গগনটিলা হয়ে কালাপাহাড়, রেলজংশন অ্যাডভেঞ্চার–২

গগনটিলা
ছবি: সংগৃহীত

৩৬ বছর পর জীবন যখন অতিমারিতে অবরুদ্ধ, অবরুদ্ধ জীবনের ধূসর প্রেক্ষাপট নিয়ে বিচিত্র শহরটিও দেখি কী রকম অবিশ্বাসী! বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকেও মানুষের জন্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে সহানুভূতি নাকি করুণা, বুঝে উঠতে পারি না! সর্বশেষ সংযোজন-বিয়োজন নিয়ে শুনতে হচ্ছে সান্ত্বনাহীন কোভিড মহামারির নানা ধরনের খবর। লকডাউনে ফ্ল্যাটে বসে কাটছে পারিবারিক গল্পময় যাপিত জীবন। সবাই যার যার ঝাঁপ ফেলে গুমোট মুখে বাসায় বসে থাকে। বিরক্তিরা তড়পায়। পাশের বাসা থেকে এক বৃদ্ধ কেশে উঠছেন ঘন ঘন; বোধ হয় কাশির সঙ্গেই চলমান পৃথিবীটার ওপর প্রচুর ক্ষোভও ঝেড়ে দিচ্ছেন! তুলনামূলক বাইরের পৃথিবীটাই বরং অনেক শান্ত। নিঃসঙ্গতা শব্দটি বায়বীয়। প্রকৃতিপ্রেমিক আমার কাছে নির্জনতাই আরাধ্য। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা কানে বাজল খুব—
‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশিরবিন্দু।’

সাধারণ একটি টিলা কীভাবে মানুষের আগ্রহ ও কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেতে পারে, তা কুলাউড়ার গগনটিলায় আসা দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা না বললে বোঝা যাবে না। পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ট্রেকিং ট্রেইলের মাধ্যমে এ চূড়ায় যাঁরা আরোহন করছেন; দেখলাম তাঁরা বেশির ভাগই স্থানীয় মানুষ। মনে হলো, ছুটির দিনে কোথাও কোয়ালিটি টাইম বিনিয়োগ করতে চাইলে; এ জায়গার জুড়ি দেশের অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। কেউ কেউ সপরিবার এসেছেন, কেউ কেউ বন্ধুবান্ধবসহ।

নাগরি লিপি
ছবি: সংগৃহীত

অনেকেই একা। এদের কেউ কেউ চা–বাগানের বিশালত্বে হারানোর বিপুল আনন্দে আত্মহারা। কেউ ভিডিওগ্রাফিতে মগ্ন। আবার কেউ হয়তো উঁচু গগনটিলায় উঠে সমতল দেখার আনন্দে নিজেকে ভাবছেন গৌরবান্বিত আবার পরক্ষণেই হয়তো ভাবছেন, প্রকৃতির ঐশ্বর্যের কাছে নিজে কতটাই না ক্ষুদ্র! প্রকৃতির কাছে হারিয়ে যেতে যেতে মানুষ ভাঙছে তার নিজেরই হাতে গড়া শহুরে যন্ত্রজীবন। অমোঘ নিয়তির গলা জড়িয়ে প্রকৃতিতে শেষমেশ লীন হতে চায় মানুষ। মানুষের শেকড় যেহেতু লেপটে আছে প্রকৃতির সঙ্গে। ভাবি, এ শেকড় ছিঁড়ে পালানোর কি কোনো মন্ত্র জানা আছে? আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, মানুষ সেই সমগ্রেরই অংশ, যাকে আমরা মহাবিশ্ব বলে থাকি। এ অংশটি সময় ও স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে এর চেয়ে আলাদা কিছু মনে করেন, তখন তা হয় আত্মপ্রতারণা।

আরও পড়ুন

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, মাথার ওপর সুনীল আকাশ, একটু এগিয়ে গেলেই যেখানে সবুজ জঙ্গল, সেখানেই দেখা হয়ে যায় শিক্ষক ও সাংবাদিক সঞ্জয় দেবনাথের সঙ্গে। গগনটিলা থেকে নেমে অপার্থিব আনন্দে বাগান–অভ্যন্তরের তাজা পাতায় সিক্ত লিকার চায়ে চুমুক দিতে দিতে, হাস্যরসে হুটোপুটি খাওয়া এক নববিবাহিত দম্পতির দিকে তাকিয়ে সঞ্জয় আনমনে বলে ওঠেন, ‘বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো। আনন্দ নিয়ে জীবনভর বাঁচো!’ বিকেলের নরম রোদে তখন জমে উঠেছে দিগ্বিজয়ী বাতাসের হিল্লোল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেন কুমারী মেয়ের মতো কচি কচি সবুজ পাতারাও তুমুল আনন্দে বাতাসের বিছানায় এপাশ-ওপাশ একটু গড়াগড়ি খেয়ে নিচ্ছে!
৯৬০ ফিট উচ্চতার গগনটিলা মৌলভীবাজারের সর্বোচ্চ টিলা। টিলাটি ইস্পাহানি গ্রুপের গাজীপুর বাগান কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাংলোটিও পর্যটকদের জন্য অফুরান মুগ্ধতার উৎস। জানা গেল, বেসরকারিভাবে বাংলোটি ব্যবহারের অনুমতি না থাকলেও চাইলে সিনেমার শুটিংয়ের জন্য এটাকে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া সরকারের শীর্ষ রাজনীতিক এবং আমলারা গগনটিলার দৃষ্টিনন্দন বাংলোতে অবকাশ যাপনে যখন তখন চলে আসেন। কুলাউড়া শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এ টিলা।

