গগনটিলা হয়ে কালা পাহাড়, রেলজংশন অ্যাডভেঞ্চার-১

খাসিয়া নারীছবি: সংগৃহীত

সে তিন যুগ আগের কথা। ঢাকা থেকে এসে বিল্টু মামা নেমেছেন কুলাউড়া জংশনে। তখন সাতসকাল। এটা-সেটা কেনার পর তিনি ভাবলেন, খালাতো বোনের বাসায় যেহেতু উঠবেন, তো সকালের নাশতার জন্য ব্রেড সঙ্গে নিয়ে গেলে কী রকম হয়? সেমতো কনফেকশনারি বা বেকারি খুঁজে চলেছেন হন্যে হয়ে, কিন্তু আরাধ্য ব্রেডের আর দেখা নেই; দোকানিরা বেমালুম অস্বীকার অথবা চেপে যাচ্ছে! সবাই বলছে, না ব্রেড নেই। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথে শেষ দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে চোখ পড়ল তাকে সাজিয়ে রাখা ব্রেডের ওপর। বললেন, এটা কী? দোকানি জবাব দিল, এটা লুফ। আগন্তুক বললেন, এ লুফই খুঁজছি! এটা দিন। নিজের অজ্ঞানতার জন্য বিহ্বল দোকানি অবশেষে হেসেই দিল! আর এ হাসির সঙ্গে প্রথম দর্শনে নয়নাভিরাম গুছানো শহরটি দেখে বিল্টু মামার চোখে লেপটে রইল মুগ্ধতার আয়েশি রেণু। চিৎকার দিয়ে রিকশা ডাকলেন।

কিন্তু রিকশাওয়ালা স্থানের নাম শুনেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। পাত্তা দিল না! চেহারায় ইম্প্রেসিভ না হওয়ায় জীবনভর তাঁকে মেয়েরা পাত্তা দেয়নি; কিন্তু এ আজব শহরে এক্ষণে মনে হচ্ছে রিকশাওয়ালারাও সেই নারীদের সমপর্যায়ভুক্ত। শেষমেশ দরদাম করে একটাতে চড়ে বসলেন। রিকশাওয়ালার সঙ্গেও অল্পতেই ভাব জমিয়ে ফেললেন। রিকশাওয়ালা জানালেন, তাঁর বাড়ি নেত্রকোনা। বেশি আয়ের আশায় এখানে চলে এসেছেন। জানালেন, তিনি একাই নন, তাঁর মতো এ রকম বিভিন্ন জেলার অসংখ্য লোক এখানে থিতু হয়েছেন মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য বা জীবনসংগ্রামের সূত্রে। রিকশা এসে থামল শহরের ব্যস্ততম টিটিডিসি এরিয়ায়। ভাড়া মেটাতে গিয়ে বিল্টু মামার দৃষ্টি পড়ল কয়েকটি দেয়ালের দিকে। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে কাঠ-কয়লায় অঙ্কিত শৈল্পিক রাজনৈতিক চিকাগুলো; তা যেন এখানকার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতাবোধকেও প্রখরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

বিল্টু মামা রাতের আহারপর্বে মজে প্লেট ছাড়া কোনো দিকেই তাকাচ্ছেন না। বিরইন চাল দিয়ে তৈরি বাঁশের ব্যবহারে চুঙ্গা পিঠার মাদকতায় তিনি যারপরনাই আচ্ছন্ন। সঙ্গে চিকেন টিক্কা মাসালার স্বাদ নিতে নিতে বোনের কাছে আবদার করে বসলেন, পরদিন আতপ চালের সঙ্গে হাঁস-বাঁশ মেনু চান। হাঁস দিয়ে বাঁশ রান্না কুলাউড়ার ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। বোন হেসে দিয়ে বললেন, শুধু হাঁস-বাঁশই নয়, এর পরের দিন তিনি সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস ভুনার আইটেমও রাখছেন।

