তামিলনাড়ুর লাস্যময়ী মেরিনা সৈকতে এক বিকেল-৩
ভিন্ন এক বিকেল। ভিন্ন এক দেশ। ভারতের তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইয়ের প্রাণকেন্দ্র মেরিনা সৈকতে কাটানো একটি সাধারণ দিনের অসাধারণ স্মৃতি হয়ে রইল। মে মাসের গরমে পুড়তে থাকা চেন্নাই শহরের কোলাহলে আমরা তিন বাংলাদেশির এক অনন্য ভ্রমণদর্শন অভিজ্ঞতা। গেস্টহাউস ‘ব্রহ্মপুত্র স্টে’ থেকে মেরিনার দূরত্ব মাত্র ৫ দশমিক ১ কিলোমিটার। রোববারের যানজটে মনে হচ্ছিল অনেক লম্বা পথ। দক্ষিণ ভারতের এই যানজট আমাদের ঢাকা বা চট্টগ্রামকেও মনে করিয়ে দিল—নগরায়ণের অভিন্ন ব্যথা।
এমনই এক বিকেলে দেখা হয়ে গেল বাংলাদেশ সরকারের এক কর্মকর্তা, জসিম উদ্দিন সাহেবের সঙ্গে, যিনি এখানেই চিকিৎসা নিতে এসেছেন। সৈকতের দিকে ছুটে চলা যাত্রায় তিনজনের একটা ক্ষণিকের দল হয়ে গেলাম আমরা—আমি, আমার সহধর্মিণী, আর এই সদা হাস্যভাজন মানুষটি।
মেরিনা সৈকতে পৌঁছেই প্রথম যে অনুভূতিটা হলো, তা এককথায় ‘আহ শান্তি!’ নীলাভ ঢেউ ঝুপঝাপ করে আছড়ে পড়ছে তটরেখায়। কল্পনার কানে যেন বাজছে কক্সবাজার, পতেঙ্গা, পারকি, বাঁশখালীর সমুদ্রসৈকতের রিনিঝিনি শব্দ। মনে হচ্ছিল একটা স্কেল বসালেই উত্তর-পূর্বে দেখা মিলবে আমার জন্মভূমি চট্টগ্রাম; দক্ষিণ দিকে তাকালেই যেন অনুভব করা যায় রামায়ণের রূপকথার লঙ্কা।
নেট ঘেঁটেঘুঁটে মেরিনা সম্পর্কে যা জানতে পারলাম; এই যে আজকের মেরিনা, একসময় এটি ছিল সরু ও কাদাযুক্ত উপকূল, জোয়ারে যেটা প্রায়ই জলে ডুবে যেত। কিন্তু ১৬৪০ সালে ফোর্ট সেন্ট জর্জ আর ১৮৮১ সালের মাদ্রাজ হারবারের নির্মাণে সব বদলে যায়। জমতে থাকে পলি, তৈরি হয় বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা। ১৮৮৪ সালে গভর্নর গ্রান্ট ডাফ এর নাম দেন ‘মাদ্রাজ মেরিনা’। এরপর এটি হয়ে ওঠে সংস্কৃতি, রাজনীতি, আন্দোলন, বিনোদন আর নাগরিক জীবনের এক সম্মিলিত চিত্রমালা।
এখানে রয়েছে এম জি রামচন্দ্রন, জয়ললিতা, অন্নাদুরাই, করুণানিধির মতো রাজনীতিকদের সমাধিসৌধ, গান্ধী, তিরুভাল্লুভার, ভারতীর ভাস্কর্য।
‘Triumph of Labour’ ভাস্কর্যটি শ্রমজীবী শ্রেণির প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও। এটি একটি পরিবেশগত দিক থেকেও সংবেদনশীল এলাকা। অলিভ রিডলি কাছিমের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে মেরিনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দূষণ ঠেকাতে চেন্নাই করপোরেশন কঠোর। ২০০৯ সাল থেকে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। সুইমিং পুল, স্কেটিং রিঙ্ক, প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামো—সবই এক আধুনিক পর্যটন শহরের ছবিকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
দেখতে দেখতে চোখের সামনেই সূর্য ডুবে গেল, সমুদ্রে সূর্য ডোবা দেখার স্বাদ এখানে মেলে না। এই জায়গায় বাংলাদেশের কাছে ফেইল। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এখানের সূর্যোদয় খুবই মোহনীয় হয়। চারদিকে শান্ত, ভোরের মিষ্টি হাওয়া চেন্নাইকে নতুন করে চেনা যায়। মেরিনাকে আবছা আলো-আঁধারিতে মায়াপুরীর মতো লাগছে। জসিম ভাই কিছু খাওয়াতে চান। আমি রাজি নই, এই সমুদ্রপাড়ের খাবার খেয়ে পেট খারাপ হোক, তা চাচ্ছিলাম না। তবে একটা খাবার দেখে খুব খেতে মন চাইল কিন্তু লোভ সংবরণ করলাম। খাবারটি চেন্নাইয়ের ঐতিহাসিক খাবার নাম ‘থেঙ্গা মাঙ্গা পাট্টানি সুন্ডাল’ বাবারে বাবা দাঁত কয়টা পড়ে গেল মনে হয়! কী কঠিন নাম। পরে ভাইয়ের অনুরোধে কবল ফলের জুস পান করলাম।
সবচেয়ে মজার কাহিনি হলো ফেরার সময়, যে উবারচালককে অ্যাপে ঠিক করলাম, সে তামিল ছাড়া ইংরেজি কিংবা হিন্দি বোঝে না। আমিও তামিলের আগামাথা বুঝি না। কিছুক্ষণ পরপর ফোনে কল দেয় সে। কী বলে আমি বুঝি না। আমি ভাঙা ভাঙা হিন্দি বা ইংরেজিতে যা বলি, ও কিছুই বুঝছিল না—একেবারে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! অ্যাপে দেখছি সে আমার কাছাকাছি অবস্থানে। কিন্তু ট্রেস করতে পারছি না। এত যানজট আমি নিজের দেশে কখনো দেখিনি! বেচারা আমাদের জন্য সময় নষ্ট করল, আমাদেরও গরমের অস্বস্তি নিয়ে কাটল এক ঘণ্টা। পরেরবার যখন দেখা হলো, বুঝলাম—সে তো ভালোই ইংরেজি আর হিন্দি বোঝে! ফিরে এলাম ব্রহ্মপুত্রে, সবকিছু গোছাতে হবে—পরদিন দেশে ফেরার ফ্লাইট।
লেখক: রহিম সৈকত, শিক্ষক