্রি যাওয়ার যে লেক সেই লেকে প্রবেশ করলে সেখান থেকে রেমাক্রি যাওয়ার জন্য প্রায় ঘণ্টা চারেক লাগবে, পাথরের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবেন। যত ওপরে যাবেন মনে হবে আপনি ভাটিতে যাচ্ছেন, আসলে আপনি উজানে যাচ্ছেন। যতই উজানে যাবেন ততই শুকনা পাথর দেখতে পারবেন।

ছোট ছোট পাথর থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় পাথর দেখতে পারবেন। রাজা পাথর, টাইগার স্টোন ইত্যাদি নানা নামে আপনি পাথর দেখতে পারবেন। এই পাথরগুলোতে অনেকে পূজাও দিয়ে থাকে। যেতে আপনি আপনার গাইড থেকে অনেক ধরনের তথ্য পাবেন। বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের মিথ বা মুখরোচক গল্প শুনতে পারেন। যেমন রাজা পাথরের বিচার করার কাহিনি, রাজা পাথরের মেয়ের সঙ্গে অর্ধেক সাপের বিয়ে এসব মুখরোচক গল্প। তবে ওখানকার স্থানীয় মানুষজন সাংস্কৃতিক দিক থেকে এসব বড় বড় পাথরকে পূজা করে। যাওয়ার সময় আপনাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা, নদীটি খুবই স্রোতস্বিনী। যাওয়ার সময় যাতে নৌকাটি বড় পাথর দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাই নিশ্চুপে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। সৌন্দর্য দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে নদীতে নামা যাবে না অথবা পাথরে নামা যাবে না।

বলে রাখা ভালো যে স্থানীয় মানুষ যারা দীর্ঘদিন প্রকৃতির মধ্যে বসবাস করে, তারা প্রকৃতিকে খুবই ভালোবাসে, পাথরের পূজা করার পাশাপাশি তারা নদীর পানিকে পবিত্র বলে মনে করে। সেই পবিত্র পানিকে যদি কেউ নষ্ট করে, কেউ যদি তাতে কোনো ময়লা ফেলে, তাহলে তাদের অনেক কষ্ট লাগে, সে কারণে আমরা যারা পর্যটক হিসেবে যাই, তারা প্লাস্টিকমুক্ত একটা পরিবেশ রক্ষা করলে সব থেকে বেশি ভালো হয়। আমাদের যে বিষয়টি সব থেকে বেশি নাড়া দিয়েছে এবং আমাদের দলকে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেওয়ার জন্য যেটি অনুপ্রেরণা দিয়েছে তা হলো এখানকার নদীগুলোতে অসংখ্য চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল তারা ওইখানে ছুড়ে ছুড়ে ফেলেছে যে কিছু কিছু জায়গায় এমন হয়েছে যে দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সময় স্বল্পতার কারণে আমরা আমাদের এ দল থেকে নদী পরিষ্কারের কাজটি করতে পারিনি। তবে পরেরবার যখন যাব তখন আমরা চাই নদীটিকে পরিষ্কার করে আসতে।

পর্যটক হিসেবে আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমরা যেন যেখানে–সেখানে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল ও প্লাস্টিকজাতীয় যেকোনো জিনিস না নিয়ে যাই। যেখানে সেখানে এগুলো ফেলা মানেই পরিবেশকে নষ্ট করা, পরিবেশের গতিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করা। অতঃপর সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা পার হয়ে আপনি পৌঁছে যাবেন রেমাক্রি বাজার।

রেমাক্রি বাংলাদেশের সর্বপুবের ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নে দুই হাজার থেকে তিন হাজার লোকের বাস। রেমাক্রি ইউনিয়নটি বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন, ছড়ানো-ছিটানো বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পাহাড়ের ওপরে অল্প অল্প করে লোকের বসবাস। রেমাক্রি বাজারে নামার সময় খুব সাবধানে পানির মধ্যে নামবেন। এখানে দুটি তথ্য দেওয়া ভালো, প্রথমত, আপনার যে জুতাটি থাকবে সেটি প্লাস্টিকের হলে খুব ভালো এবং পাদুকার তলদেশে যাতে খোপ খোপ গর্ত থাকে, যাতে করে আপনি পিছলে পড়ে না যান। আর প্লাস্টিকের জুতা পরতে হবে, কারণ আপনাকে অনেকবার পানির মধ্যে নামতে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনি যদি প্লাস্টিকের জুতা ব্যবহার করেন, তাহলে আপনার যাতায়াতটি অনেক বেশি সুখকর হবে। রেমাক্রি বাজারে নামার পরে গাইড আপনার জন্য থাকার ব্যবস্থা করবেন। এখানে থাকার ব্যবস্থা বেশি নেই, তাই আগে থাকার ব্যবস্থা করা ভালো। তবে আনন্দের বিষয়, এখানে থাকার খরচ বা খাবারের খরচ আমাদের কাছে খুব কম বলেই মনে হবে। আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, পাহাড়িরা যেমন মাচাং ঘরে থাকে, তেমন একটি কক্ষে ৮ থেকে ১০ জন থাকতে পারবেন। এটার জন্য আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।

এ ছাড়া আমরা যারা আধুনিক সমাজ থেকে যাই, তাদের জন্য সব রিসোর্টে হাই কমোডের ব্যবস্থা না থাকলেও একটি-দুটি রিসোর্ট আছে, যেখানে আপনি হাই কমোডের ব্যবস্থা পাবেন। তবে আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে যেখানে থাকবেন, সেখানে হাই কমোড না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এরপর যখন আপনারা থাকার রুমে প্রবেশ করবেন বড়সড় কিছু রুম আছে, যেখানে ১০-১৫ জন একদিকে ছেলে অন্যদিকে মেয়ে এভাবে আলাদা করে থাকা যায়। অত্যন্ত নিরাপদ, গাইড আপনাদের সঙ্গে সব সময় থাকবে। একটুখানি বিশ্রাম নেওয়ার পরেই দেখবেন যে আপনার জন্য আগে অর্ডার করা রাতের খাবারও প্রস্তুত হয়েছে। আপনি চাইলে আপনার খাবারটি আপনার ঘরে বসেও খেতে পারেন অথবা কোনো কোনো রিসোর্টে ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা আছে, আপনি সেখানেও খেতে পারেন। চলবে...
* লেখক: অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নন ফরমাল নেচার স্কুল, বার্ড ফাউন্ডেশন