কালা পাহাড়
ছবি: সংগৃহীত

রাতের খাবার সেরে বেতের সোফার কুশনে খানিকটা গা এলিয়ে, দুলাভাইয়ের কাছে পলকা মুহূর্তের অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করলেন। দুলাভাই জানালেন, আঞ্চলিক শব্দের প্রতি এহেন দুর্বলতার কারণ হচ্ছে একদা সিলেটের নাগরিলিপি সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল কুলাউড়া। জনপ্রিয় নাগরি পুথিকারেরা ছিলেন এ কুলাউড়ার অধিবাসী। এ সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বলয় এতই সুদৃঢ় যে কুলাউড়া ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, ভারতের গুয়াহাটি, শিলচর, শিলং, কাছাড়, বরাক উপত্যকা, করিমগঞ্জ, আগরতলা, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ অভিবাসী মিলিয়ে বিশ্বের কয়েক কোটি লোক সিলেটি উপভাষায় কথা বলে নিরন্তর প্রাণের আকুতি মেলে ধরেন।

উত্তরে ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে আসাম, পশ্চিমে রাজনগর উপজেলা আর এর মাঝের ভূখণ্ডের কুলাউড়ার রেলওয়ে জংশনকে একসময় বলা হতো আসাম প্রদেশের ইস্টার্ন গেট। অনেকটা বাধ্য হয়েই কি না বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও তাই ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে ট্রেনযোগে সিলেট যাত্রাপথে কুলাউড়া রেলস্টেশনে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার এ সুবিধাকে কাজে লাগাতে দেশভাগের পর থেকেই এখানে তাই আসাম, ত্রিপুরার লোকজনও এসে বসতবাড়ি করেছেন। জ্ঞানমাধুর্যে ভরপুর দুলাভাইয়ের বিজ্ঞোচিত কথাবার্তার ফাঁকে হাস্যরসও উপচে পড়ল। সেই হাসিতে দুলাভাইয়ের ঠোঁটের ডগায় রস গড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে কুলাউড়ার খাসিয়া পানের ঝাঁঝ ঠিকই আন্দাজ করলেন বিল্টু মামা। সেই রাতে টিমটিমে হারিকেনের আলোয় ঝোলা থেকে বিল্টু মামা কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ‘অকস্মাৎ সীমান্ত’ বইটি মেলে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর দেখি, বিল্টু মামা সদর দরজা পেরিয়ে বাথরুমে যাচ্ছেন। এ ফাঁকে কয়েকটি পেপারব্যাক বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বুকটা কী রকম জানি সটান হয়ে উঠল। রংচঙা প্রচ্ছদ দেখে একটি বই বিছানায় নিয়ে যেতে চাইলে বিল্টু মামার কাছে ধরা পড়ে গেলাম।

কুলাউড়া জংশন
ছবি: সংগৃহীত

আমার কাছ থেকে পছন্দের বইটা রীতিমতো কেড়েই নিলেন। গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ওটা প্রাপ্তবয়স্কদের বই, তোমার না! একনিমেষেই হৃৎস্পন্দন যেন পাঁজরের ভেতর দুমড়েমুচড়ে দিল। তখন নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কোনোমতে রাগ সংবরণ করে ভাবলাম, আমি তাহলে কবে বড় হব?

বাউন্ডুলে বিল্টু মামার সঙ্গে পরদিন হাওরে নৌকাবাইচ শেষ করে ঘুরতে ঘুরতে একটি রিকশা নিয়ে এসেছি ৬ কিলোমিটার দূরের ইস্পাহানি টি স্টেটে। ওখানকার ম্যানেজার সাহেব বিল্টু মামার পূর্বপরিচিত। খাতির–যত্নের অভাব হলো না। ঘুরে ঘুরে দেখলাম ইস্পাহানি মির্জাপুর চা–বাগান এবং এর মনভোলানো বৈচিত্র্য। ম্যানেজার জানালেন, অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে হলে এখানকার গগনটিলার চূড়ায় উঠতে হবে। চূড়ায় উঠলে কুলাউড়া শহরটা খুব ছোট মনে হবে আর কাছাকাছি থাকা ভারতীয় পাহাড়গুলো দৃশ্যপটে ধরা দেবে। হাতে সময় থাকলে লংলা পাহাড় বা কালা পাহাড়টিও পরিদর্শন করার অনুরোধ করলেন। সময়স্বল্পতার জন্য মামা আর আমার এর কোনোটিই চর্মচক্ষুতে ধারণ করা সম্ভব হলো না। মধ্যবয়স্ক ম্যানেজার সাহেব ভীষণ সদালাপী ও বন্ধুবৎসল। জানালেন, কর্মসূত্রে এখানেই একটানা ১৫ বছর। নাগরিক বিজ্ঞাপনের জনারণ্য থেকে সৌন্দর্যের আড়ালে থাকা প্রাচুর্যহীন এ অরণ্যজীবন তাঁর কাছে ভীষণ উপভোগ্য। পকেটে হাত দিয়ে ট্রিপল ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি নিজ মুখে পুরে নিলেন, অন্যটি বাড়িয়ে দিলেন বিল্টু মামার দিকে, সঙ্গে লাইটার। চালককে আদেশ দিলেন বাংলো থেকে দ্রুত গাড়ি বের করতে।

