সিঙ্গাপুর ভ্রমণের গল্প: পর্ব–২
প্রথম পর্বের পর...
পঞ্চম দিনে ঘোরাঘুরি
পঞ্চম দিন আমরা চলে যাই জুরং গার্ডেনে। এখানে প্রবেশ করতে টিকিটের প্রয়োজন নেই। এমআরটি থেকে নেমে খানিকটা হেঁটেই চলে যেতে পারেন বাগানটিতে। জুরং গার্ডেনটি আমাদের দেশের রিসোর্টগুলোর মতোই, যদিও এর আয়তন বিশাল এবং স্থাপনাসমূহ অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। এখানে রয়েছে চায়নিজ গার্ডেন ও জাপানিজ গার্ডেন, যেটি একটি আরেকটির সঙ্গে একটি ব্রিজ দিয়ে সংযুক্ত। চায়নিজ গার্ডেনে ওই সময়টাতে চায়নিজদের বিশেষ উৎসব চলছিল এবং সন্ধ্যার পরেই নানা রঙের আলোকসজ্জায় পুরো জায়গাটি রঙিন হয়ে পড়ে। অসংখ্য চায়নিজ সেখানে একেকজন একেকভাবে আনন্দ উপভোগে মগ্ন ছিল। চায়নিজ গার্ডেনে পাবেন টুইন প্যাগোডা, টি প্যাভিলিয়ন, বনসাই গার্ডেন, প্যাগোডা প্লাজা ও ক্লাউড প্যাগোডা। একটু হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে জাপানিজ গার্ডেনে গেলেই দেখতে পাবেন ফ্লোরাল গার্ডেন, টি গার্ডেন, গেস্টহাউস, ওয়াটার লিলি গার্ডেন/প্যাভিলিয়ন এবং আইকনিক ব্রিদিং গ্যালারি। ব্রিদিং গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের শৈল্পিক প্রদর্শনী। এখানে প্রবেশ করে প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে ক্যামেরাবন্দী করতে পারেন সবুজে বেষ্টিত মুহূর্তটিকে।
ষষ্ঠ দিনে যা যা দেখলাম—
ষষ্ঠ দিন আমরা চলে যাই সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানা দেখতে। ওখানে যেতে নর্থসাউথ এমআরটি ধরে খাতিব নামক স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি বা ১৩৮ নম্বর বাসে করে পৌঁছে যেতে হবে চিড়িয়াখানা। যাওয়ার পথে পেয়ে যাবেন বার্ডস প্যারাডাইস, যেটি বাচ্চাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। সিঙ্গাপুর জুতে প্রতিটি টিকিটের দাম পড়বে ৪৯ সিঙ্গাপুরি ডলার। চাইলে আপনি নাইট সাফারিতেও যেতে পারেন, এর জন্য অবশ্য জনপ্রতি ৫৬ সিঙ্গাপুরি ডলার গুনতে হবে। হাতে সময় থাকায় ওখান থেকে আমরা চলে যাই চাঙ্গি বিমানবন্দরে বিখ্যাত জুয়েল দেখতে। চাইলে শুধু চাঙ্গি বিমানবন্দর ঘুরেও আপনি সারা দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। এখানকার টার্মিনাল ওয়ানে পেয়ে যাবেন আকর্ষণীয় কৃত্রিম ঝরনা রেইন ভরটেক্স। সন্ধ্যার পর ঝরনার পানিতে নানান রঙের লেজার লাইট প্রদর্শনী এবং মিউজিক শো দেখলে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।
সপ্তম দিনে সি অ্যাকুয়ারিয়ামে ঘোরাঘুরি
সপ্তম দিনে আমাদের গন্তব্য সি-অ্যাকুয়ারিয়াম। সুবিশাল আয়তনের অ্যাকুয়ারিয়ামটি ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বৃহৎ অ্যাকুয়ারিয়াম হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পায়। ওখানে যেতে পুনরায় ভিভো সিটি স্টেশন থেকে সান্তোসা এক্সপ্রেসে উঠতে হলো। শান্তোসা এক্সপ্রেস করে রিসোর্ট ওয়ার্ল্ড বা ইমবায়াহ যেকোনো স্টেশনে নেমেই ইউনিভার্সাল স্টুডিওর পাশ দিয়ে চলে যেতেই পেয়ে যাবেন টিকিট কাউন্টার। আমরা প্রতিটি টিকিট ক্রয় করি ৪০ ডলার দিয়ে আর চার বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের কোনো এন্ট্রি ফি নেই।