রাজার দিঘির গল্প

সারি সারি নানা প্রজাতির ফুলের গাছ, বন্য প্রাণীর কিচিরমিচির শব্দ, শান্ত-সৌম্য ছায়াঘেরা এক নির্জনতা ভেদ করে লোকালয়ের দিকে এগোতে এগোতে সঞ্জয় বলছিলেন, কুলাউড়ার আরেকটি ঐতিহ্য রাজার দিঘির গল্প। সেখানে প্রতিবছর বড়শি উৎসবের আয়োজন হয়। সিলেট মুলুকের তাবৎ শৌখিন মৎস্যশিকারির দল সেই শিকারে মত্ত হয়ে ওঠেন। ভালো বড়শি এবং আদার নিয়ে তুমুল হর্ষধ্বনিতে, দক্ষ শিকারিরা সুনিপুণভাবে দিঘি থেকে বড় আকৃতির মাছ ধরে দর্শকদের কাছে নিজেদের হাতযশ প্রমাণ করে থাকেন। তবে কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জানালেন, ছায়াতরুসমৃদ্ধ কালিটি চা–বাগানের ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুকুরটি আর আগের অবস্থায় নেই। অতীতে একসময় ফুলে ফুলে শোভিত পদ্মপুকুরের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকনের জন্য যেখানে হাজার হাজার মানুষের পদচারণ ছিল, সেখানে আজ কচুরিপানার সমাহার!
মোটামুটি দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগল। উঠতে–নামতে মোট সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। জয় করলাম কুলাউড়ার কালাপাহাড়ের চূড়া। তার আগে অবশ্য এ পাহাড়ের আরণ্যক পরিবেশে ওপরে ওঠার জন্য যথেষ্ট সামর্থের কসরত দেখাতে হলো। কুলাউড়ার গ্রেট আইকনের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ১০০ ফুট ওপরে। চূড়ায় ওঠার পর মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠল। সুখকর অনুভূতির জন্ম হলো না। আকর্ষণীয় দৃশ্য এখানে যে দুরাশা। এক্সট্রিম অ্যাডভেঞ্চারাস ট্রেকিং ট্রেইলে আরোহীদের জন্য এটা হতে পারে আদর্শ জায়গা। কালাপাহাড়ের ট্রেকিং পথটি অনেক সুন্দর। পাহাড়ে ওঠার পথ একটা।

কালাপাহাড়ের চূড়ায় লেখক
ছবি: সংগৃহীত

যার নাম পাহাড়ি পথ। কিন্তু নামার পথ দুইটা, ঝিরি পথ ও পাহাড়ি পথ। ঝিরি পথে গেলেও পাহাড়ি পথ ভ্রমণ করে তবেই যেতে হবে। কালাপাহাড়কে এখানকার স্থানীয় লোকজন ‘লংলা পাহাড়’নামেও সম্বোধন করে। এ পাহাড়ের ৬০ ভাগ বাংলাদেশের ভূসীমায় থাকলেও ৪০ ভাগ ভারতীয় সীমানায়। উত্তর ত্রিপুরায় এ পাহাড়ের বাকি অংশকে রঘুনন্দন পাহাড় নামে ডাকা হয়।

চুল অকিঞ্চিৎ, মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক চ্যাপটা, গন্ডদেশ উন্নত। দেহের আকার মধ্যমাকার। দেখেই বোঝা গেল, উনি প্রাচীন মঙ্গোলিয়ান মহাজাতির উত্তরসূরি। বাংলাদেশের দুর্লভ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি খাসিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য, নাম রাজেশ সুচিয়াং।