গগনটিলা
ছবি: সংগৃহীত

জঙ্গল–পাহাড়ের ঝোপঝাড়, ঘন সবুজ আদিমতা, বুনো গন্ধ, পাহাড়ের নেশা ধরানো থমকে থাকা পেছনে ফেলে আমাদের জিপটি এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমে শহরের দিকে। সন্ধ্যা সমাগত। চার ব্যাটারির টর্চলাইট জ্বেলে দূরের মিটিমিটি আলোর দিকে ইঙ্গিত করে হঠাৎ ম্যানেজার বলে উঠলেন, ইউরেকা! ইউরেকা! এই যে ‘সিলেটি’ ঘর! এখনো হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে। ছিটেফোঁটা হাতে গোনা গুটিকয় এখনো আছে, বসতবাড়ি বা টি-গার্ডেনের বাংলো হিসেবে। এ অঞ্চলে এগুলোকে বলা হয় ‘আসামিজ টাইপ ঘর।’ নির্মাণ ও স্থাপত্য জগতেও এ বৈশিষ্ট্যের ঘরগুলোর পরিচিতি সিলেটি বা আসামিজ টাইপ ঘর হিসেবে। দূর থেকে দেখলেও একটি মিল চোখে পড়ে, প্রতিটির ছাদের রং গাঢ় লাল। কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া এ সিলেটি ঘরগুলো কুলাউড়া ছাড়া একমাত্র সিলেট শহরেই দেখা যায়। সিলেটের বাইরে আসামের শিলং ও গুয়াহাটিতে প্রায়ই দেখা মেলে। কালো কাঠের ব্লক, ব্লক ফ্রেমে সাদা দেয়াল, ঢেউটিনের। কোনোটির সমুখে, কোনোটির তিন দিকে বা চতুর্দিকে বারান্দার মতো ছাদ টানা। এ ধরনের ঘরবাড়ির মূল আকর্ষণ চার, ছয়, আটচালা ছাদ।

গাড়ি এসে থামল আজম বোডিংয়ে। গরম লুচি, বুন্দিয়া সঙ্গে গরুর দুধের চা খেয়ে পরিতৃপ্ত ম্যানেজার করমর্দন করে বিদায় নিলেন। এবার আমাকে বাসায় পাঠিয়ে বিল্টু মামা চলে গেলেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর সঙ্গে নিভৃতে খোশগল্প করতে।
বাসায় এসে খাওয়াদাওয়া সাঙ্গ করে, বাক্সপেটরা গুছিয়ে বিল্টু মামা রওনা দিলেন রাতের মেইল ট্রেন ধরে ঢাকার উদ্দেশে। আমার কিশোরমনটার উড়ুউড়ু ভাব দমে গেল! আসলে মন খারাপের কোনো নির্দিষ্ট ধরনের সঙ্গে এর আগে পরিচিত ছিলাম না। কিন্তু বিল্টু মামার বিদায়ের মুহূর্তে কেন জানি হৃদয়ে একাকিত্বের রক্তক্ষরণ হলো; একেই কি বলে শূন্যতার রক্তক্ষরণ? চলবে...