অ্যাকুয়ারিয়ামে প্রবেশের সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। প্রতি মঙ্গল ও বুধবার এটি বন্ধ থাকে। এ জন্য সময় ও দিনক্ষণ দেখে ভ্রমণ পরিকল্পনা ঠিক করে নিতে হবে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই অ্যাকুয়ারিয়ামটিতে রয়েছে অন্তত ১ হাজার প্রজাতির ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী। সবচেয়ে বড় পানির ট্যাংকটির সামনে পেয়ে যাবেন বিশাল জায়গাজুড়ে বসার স্থান, যেখানে বসে বাচ্চাদের উন্মুক্তভাবে ছেড়ে দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ জায়গাটা আমার বিশেষভাবে পছন্দ হওয়ার কারণ, এখানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী বাচ্চাদের একসঙ্গে পেয়ে যাওয়া। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভাষার পার্থক্য থাকলেও ছোট বাচ্চারা ভাষার বাধা অতিক্রম করে নির্দ্বিধায় মনের ভাব আদান–প্রদান করতে পারে। বাচ্চারা এখানে প্রবেশ করলে এখানে থাকা বৈচিত্র্যময় জীবন্ত সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রদর্শনীতে মুগ্ধ হয়ে সহজে বের হয়ে আসতে চায় না। এখানে রয়েছে মোবাইল চার্জিং স্টেশন এবং ছোট একটি ফুড কর্নার।
ভ্রমণের শেষ দিনে যা যা দেখলাম
সন্ধ্যার একটু আগেই আমরা বেরিয়ে যাই মোস্তফা মার্টের উদ্দেশে। এ জন্য আপনাকে নর্থ ইস্ট লাইন এমআরটি ধরে নেমে যেতে হবে ফেরার পার্ক স্টেশনে। ভ্রমণের শেষ দিনে আমরা পুনরায় মোস্তফা মার্টে যাই। কেনাকাটায় সিঙ্গাপুর ভ্রমণকারীদের প্রথম পছন্দ মোস্তফা মার্ট হওয়ার কারণ এখানে প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই একসঙ্গে পাওয়া যায় এবং পণ্যের বৈচিত্র্যও রয়েছে অনেক। এখানে সর্বনিম্ন ১০০ ডলার কেনাকাটায় জিএসটি রিটার্ন পাওয়া যায়। তার জন্য অবশ্যই মূল পাসপোর্ট, সিঙ্গাপুর অ্যারাইভাল ফর্মের কপি এবং কেনাকাটার রসিদ নিয়ে মোস্তফা মার্টের ভেতরে নির্দিষ্ট জিএসটি রিফান্ড কাউন্টারে জমা দিতে হবে। এই রসিদগুলো পরবর্তী সময়ে চাঙ্গি বিমানবন্দরে লাগেজ বিমানে ওঠানোর আগেই জিএসটি কাউন্টারে জমা দিয়ে আপনার ফেরত প্রাপ্য ডলার সিঙ্গাপুর কিংবা ইউএস কারেন্সিতে নিয়ে নিতে পারেন।
মোস্তফা মার্টের বেজমেন্ট ওয়ানে পাবেন পোশাক, জুতা, শাড়ি এবং বাচ্চাদের খেলনা সামগ্রী। লেভেল ওয়ানে রয়েছে ফার্মেসি, ঘড়ি, ইলেকট্রনিক আইটেম এবং জুয়েলারি সামগ্রী। সুপারমার্কেট, চকলেট, বেকারি ও লাগেজের বিশাল সমাহার রয়েছে তার ঠিক ওপরের তলায়। লেভেল থ্রিতে পাবেন বাসাবাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মেয়েদের ব্যাগ এবং বিছানার সব সামগ্রী। সবচেয়ে ওপরের তলায় থাকছে গাড়ির যন্ত্রাংশ, বই, উপহারসামগ্রী এবং আসবাব। মোস্তফা মার্টের পাশেই অনেক বাংলা খাবারের রেস্তোরাঁ পেয়ে যাবেন। এখানকার খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পরিমাণেও পাবেন পর্যাপ্ত।
সিঙ্গাপুর ভ্রমণের পুরোটা সময় বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের জার্সি পরে কাটিয়েছি। মনে হয়েছে লাল–সবুজের এ জার্সিটি পরার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর হতেই পারে না। এক ভিনদেশি পর্যটক জানতে চাইল এটা কি তোমার দেশের জার্সি? হঠাৎ আবার কী দেখে নিজেই বলে উঠল, ওহ, বাংলাদেশ ক্রিকেট! দুটি ভারতীয় পরিবার লাল–সবুজের জার্সি দেখেই গল্প জুড়ে দিল। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক আগ্রহ নিয়ে কতই–না প্রশ্ন ওদের! এই জার্সি গায়ে জড়িয়েই সিঙ্গাপুরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চষে বেড়িয়েছি এমআরটি, বাস, ট্যাক্সি, শাটল ট্রেন ও মনোরেলে। এখানকার মানুষজন বেশ ভদ্র স্বভাবের এবং কে কী করছে, সেদিকে তাকিয়েও দেখে না কেউ। অচেনা জায়গায় অচেনা সব মানুষজন কতই–না নম্রতার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানোর পন্থা বলে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় স্বস্তি পেয়েছি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাত্রীদের দায়িত্ববোধ দেখে। ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে যখনই উঠেছি, স্কুলপড়ুয়া, যুবক, বৃদ্ধ/বৃদ্ধা সবাই আসন ছেড়ে দিয়ে কত সুন্দর করে মুখে হাসি নিয়ে বসতে বলেছে।
যতটুকু ঘুরতে পেরেছি, পুরো আট দিনে মাত্র দুই থেকে তিনজন পুলিশের দেখা পেয়েছি। অটোমেটেড ট্রাফিক সিস্টেম হওয়ায় কোথাও নেই কোনো ট্রাফিক পুলিশ অথচ জ্যাম দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সময়মতো ছেড়ে যাচ্ছে মেট্রো, বাস কিংবা ট্যাক্সি। ট্যাক্সি বুক করে সময়মতো উঠতে না পারলে জরিমানাও গুনতে হবে বেশ ভালো অঙ্কের। প্রতিটি জায়গায় বহুতল পার্কিং ভবন এবং পার্কিং চার্জ অটোমেটিকভাবে কেটে নেওয়ার জন্য প্রতিটি গাড়ির সামনে রয়েছে রিচার্জ করা নেটস (NETS) কার্ড। পার্কিং নিষেধাজ্ঞা থাকা স্থানে গাড়ি রাখলেই হঠাৎ কোথা থেকে যে বাইকে করে ট্রাফিক পুলিশ চলে আসবে, বুঝতেই পারবেন না। এরা এসে প্রথমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চালককে খুজবে। খুঁজে না পেলে পার্ক করা গাড়িটির ভিডিও ধারণ করে মামলা ঠুকে দেবে। অবশ্য মামলার পর আপিল করার সুযোগ থাকে।
এ দেশের রাস্তাঘাট, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট/টয়লেট/দর্শনীয় স্থান সব জায়গাতেই একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ যেমনভাবে চলাফেরা করতে পারে, ঠিক সমানভাবে পঙ্গু, বৃদ্ধরা চলতে পারে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে রয়েছে শিশুদের স্ট্রলার/হুইলচেয়ার রাখার নির্দিষ্ট স্থান, সহজে ওঠানামার ব্যবস্থা। দেশটির সুপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা আপনাকে আকৃষ্ট করবেই। মানুষজনের পদমর্যাদা অনুযায়ী এখানকার আবাসন ব্যবস্থা সুবিন্যস্ত করা রয়েছে। বেশির ভাগ সুউচ্চ ভবনের ছাদে স্থাপন করা আছে সোলার প্যানেল, যেটি আবার যুক্ত রয়েছে জাতীয় গ্রিডে। এ কারণে অনেক ছাদেই ওঠার সুযোগ নেই। প্রতিটি আবাসিক এলাকায় রয়েছে শরীরচর্চার নানান উপকরণ, বাচ্চাদের সুবিশাল খেলার স্থান, ফুটবল/বাস্কেটবল/ভলিবল খেলার মাঠ, ছোট গ্যালারির আকৃতির বসার জায়গা, পোষা প্রাণীদের নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর স্থান, কী নেই ওদের! দেশটির মানুষজনের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে আমাদের আকাশ–পাতাল পার্থক্য।
সিঙ্গাপুর ভ্রমণে সানগ্লাস, ছাতা, আরামদায়ক জুতা, ঢিলেঢালা পোশাক এবং ছোট বাচ্চা থাকলে স্ট্রলার নিয়ে যাওয়া উচিত। অন্যথায় রোদের তীব্রতা এবং বাচ্চাদের কোলে নিয়ে সুবিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে ক্লান্ত হয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিদিন সাতটায় সন্ধ্যা নামার কারণে ডেলাইটও থাকে দীর্ঘক্ষণ। এখানে যত হাঁটবেন, তত দেখতে পারবেন কোনো বাহন পাওয়া যাবে না।