তাঁকে দেখে আমার চোখে প্রশ্নের কৌতূহল। নিবৃত্ত করতে গিয়েই কি না, তিনি কথার তুবড়ি ফুটিয়ে বলতে থাকেন, ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন গভীর অরণ্যই খাসিয়াদের আবাসের জন্য পছন্দনীয় স্থান। খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। এদের পরিবারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারীরা। নারীরা কনেযাত্রী নিয়ে বিয়ে করে বর নিয়ে আসেন নিজ নিজ পানপুঞ্জিতে। এ কারণে কোনো খাসিয়া পরিবারে তিন ভাই থাকলে বিয়ে করে তিনপুঞ্জিতে চলে যান। আর নারীরা নিজেদের বাড়িতেই মাতা–পিতার সঙ্গে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন। এদের পরিবারে নারীদের ভূমিকাই মুখ্য।

বিলুপ্তপ্রায় সিলেটি বাড়ি
ছবি: সংগৃহীত

কুলাউড়ার খাসিয়ারা সিনতেং গোত্রভুক্ত জাতি। স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদের মালিক হন নারীরা। পুরুষদের বিয়ে হলে তাঁরা গিয়ে ওঠেন শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ স্ত্রীর বাড়িতে। তাঁরা বাড়ির কাজে ও পানের জুমে কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করেন। স্ত্রীর বাড়িতে পুরুষেরা কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি দিনগুলো।

বেগুনছড়া, পুঁটিছড়া, লবণছড়া পুঞ্জিগুলোর নামও বেশ সুন্দর! রাজেশের সঙ্গে গল্প করতে করতেই সামনে এগিয়ে এল ওর মেয়ে এথিনিয়া। দেবশিশুর মতোই দেখতে এথিনিয়া গায়ে জড়িয়েছে তার শরীরে মানানসই বৈচিত্র্যময় নকশার ‘রাঙাখাদি’ যা সূক্ষ্ম সুতা ও তাঁতের বুননে তৈরি। ট্রাউজারের জায়গায় আবার ‘পিনন’, যা আমাদের সেলাইবিহীন লুঙ্গির মতোই। মিষ্ঠি হাসিতে এথিনিয়া বলল, ‘ওখানে হ্রদের ধারে আমাদের বেগুনছড়া পুঞ্জি। আঙ্কেল, যাবেন নাকি আমাদের কুটিরে?’ প্রায় ৩০০ ফুট দূরে তাকিয়ে দেখলাম মাটির চাতাল। সাদা ধবধবে। এর তিন-চার ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর, সঙ্গে প্রতিটি বাড়ির শোভাবর্ধক হিসেবেই যেন কাজ করছে পানবরজ। পকেটে থাকা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আজ নয়, অন্য কোনো দিন। লাফাতে লাফাতে এ পাথর–সে পাথর ডিঙিয়ে পথ চলে এথিনিয়া। ওর পায়ের ঝিনুকের নূপুর ছুমছুম বাজে। আমি ওর চলে যাওয়াটা দেখতে দেখতে ভাবি, কিছু কিছু সম্পর্ক আছে বেশ অদ্ভুত। জীবনে ক্ষণিকের জন্য দেখা হলেও তাদের প্রভাব থাকে সারা জীবন। শুধু এথিনিয়া নয়, মনে হলো, এখানকার সবুজ পাতা, রঙিন ফুল, ডালপালাও দুলে দুলে বলছে, ‘এসো, এসো, এসো…।’ ভাবছিলাম, শতাব্দীর পর শতাব্দী, ধৈর্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কীভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এই কালাপাহাড়ের চূড়া? যার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে এখন শরতের টুকরো টুকরো মেঘ। দেখছি, পথের ধারে ফুটে আছে নাম না জানা অসংখ্য বুনো ফুল। দূরে যেমন শোনা যাচ্ছে হাতির ডাক, তেমনি পায়ের সন্নিকটে ঘাসঝোপে পাখিদের সে কী বাহাস! স্নায়ুকোষগুলো জেগে ওঠে!
নেই গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ। বড় পাহাড় আর আশপাশে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট পাহাড়, ছোট ছোট টিলার পাশে সবুজ ঘাসের বন। সব টাটকা সবুজ, যেন এখুনি বৃষ্টিতে ভিজে যাবতীয় মলিনতা ধুয়েছে। অতঃপর পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের লাল পাতায় নিয়ে এসেছে এক প্রবল অনৈসর্গিক সৌন্দর্য। রাজেশ সুদূরের দিকে ইঙ্গিত করে জানাচ্ছেন, যেখানে কিনা রং আর বিন্যাস উৎকর্ষের চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। একবারে ন্যাচারাল ফ্লেভার। সামনে পা ফেলছি, অথচ পা যেন এগোচ্ছে না! শ্রদ্ধায় সভ্রম বিস্ময়ে আমি বারবার রহস্যময় পাহাড়টার দিকে ফিরে তাকাই; শিল্পের ধ্রুপদি সৌন্দর্যবোধ কি একেই বলে? একটু আনমনা হয়ে সুনীল আওড়াই—
‘আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়ই কিনতাম।
কারণ, আমি ঠকতে চাই।’
(পাহাড় চূড়ায়-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)